ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রামমোহন রায় লাইব্রেরী

অস্তিত্ব সঙ্কটে ঢাকার প্রথম পাঠাগার

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ৩০ নভেম্বর ২০১৯

  অস্তিত্ব সঙ্কটে ঢাকার প্রথম পাঠাগার

মনোয়ার হোসেন ॥ ইতিহাসের আলোকিত পথরেখাময় পুরনো সেই দিনের কথা। ১৮৭১ সাল। পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি। চার শ’ বছরের বেশি বয়সী শহরের ইতিহাস বলে, এটিই রাজধানী ঢাকার প্রথম পাঠাগার। রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দের স্মৃতিধন্য গ্রন্থাগারটি এখন ধুঁকছে অস্তিত্বের সঙ্কটে। দেয়ালে ধরেছে ফাটল। খসে পড়েছে পলেস্তারা। রয়েছে যে কোন সময় ভবনটি ধসে পড়ার শঙ্কা। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী পাঠাগারটির কপালে ঐতিহাসিক স্থাপনার স্বীকৃতি জুটলেও রুদ্ধ হয়ে আছে ধ্বংস বা বিলুপ্ত হওয়া থেকে উঠে দাঁড়ানোর পথ। সংস্কারের অভাবে মূল ভবন থেকে স্থানান্তরিত হওয়া নগরীর প্রথম লাইব্রেরিটি বর্তমানে প্রায় অচল হয়ে আছে। আইনী জটিলতায় থমকে আছে পাঠাগারটির মূল ভবনের সংস্কারের কাজ। সংস্কার না হওয়ার কারণে এক সময় হয়ত মাটির সঙ্গে মিশে যাবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষ্যবহ পাঠাগারটি। সংস্কারহীনতার নেপথ্যে আছে রাজউক, স্থাপত্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের উদ্যোগহীনতা। শতবর্ষ পেরিয়ে প্রায় দেড় শ’ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি। এরই মাঝে লাইব্রেরিটি পেরিয়েছে অজস্র্র প্রতিকূলতা ও সংঘাত। কালের বিবর্তনে এটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ধুলোর আস্তর জমেছে স্থানান্তরিত গ্রন্থাগারে থাকা বইয়ের পাতায়। বয়সের ভারে জরাজীর্ণ কিছু বইয়ের বাঁধাইও ছুটে যাচ্ছে। তবুও যেন পাঠকের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে পাঠাগারটি। উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে কর্তৃপক্ষের প্রাণান্ত চেষ্টায়ও পাঠক ফেরে না সেই পাঠাগারে। নেই গ্রন্থানুরাগীদের পদচারণা। অন্যদিকে পরিত্যক্ত তকমা নিয়ে কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে মূল ভবনটি। পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলকে পেছনে ফেলে পাটুয়াটুলীতে পৌঁছলে নজরে পড়বে বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃপক্ষই গড়ে তোলে রামমোহন রায় লাইব্রেরি। ১৮৭১ সালে ব্রাহ্ম সমাজের অন্তর্ভুক্ত আঙিনায় দ্বিতল ভবনে বিন্যস্ত হয় পাঠাগারটি। সেখানে এখন আর নেই পাঠাগারটি। স্থানান্তরিত হয়েছে মন্দিরের একটি কক্ষে। আর পাঠাগারের মূল ভবনের গায়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখাÑ ‘ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার আপাতত বন্ধ থাকিবে’। নেপথ্য ঘটনার সূত্রে জানা যায়, এক সময় রামমোহন রায় লাইব্রেরির মূল দ্বিতল ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। যে কোন সময় রাস্তার ওপর ধসে পড়তে পারে-এ আশঙ্কায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল সাতদিনের মধ্যে ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেয়। ২০০৫ সালে তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য ও ট্রাস্টি প্রাণেশ সমাদ্দার উচ্চ আদালতে রিট করে ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্তির আবেদন করেন। পাশাপাশি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে একই দাবি জানিয়ে আরেকটি আবেদন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ২০০৯ সালে এক প্রতিবেদনে বলে, পুরাকীর্তি আইনের আওতায় এ নিদর্শনাটি প্রাচীন কীর্তি হিসেবে গণ্য করা যায় না। কারণ, ভবনটির স্থাপত্যশৈলীতে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নেই। তাছাড়া ভবনটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণেরও উপযোগী নয়। তবে একইবছর অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন জানায়, রাজউকের করা ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকার ৯৩টি স্থাপনার মধ্যে আছে এই পাঠাগারটিও। সে কারণে রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া তালিকাভুক্ত স্থাপনার আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ ও পরিবর্ধন করা যাবে না। পাঠাগারটির অচল অবস্থা প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক রনবীর পাল রবির সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বললেন, রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটি ২০০৪ সালে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দেয়ায় বন্ধ হয়ে যায় পাঠাগারটি। দশ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৪ সালে স্থানান্তরিত ভবনে আবারও চালু হয় পাঠাগারটি। কিন্তু আগের সেই জৌলুস নেই পাঠাগারের। পাঠকের পদচারণা পড়ে না পাঠাগারে। কয়েক মাস লোক নিয়োগ দিয়ে চালানোর চেষ্টা করা হলেও পাঠক না পাওয়ায় আবারও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। এক অর্থে বর্তমানে পাঠাগারটি বন্ধই আছে। কেবলমাত্র বিশেষ প্রয়োজনে দরজা খোলে এই পাঠাগারের। কারও কোন গবেষণার কাজ কিংবা শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পাঠাগারে এলে সেটি খুলে দেয়া হয়। রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটি, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থাপত্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পাঠাগারের মূল ভবনের সংস্কারের আইনী জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নিলে বদলে যেত পরিস্থিতি। গ্রন্থাগারটির সংস্কারের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হলেও তাতে সাড়া মেলেনি।
×