ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের গ্রামেও মন্দার গ্রাস

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ২ ডিসেম্বর ২০১৯

 ভারতের গ্রামেও মন্দার গ্রাস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কয়েক বছরের প্রবৃদ্ধির কারণে ভারতের গ্রামীণ জনগণের কয়েক কোটি মানুষ মধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু এখন দেশটির অর্থনীতির বিকাশ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় মন্থর হয়ে পড়ায় উর্ধগামী এই গতিশীলতাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির হচ্ছে। ৮০০ মিলিয়নের বেশি ভারতীয় দেশটির শহরাঞ্চলের বাইরে বাস করেন। সাধারণত গ্রামের মানুষেরা কর্মসংস্থানের জন্য শহরে পাড়ি জমান। কিন্তু গত কয়েক বছরের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে নগরের চেয়ে গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক বিকাশ হয়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামে আয় ও ব্যয় বেড়েছে দ্রুত। গ্রামীণ ভারতীয়রা যেসব পণ্য কিনছেন সেগুলোর তুলনায় তারা যেসব ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করেন সেগুলোর দাম খুব মন্থর গতিতে বাড়ছে। একই সঙ্গে অবকাঠামো ও আবাসন উন্নয়ন খাতে শ্রমিকদের চাহিদা কমে গেছে, অভিবাসী শ্রমিকদের রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ কমে গেছে এবং প্রবাসী শ্রমিকদের গ্রামে ফিরে আসার সংখ্যা বাড়ছে। এই অস্থিতিশীলতা নরেন্দ্র মোদির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতিকে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ ৫ ট্রিলিয়নে নিয়ে যাওয়ার। শুক্রবার প্রকাশিত সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আগের ত্রৈমাসিকে এ হার ছিল ৫ শতাংশ। আর ২০১৮ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ছিল ৭ শতাংশ। এই হারে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে মোদির প্রতিশ্রুতি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। অথচ গত বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশের বেশি। ভারতীয় অর্থনীতি প্রতিবছর প্রয়োজনীয় কয়েক লাখ কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে পারছে না। নিয়েলসনের জরিপ অনুসারে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে সাবান ও খাবার বিক্রি শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় কমে গেছে। সংস্থাটির দক্ষিণ এশীয় প্রধান সুনীল খিয়ানি বলেন, সাত বছর পূর্বে এই জরিপ শুরু করার পর এইবার প্রথম এমন প্রবণতা দেখা গেছে। অর্থনীতির মন্থরগতি দেশের সব পণ্যে পড়েছে। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় তা খাদ্য খাতে পড়েছে বেশি। কারখানা বন্ধ হচ্ছে বা উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। এতে করে গ্রামীণ এলাকায় বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এ্যামাজন, ওয়ালমার্ট, ইউনিলিভার, কোকা-কোলার মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় কোম্পানির বড় অংশের ভোক্তা গ্রামীণ এলাকায়। যদি গ্রামের লোকদের ক্রয়ক্ষমতা সঙ্কটে পড়ে, তাহলে এসব কোম্পানির বিক্রিও কমে যাবে। রাজধানী দিল্লী থেকে ২৫ মাইল দূরে খোহ নামের গ্রাম অবস্থিত। দ্রুত বিকশিত ভারতের গ্রামগুলোতে মন্থর অর্থনীতির প্রকোপ কেমন পড়েছে তা এই গ্রামের চিত্র থেকে ধারণা পাওয়া যায়। গ্রামটির ৫ হাজার বাসিন্দা শান্ত ও সহজ জীবনযাপন করতেন। তারা