ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে পাহাড়ের চিত্র, জীবন ধারা

প্রকাশিত: ১০:০৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৯

 উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে পাহাড়ের চিত্র, জীবন ধারা

ফিরোজ মান্না ॥ ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্তি আজ। ১৯৯৭ সালের এই দিনে দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ এবং ঐকান্তিক চেষ্টায় সম্পাদিত সেদিনের এই চুক্তির মাধ্যমেই অবসান ঘটে পার্বত্য অঞ্চলের হানাহানি-রক্তপাত, অপহরণ, হত্যা-খুনের যুগ। এ কারণে ঐতিহাসিক এই শান্তিচুক্তি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটি অসাধারণ অর্জন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। প্রশংসিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তিপ্রিয়তা, দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বের। গত ২২ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শুধু দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের অবসানই ঘটেনি ভাগ্যের পরির্তন ঘটেছে এই অঞ্চলের মানুষের। উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে পাহাড়ের চিত্র আর সাধারণ মানুষের জীবন ধারা। শান্তিচুক্তির ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন ও ৯টি ধারা বাস্তবায়নাধীন আছে। এষনও যেসব ধারা বাস্তবায়ন হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ফলে এই অঞ্চলের জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। আইসিএলডিএস ও পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে সরকার। সরকার পক্ষ বলছে, শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারাই ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চুক্তির বাকি ধারা বাস্তবায়ন করতে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের লোক সরকারী চাকরি পেতে পারে, এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিভিন্ন নীতি ও আইন শিথিল করা হয়েছে। ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, এডিবি, ড্যানিডা, ইইউ, সিডা ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন মেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শান্তি ও উন্নয়নের পথ কখনই মসৃণ নয়। সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রায় দুই দশক পূর্ণ হলো। পার্বত্য শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং কয়েকটি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যে ধারাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। তিনি বলেন, শান্তিচুক্তি ৪ খন্ডে বিভক্ত। ‘ক’ খন্ডে ৪টি, ‘খ’ খন্ডে ৩৫টি, ‘গ’ খন্ডে ১৪টি এবং ‘ঘ’ খন্ডে ১৯টি অর্থাৎ সর্বমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে মোট ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। চুক্তির অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার চুক্তির শর্তগুলো বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায়নি। ফলে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শান্তিচুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়ন এবং পার্বত্য এলাকার সর্বস্তরের জনগণের উন্নয়নে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বর্তমানে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে পাঁচটি ভূমি কমিশন গঠন ভূমি সমস্যা সমাধানে ১৯৯৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পাঁচটি ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি সমস্যা নিরসনের জন্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাস করা হয়েছে। পার্বত্যবাসী এ দেশেরই নাগরিক, সুখ-দুঃখের সাথী। তাদের যদি কোন দুঃখ থাকে, তা নিরসনের দায়িত্ব সরকারের। ১২ হাজার শরণার্থীকে পুনর্বাসন চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে ৫০ হাজার করে নগদ টাকা দেয়া হয়েছে। ২২ বছর আগে যারা চাকরির স্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, তাদের পুনরায় চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিধিমালা শিথিল করে পার্বত্যবাসীদের পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরি দেয়া হয়েছে। যে ধারাগুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতীয় শরণার্থী পরিবারের ৬৪ হাজার সদস্যকে ইতোমধ্যেই পুনর্বাসিত করা হয়েছে। বিশ্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত খোকন আহম্মেদ হীরা বরিশাল থেকে জানান, সংঘাত নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর কোন প্রকার তৃতীয় মধ্যস্থতা ছাড়াই স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। যা সারাবিশ্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তির সু-বাতাস ছড়ানোর ২২তম বর্ষ পালন উপলক্ষে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রণেতা তৎকালীন চীফ হুইপ এবং বর্তমান মন্ত্রী পদমর্যাদায় থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির নিজ এলাকা বরিশালে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সূত্রমতে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এবং জনসংহতি সমিতির পক্ষে (জেএসএস সভাপতি) জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে শান্তিবাহিনীর ৭৩৯ সদস্যের প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্রসমর্পণ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৬ ও ২২ ফেব্রুয়ারি চার দফায় শান্তিবাহিনীর মোট ১৯৪৭ সদস্য অস্ত্রসমর্পণ করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি উপজাতীয় শরণার্থীদের সর্বশেষ দলটি উপেন্দ্র লাল চাকমার নেতৃত্বে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। মোট ছয় দফায় ১২ হাজার ৩২২ পরিবারের ৬৩ হাজার ৬৪ শরণার্থী দেশে ফিরে আসেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালের ৬ মে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংসদে পাস হয়। এছাড়া চুক্তির খ.১৫, খ.১৬, খ.১৭, খ.১৮, খ.২০, খ.২১, খ.২২, খ.২৩, খ.২৫, খ.২৮, খ.৩০, খ.৩১, খ.৩২, গ.১, গ.৭, গ.৮, গ.৯, গ.১০, গ.১২, গ.১৪, ঘ.১, ঘ.৫, ঘ.৬, ঘ.৮, ঘ.১০, ঘ.১১, ঘ.১২, ঘ.১৩, ঘ.১৪, ঘ.১৫, ঘ.১৬, ঘ.১৭ (খ) পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। এছাড়া চুক্তির ২৫টি ধারায় আংশিক বাস্তবায়িত কিংবা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
×