ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে সত্য ও ন্যায়কে সমুন্নত রাখবে

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৯

 দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে সত্য ও ন্যায়কে সমুন্নত রাখবে

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী/ খুরশিদ রাজিব, রাবি ॥ গ্র্যাজুয়েটরা দেশের উচ্চতর মানবসম্পদ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘তোমরা দেশের উচ্চতর মানবসম্পদ। দেশের ভবিষ্যত উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভর করছে তোমাদের ওপর। তোমাদের তারুণ্য, জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞা হবে দেশের উন্নয়নে প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে একজন গ্রাজুয়েট হিসেবে সব সময় সত্য ও ন্যায়কে সমুন্নত রাখবে। নৈতিকতা ও দৃঢ়তা দিয়ে দুর্নীতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। রাষ্ট্রের বিবেকবান নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা, তোমরা কখনও অর্জিত ডিগ্রীর মর্যাদা, ব্যক্তিগত সম্মানবোধ আর নৈতিকতা ভূলুণ্ঠিত করবে না। বিবেকের কাছে কখনও পরাজিত হবে না।’ শনিবার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামে আয়োজিত একাদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য মোঃ আবদুল হামিদ এ কথা বলেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তির যুগ বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আধুনিক ও প্রযুক্তির জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশের বিশাল তরুণসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য আনুপাতিক হারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। এই বিবেচনায় বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ফলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে তাতে দেশের সকল অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস করি। রাষ্ট্রপতি গ্রাজুয়েটদের বলেন, মনে রাখবে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ তাদের শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে তোমাদের শিক্ষার বায়ভার বহন করেছে। তাদের কাছে তোমরা ঋণী। এখন সময় এসেছে সেই ঋণ পরিশোধ করার। তোমরা তোমাদের মেধা, কর্ম ও সততা দিয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণ করতে পারলে সেই ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে। মনে রাখতে হবে বাঙালির শেকড় এই সাধারণ জনগণের মধ্যেই প্রোথিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নামে ওঠা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, আজকাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে শিক্ষকগণ প্রশাসনের বিভিন্ন পদ-পদবি পাওয়ার লোভে লবিংয়ে ব্যস্ত। অনেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতেও পিছপা হন না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ভুলে গিয়ে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনে সম্পৃক্ত হন। এটি অত্যন্ত অসম্মানের ও অমর্যদাকর। সাধারণ মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মান ও মার্যদার উচ্চাসনেই দেখতে চায়। তাই ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার জন্য নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপস করবেন না। শিক্ষদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, আদর্শ, প্রচেষ্টা, বৃত্তি, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস ছাড়া শিক্ষা মূল্যহীন। তাই একজন শিক্ষককে হতে হবে আদর্শ ও ন্যায়-নীতির প্রতীক। ব্যক্তিস্বার্থের কাছে আদর্শ যাতে ভূলুণ্ঠিত না হয় সে দায়িত্ব শিক্ষদেরই নিতে হবে। শিক্ষকরা রাজনৈতিকভাবেও খুবই সচেতন ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও চিন্তা চেতনায় একজনের সঙ্গে আরেকজনের পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব যেন প্রতিষ্ঠানে বা শিক্ষার্থীর ওপর না পড়ে তাও নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, শিক্ষকরা উন্নত জাতি তৈরির মহান কারিগর। শিক্ষকের কথা কেবল বক্তৃতা নয়- তা বাণী। বাণী শ্রোতার বুদ্ধি ও বিবেককে জাগ্রত করে। বাণী শ্রোতার অন্তরে জ্ঞানের মশাল প্রজ্বলিত করে। আদর্শ, প্রচেষ্টা ও বৃত্তি ছাড়া পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস মূল্যহীন। তাই একজন শিক্ষককে আদর্শ ও ন্যায়-নীতির প্রতীক হতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকাশিত খবর আচার্য হিসেবে আমাকে মর্মাহত করে।’ সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মূলত জ্ঞানচর্চা, মুক্তচিন্তা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষেত্র। এখানে নিরন্তর গবেষণার মধ্যে দিয়ে নবতর জ্ঞান ও বহুমুখী সৃষ্টিশীল কর্মকা-ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মননে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছু কিছু ঘটনা এই মানবিক মূল্যবোধের বিকাশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন থাকি এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা, মুক্তচিন্তা ও মানবিক মূল্যবোধের পীঠস্থান হিসেবে সমুন্নত রাখি।’ বক্তব্যের শুরুতে রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের স্মরণ করেন। এর আগে বিকেল তিনটায় রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন করেন। এসময় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক ড. রঞ্জন চক্রবর্তী, শিক্ষা মন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা ও অধ্যাপক ড. চৌধুরী মোঃ জাকারিয়া, রেজিস্ট্রার আব্দুল বারী, কোষাধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান, পরিচালকসহ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ছাড়াও সরকারী কর্মকর্তারা, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি, রাজশাহীর বিভিন্ন অসনের সংসদ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক। দেশের স্বার্থে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করুন ॥ চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্টদের রাষ্ট্রপতি বিডিনিউজ জানায়, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বদলে সমষ্টিগত স্বার্থে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হিসাববিদদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। শনিবার সনদধারী চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্টদের (সিএ) আঞ্চলিক সংগঠন সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন অব এ্যাকাউনটেন্টসের (সাফা) আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা হওয়া উচিত দেশের সমষ্টিগত স্বার্থ ও মঙ্গলের জন্য, শুধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়।’ পাবলিক ও কর্পোরেট খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তন আজ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে আমাদের বাজেটের আকার ছিল ৬৪ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা, যা ২০০৫-০৬ এর তুলনায় আট গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। তাই পাবলিক ও কর্পোরেট খাতে হিসাবের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আঞ্চলিক উন্ননয়নে পেশাজীবীদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ স্বল্প আয়তনের, কিন্তু জনবহুল। জনবহুল হলেও এ অঞ্চলের রয়েছে অপার সম্ভাবনাময় জনসম্পদ। এ অঞ্চলের উন্নয়নে চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্টদের মতো পেশাজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রতিও আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্টস অব বাংলাদেশের আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও উপস্থিত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে সাফার সভাপতি জগন মোহন রাও, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্টস অব বাংলাদেশের সভাপতি এ এফ নেছারউদ্দিন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
×