গম, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করতেন। অল্প কয়েক জনের ফোন বা বাইসাইকেল ছিল। শহুরে মধ্যবিত্তের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের দিকে গ্রামটিতে গড়ে ওঠে কারখানা। যেমনটি হয়েছে পুরো ভারতের বিভিন্ন গ্রামে। গ্রামটি ঘিরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন কারখানা, যেগুলোতে সুজুকি মোটর কর্পোরেশনের প্রাইভেটকার থেকে হোন্ডা মোটর কোম্পানির মোটরসাইকেলের প্রয়োজনীয় সব চাহিদা পূরণ হতো। গ্রামটির বাসিন্দারা তাদের ফসলি জমিতে ঘর তুলতে শুরু করেন। কারখানায় কাজ করতে আসা অভিবাসী শ্রমিকরা এসব ঘরে থাকতে শুরু করেন। গ্রামটিতে নতুন মানুষের আগমন ও বাণিজ্য শুরু হয়। গড়ে ওঠে খাবার ও পোশাকের ব্যবসা, শিশুদের পড়ানোর জন্য আসেন শিক্ষকরা ও সামর্থ্যরে মধ্যে গড়ে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। গ্রামের কৃষকরা হয়ে ওঠেন মধ্যবিত্ত। মোটরসাইকেল, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন কিনতে পারার মতো টাকা-পয়সা তাদের কাছে চলে আসে। অল্প কয়েকজনই কৃষি কাজে নিয়োজিত থাকেন। কয়েক হাজার অভিবাসী শ্রমিকের কারণে গ্রামের জনসংখ্যা বেড়ে গিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যে, কয়েক বছর আগের গ্রামটি এখন আর চেনাই যায় না। এই বছর অভিবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। ভারতজুড়ে গাড়ি ও টু-হুইলারের বিক্রি কমে যাওয়ায় শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছেন। এক পরিসংখ্যান অনুসারে, ১ লাখের বেশি শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছেন। গ্রামটির এক বাসিন্দা হার্কেশ যাদব। প্রজন্ম ধরে তার পরিবার কৃষি কাজে নিয়োজিত থাকলেও কারখানা স্থাপনের পর শ্রমিকদের থাকার জন্য ঘর ও দোকান চালু করেন। তিনি বলেন, শিল্প এলাকা বৃদ্ধির সঙ্গে বাইরে থেকে শ্রমিকরা আসতে শুরু করেন। এতে করে আমরা কৃষিকাজ বাদ দিয়ে তাদের জন্য অন্যান্য ব্যবসা শুরু করি। প্রতিবছরেই এমন উত্থান-পতন থাকত। কিন্তু এবারের মতো খারাপ পরিস্থিতি আর কখনও হয়নি। নরসুন্দর ধর্মেন্দ্র কুমারের দোকানে সাধারণত চুল কাটার জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন থাকত। এখন ভাগ্য ভাল হলে দিনে একজন কাস্টমার পান তিনি। গ্রামের আরও পাঁচটি নরসুন্দরের দোকান ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এক সময় কাঠের চেয়ার ছিল দোকানে। কিন্তু ব্যবসার উন্নতির জন্য ঘুরানো যায় এমন লোহার চেয়ার কিনেছেন। কিন্তু এখন কাস্টমার না থাকায় চেয়ারটি ফাঁকাই পড়ে থাকে। তিনি বলেন, ‘সবাই বলছিল নতুন চেয়ার কিনলে আরও কাস্টমার আসবে।’ ফাঁকা চেয়ারটি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি ব্যর্থ হয়েছে।’ কাস্টমার কমে যাওয়ার কারণে আয় বাড়াতে তিনি এখন স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে প্রতিদিন সকালে ডিম কিনেন এবং তা দিনমজুরদের কাছে বিক্রি করেন। গত বছর ভারত ছিল বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল বৃহত্তম অর্থনীতি। এ বছর দেশটি এখন পর্যন্ত চীন, ইন্দোনেশিয়া, হাঙ্গেরি ও অন্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। ঋণদাতারা অনাদায়ী ঋণের ভারে জর্জরিত এবং ঋণ দেয়াতে সতর্কতা অবলম্বন করছে। কোম্পানি ও ভোক্তা সংকুচিত হয়ে আসছে নগদ অর্থ সঙ্কট ও ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগের কারণে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতের গ্রামগুলোর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার