ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

মুক্তিবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণ ॥ ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১২, ১ ডিসেম্বর ২০১৯

 মুক্তিবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণ ॥ ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বুধবার। এই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকসেনারা পদে পদে মার খায়। সিলেটের কানাইঘাট সম্মুখ লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৩০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। জুড়ি, বড়লেখা এলাকা থেকে পাকবাহিনী কামান সরিয়ে ফেলে। মুক্তিবাহিনীর হাতে বিপুল ক্ষতির শিকার হয়ে পাকসেনারা কুলাউড়া থেকে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী সিলেটের শমসের নগরে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে। মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়ার দর্শনা আক্রমণ করে। শেষরাতে সিলেটের শমসের নগর ও কুষ্টিয়ার দর্শনা দখলের লড়াই শেষ পর্যায়ে পৌঁছে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকবাহিনী এলাকা থেকে পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী টেংরাটিলা ও দিয়ারাবাজার মুক্ত ঘোষণা করে। মুক্তিবাহিনীর অপারেশন অব্যাহত থাকায় পাকবাহিনী গাড়া, আলিরগাঁও, পিরোজপুর থেকে তাদের বাহিনী গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কুষ্টিয়ার কাছে মুন্সিগঞ্জ ও আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের মধ্যে মুক্তিসেনারা মাইন বিস্ফোরণের মাধ্যমে পাক সৈন্যবাহী ট্রেন ধ্বংস করে। এতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। সিলেটের ছাতক শহরে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৬৫ জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার মুক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কুমিল্লার কসবা রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৬০ জনের বেশি পাকসেনা নিহত হয়। রাতে কর্নেল শফিউল্লাহ, ২য় বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার মেজর মঈন, ১১ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার মেজর নাসিমের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেরানী, সিঙ্গারাইল, গৈরালসানী, রাজাপুর ও আজমপুর এলাকা শত্রুমুক্ত করে। যুদ্ধে ২৩ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং মুজিব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন খাঁ শহীদ হন। একদল পাকসেনা অতর্কিতে ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলস ঘিরে ফেলে এবং মিলের বিভিন্ন পদের ১০৪ জন নিরীহ নিরস্ত্র কর্মচারীকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। সাতক্ষীরা মহকুমার কালীগঞ্জ হানাদার মুক্ত হওয়ায় বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান, শ্রী ফণী মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ এমএনএ, অর্থ সচিব এ জামান, আইজি এম এ খালেক কালীগঞ্জে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিম ফ্রন্টে আক্রমণাত্মক ও পূর্ব ফ্রন্টে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, রাজশাহী ও যশোর জেলার ৬২টি থানা এবং নোয়াখালী জেলার সব চর এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে জনৈক সরকারী মুখপাত্র জানায়, অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার এখনও শেষ হয়নি। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের চারটি রণাঙ্গনে যে আক্রমণাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। জাগ্রত বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, কালিয়াকৈর থানার এক পরিত্যক্ত বাঙ্কারে ডিফেন্স নেয়ার সময় ৫ জন খানসেনা ভেতরে প্রবেশ করলে একটি বিষধর সাপের ছোবলে ৫ জনই প্রাণ হারায়। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন চালিয়ে ঢাকার দুজন মুসলিম লীগ কর্মীকে হত্যা করে। বাকি দুজনকে বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এএফপির এক খবরে প্রকাশ, ঢাকায় পিপলস পার্টির অফিস বোমা বিস্ফোরণের ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অফিস দুমাস আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো উদ্বোধন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে বক্তৃতাকালে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণের নির্দেশ দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণই সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান। তিনি ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সকল নিরস্ত্র মানুষকে ধ্বংস করা হবে এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। ইন্দিরা গান্ধী সরাসরি পাকিস্তানী বাহিনীকে বাংলাদেশ ছাড়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। বললেন, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী সেনার উপস্থিতি ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সে সময় তাঁর ইউরোপ-আমেরিকা সফরের বিষয়ে রাজ্যসভায় তিন ঘণ্টাব্যাপী বিতর্কের উত্তর দিতে গিয়ে ভারত নেত্রী বললেন, ভারত যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে, আর নয়। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের নিশ্চিহ্ন হতে দিতে পারি না। এই দিন স্বাধীন বাংলা বেতারের আহ্বান ছিল এই রকম- যাদের চক্ষু আছে এবং চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন, আজ তাঁদেরকে একবার বাংলাদেশের রণাঙ্গনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ করব। একবার চোখ খুলে দেখুন সংগ্রামী বীর যোদ্ধা বাঙালী যুবকগণ কিভাবে পশ্চিমা হানাদার পশুদের খতম করে ক্রমাগত জয়ের লক্ষ্য পানে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত দুর্দিনে পাকসেনাদের হাত থেকে দেশকে সম্পূর্ণ মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকগণ আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, বিক্রম, ধৈর্য এবং দেশপ্রেমের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার নিদর্শন একান্ত বিরল। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পাবার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নির্দেশে সামরিক বাহিনীর লোকেরা পুনরায় গ্রামবাসীদের হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার বর্বর অভিযান শুরু করেছে। গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরার কত যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ের এই গ্রামটিতে অন্তত ৮৭ জনকে সামরিক বাহিনীর লোকেরা হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশই যুবক। নারী এবং শিশুরাও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। রাঙ্গামাটি ব্যাপটিস্ট মিশনে হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে চার্লস আর হাউজার নামে একজন ধর্মযাজক এবং বহু বাঙালী সন্ন্যাসিনী নিহত হন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×