ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জানুয়ারি থেকে এক অঙ্কে ॥ এত সুদ বিশ্বের কোথাও নেই

প্রকাশিত: ১০:০৮, ২ ডিসেম্বর ২০১৯

জানুয়ারি থেকে এক অঙ্কে ॥ এত সুদ বিশ্বের কোথাও নেই

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আমাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ননপারফর্মিং লোন (এনপিএল-ঋণখেলাপী)। আমি বলেছিলাম ঋণখেলাপী বাড়বে না, বরং সামনে ধীরে ধীরে এর হার কমবে। কিন্তু আপনারা বলছেন এনপিএল বাড়ছে। এনপিএল বাড়ার মূল কারণ সুদের হার। বাংলাদেশের মতো এত বেশি সুদ বিশ্বের আর কোথাও নেই। তবে ব্যাংকের এই ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেবে। কমিটি এ বিষয়ে পর্যালোচনা করে আগামী সাতদিন পর প্রতিবেদন দাখিল করবে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এছাড়া সুদহারে সিঙ্গেল ডিজিট জানুয়ারিতে (২০২০) কার্যকর করা হবে বলে জানান মন্ত্রী। রবিবার পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে দেশের সব সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, খেলাপী ঋণ বাড়ছে এটা সত্য। কিন্তু কেন বাড়ল তাহলে এটা বলব অসত্য। সুদের হার বাড়লে খেলাপী ঋণ বাড়বেই। ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ সুদহার হলে এটা দিয়ে ঋণ গ্রহীতারা কুলাতে পারেন না। সুতরাং, সুদহার নয় শতাংশ হলে খেলাপী ঋণ বাড়বে না। আশা করি, ১০ বছর পরে আমাদের ব্যালেন্স শীট পরিষ্কার হবে। তিনি বলেন, আমরা একটি জায়গায় শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারিনি, সেটা হচ্ছে খেলাপী ঋণ। খেলাপী ঋণ বাড়ার একটি কারণ হলো আমাদের সুদহার অনেক বেশি। আমাদের মতো এত উচ্চ ব্যাংক ঋণের সুদ পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। খেলাপী কমাতে হলে পৃথিবীর অন্য দেশের মতো সুদহার কমাতে হবে। আমরা সবাই বসেছিলাম কীভাবে সুদহার কমানো যায় অথবা কমপিটিটিভ একটা এনভায়রনমেন্টে আনা যায়। সবাই আমরা একবাক্যে স্বীকার করেছি যে, সুদহার কমাতেই হবে। সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে হবে। সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে আনলে আমাদের এনপিএল অনেক কমে যাবে। সুদহার কমলে আমাদের সঙ্গে বিদেশীরা ব্যবসা করে শান্তি পাবে, কোন প্রশ্ন করবে না। বিদেশীরা আমাদের এলসিগুলো গ্রহণ করবে। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমদিন থেকে বলে এসেছি, খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়বে না। খেলাপী ঋণ যদি বাড়ে তবে কোথা থেকে বাড়ে। এদেশের সব নাগরিকের কাছ থেকেই খেলাপী ঋণ বাড়ে। তাদের সবার কষ্টার্জিত টাকা। আমি তাদের পক্ষ নিয়েই বলেছিলাম, খেলাপী ঋণ বাড়বে না। আমরা সঠিকভাবে সঠিক কাজ করতে পারলে সব কিছুই সম্ভব। অর্থমন্ত্রী বলেন, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পুনর্তফসিলের সুবিধা দেয়া হয়েছিল কিন্তু হাইকোর্ট সেটাতে স্থগিতাদেশ দেয়ায় ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা নিতে পারেননি। তাই এ কোয়ার্টারে খেলাপী বেড়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট করলে অনেক উপকার হবে। কোর্টের যে অর্ডার ছিল সেটি কিন্তু এখন আর নেই। রায়টি আমরা যেভাবে প্রত্যাশা করেছিলাম সেভাবেই পেয়েছি। কোর্টের অর্ডার বাস্তবায়িত হলেই ঋণখেলাপী কমে যাবে। আমরা বিশ্বাস করি, ৩১ ডিসেম্বর আপনারা এর প্রতিফলন দেখতে পাবেন। তাই ডিসেম্বর শেষে খেলাপী ঋণ অবশ্যই কমবে। মোস্তফা কামাল বলেন, খেলাপী ঋণ কমাতে শুরু থেকেই আমরা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারিনি। এ কারণেই সুদহার বৃদ্ধি পেয়েছে। সুদহার বৃদ্ধি পেলে একটি দেশের উৎপাদনশীল খাত, শিল্প খাত উন্নত হতে পারে না। এ মুহূর্তে যে কোনভাবে এ খাতকে এগিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জিডিপি কমলেও আমাদের দেশের জিডিপি কমার কোন ভয় নেই। কারণ, আমাদের দেশের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কখন কমবে না, বরং বাড়বে। এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে খেলাপী ঋণ বিক্রির বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে খেলাপী ঋণ বিক্রিসহ কয়েকটি প্রক্রিয়া বিবেচনাধীন রয়েছে। যেগুলো ক্যাবিনেটে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে খেলাপী ঋণ বিক্রির বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদহার এক অঙ্কে (সিঙ্গেল ডিজিট) নামিয়ে আনতে গত বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ওই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ব্যাংক মালিকরা সরকারের কাছ থেকে একের পর এক সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু ঋণে সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়ন এখনও অধরাই রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৬ মাসে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে সরকারী-বেসরকারী মিলে মাত্র ১১টি ব্যাংক। এখনও বেসরকারী খাতের ৩৭টি ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১২-২০ শতাংশের ঘরে। সূত্র জানায়, ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাংক মালিকরা সরকারী আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারী ব্যাংকে রাখা, বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার কমানো এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদী ধারের নীতি নির্ধারণী ব্যবস্থা রেপোর সুদহার কমিয়ে নিয়েছে। এসব সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যই ছিল সুলভ বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। নানা সুবিধা পাওয়ার পর ব্যাংকের উদ্যোক্তারা গত বছরের জুনে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেন এবং একই বছরের ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা জানান। তবে গত ১৬ মাসে বেসরকারী ৪১ ব্যাংকের মধ্যে মাত্র তিনটি ব্যাংক এক অঙ্কের ঋণের সুদহার কার্যকর করেছে। গত বছরই সরকারী খাতের আটটি ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনে। এদিকে সর্বশেষ গত ৫ নবেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন। ঋণের সুদ হার কমাতে ৭ সদস্যের কমিটি ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র ডেপুটি গবর্নর এস এম মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত কর্ম দিবসের মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমানোর প্রক্রিয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। রবিবার রাতে গবর্নর ফজলে কবির এ কমিটি গঠন করেন। তবে কমিটি চাইলে সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র ডেপুটি গবর্নর এস এম মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোঃ ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, এবিবি চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ আলম সারওয়ার এবং এনআরবি ব্যাংকের এমডি মোঃ মেহমুদ হোসেন।
×