তথ্যের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে কর্মসংস্থান ও মজুরি ঐতিহাসিকভাবে শহরের তুলনায় দ্রুত বেড়েছে গ্রামীণ এলাকায়। কিন্তু সম্প্রতি গ্রামীণ ও শহুরে বেকারত্বের পার্থক্য দ্রুত কমে আসছে। ভারতের কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা কর্মসূচীর চাহিদা বেড়েছে। এই কর্মসূচীর আওতায় গ্রামের যাদের একান্ত প্রয়োজন তাদের সরকারী কাজ দেয়া হয়। এই কর্মসূচীর সুবিধা নেয়া মানুষেরা তাদের কর্মক্ষমতার চূড়ান্ত সময়ে রয়েছেন। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছর। ভারতের মন্থর অর্থনীতির আরেকটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড পুওর’স রেটিং এজেন্সির ভারতীয় শাখা ক্রিসিলের পরিসংখ্যানে। তাদের মতে, দেশটির গাড়ি কোম্পানি ও এয়ারলাইন্সের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এক বছর আগের তুলনায় গাড়ি বিক্রি কমেছে ২৫ শতাংশের বেশি। এয়ারলাইন্স কোম্পানির বিক্রি গত অর্ধে কমেছে ২ শতাংশ। গ্রামে চাহিদা থাকা মোটরসাইকেল ও ট্রাক্টরের বিক্রিও কমেছে যথাক্রমে ২২ ও ১০ শতাংশ। ক্রিসিলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ধর্মকৃতি জোশি বলেন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতির কারণে ভারতের ভোগ কমে গেছে। এই বছর অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন বলে মনে হচ্ছে না।’ সরকারের এক খসড়া জরিপে দেখা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে বাড়তে থাকা পারিবারিক ভোগ ২০১৮ সালের জুনে কমে গেছে। এই জরিপে উঠে এসেছে, গ্রামীণ ব্যয় শহরের তুলনায় বেশি কমছে। খসড়া প্রতিবেদনটি ফাঁস হওয়ার পর সরকার বলেছে, এই প্রতিবেদন সরকারীভাবে প্রকাশ করা হবে না। এতে ভুল থাকতে পারে। সমালোচকরা বলছেন, সরকার খারাপ খবর লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে মোদির সরকার। এই বছর অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জী গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে দেয়া ভাষণে বলেছেন, ভারতে মানুষের ব্যয় কমেছে সামান্য। অনেক, অনেক বছর পর এমনটি ঘটল। এটি একটি বড় ধরনের সতর্কবার্তা। ভারত সরকার এই সঙ্কট মোকাবেলায় নজর দিতে শুরু করেছে। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাচ্ছে, মোদি প্রশাসন কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে, বেশ কিছু খাতে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করেছে। এই বছর সরকার দরিদ্র কৃষক পরিবারের জন্য ১২০ মিলিয়ন অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। এছাড়া গ্রামীণ এলাকার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়নে পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু, খোহ গ্রামে শ্রমিকদের জন্য নির্মিত ঘরগুলো এখন ফাঁকা পড়ে আছে। তাদের কাছে পোশাক, সিগারেট, মুদি পণ্য ও চা বিক্রেতারা এখন সঙ্কটে। এক বাসিন্দাকে গরু দেয়া গাভীর সংখ্যা ৫০ থেকে কমিয়ে ৫টিতে আনতে হয়েছে। এমনকি কারখানার শ্রমিকদের চিকিৎসা দেয়া অনুমোদনহীন চিকিৎসক ও দাঁতের ডাক্তাররাও এই সঙ্কটের বাইরে না। এক সময়ের কৃষক থেকে সরাইখানার মালিকে পরিণত হওয়া যাদব পাশের কয়েকটি দোকান দেখিয়ে বলেন, ‘এদের কাস্টমার ছিলেন যারা গ্রামের বাইরে থেকে এসেছিলেন। তারা চলে যাওয়ায় এখন আর কোন ক্রেতা নেই, তারা দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন।’ সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল
×