ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর নিরাপত্তা নিজের শক্তিতে

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২৯ নভেম্বর ২০১৯

 নারীর নিরাপত্তা নিজের শক্তিতে

নারীর নিরাপত্তার অভাব এখন নিয়তই দৃশ্যমান। এ ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলারও নেই। কারণ সবাই অবগত আছেন বর্তমানে নারী সমাজের সঙ্কট এবং দুরবস্থার বিষয়টি। বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি শেষ অবধি সন্তানের কাছে থাকা নারীরা কোন না কোনভাবে স্বাধীনতা বর্জিত, অধিকারহীন এবং মানুষ হিসেবে অবমূল্যায়নের শিকার। ঘরের বাইরে পা দিয়ে কোন মেয়ে যখন বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় অংশীদারিত্ব স্পষ্ট করে তোলে সেখানেও থাকে হরেক রকম বঞ্চনা, নির্যাতন আর অশালীন অবস্থার শিকার, রাস্তাঘাটে, বড় বড় শপিং মলে এমন কি হল-হোস্টেলেও তাদের জীবন নির্বিঘ্ন আর নিশ্চিন্ত হতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। মধ্যযুগীয় বর্বরতায় কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়। মেয়েদের তেমন দুঃসহনীয় অবস্থায় হযরত মুহম্মদ (সা) এমন অমানবিক অপকর্মের যবনিকাপাতই শুধু ঘটাননি তার চেয়েও বেশি নারীকে সম্মানের শীর্ষ শিখরেও নিয়ে যান। দৃঢ় মনোবল ও আধ্যাত্ম শক্তির অপার মহিমায় ঘোষণা দিলেন- মায়ের পায়ের তলে সন্তানের বেহেশত। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় সাহাবীদের প্রশ্নের উত্তরে নির্দ্বিধায় বলেছিলেন- সন্তানের জন্য মায়ের বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। তবে বাবাকে তার মর্যাদা দিতে কসুর করেননি। সেই ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে সপ্তম শতকের কথা। তার পরেও নারীরা ইতিহাসের ক্রমযাত্রায় নির্যাতিত, অবহেলিত এবং নিগৃহীত হিসেবে সমাজে তার অবস্থাকে সব সময়ই চিহ্নিত করেছে। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও নারীরা যথার্থ অর্থে মুক্তির ছোঁয়া পেয়েছে কিনা তা বলা মুশকিল। কারণ এই মুক্তির বারতা যদি সিংহভাগ অংশকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে যথার্থ স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা কখনও অর্জন হয় না। নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। বিমান চালনা থেকে শুরু করে উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সূচকে মেয়েদের অংশগ্রহণ আজ তেমন হাতেগোনার অবস্থায় নেই। পাশাপাশি নৃশংস এবং বিধ্বংসী চিত্রও গণমাধ্যমের খবর হতে সময় লাগে না। চার পাশের অশুভ শক্তির অপছায়ায় নারীরা আজও মানবতার চরম বিপর্যয়ের শিকার। নারীকে মানুষ হিসেবে মনে না করার যে পশুবৃত্তি সেখান থেকেই তারা সব ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। নারীর প্রতি শারীরিক নির্যাতন যে মাত্রায় মহামারীর আকারে সমাজ ব্যবস্থার কিছু অংশকে অনবরত গ্রাস করে যাচ্ছে। এমন অনাকাক্সিক্ষত, চরম অমানবিকতার বলয় থেকে নিগৃহীতরা কি উপায়ে বের হয়ে আসতে পারে সেটা কঠোর নজরদারিতে ভাবার সময় এসে গেছে। কেন তারা প্রতিমুহূর্তে লাঞ্ছিত আর ধর্ষিত হচ্ছে? দুই বছরের শিশুও যে কেন রেহাই পাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। শুধু কি বেসামাল মানুষদের মনোবিকৃতি? নাকি অপরাধের শাস্তি না হওয়ার করুণ পরিণতি? আর নারীকে সুস্থ মানবিক বোধে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার চরম অপসংস্কার। মার্জিত আর শালীনতার আবরণে নিজেকে দৃশ্যমান করার পরও কিছু দুর্বৃত্তের অপশক্তি থেকে মেয়েরা নিজেদের রক্ষা করতেও ব্যর্থ হয়। এত বৃহত্তর সামাজিক বলয়ের অপসংস্কৃতির চরম বিকার। তার আগে ছোট্ট কন্যা সন্তানটি কি পায় নিজের পরিবারে তার অধিকার? এক পরিসংখ্যানে উঠে আসে মেয়েরা প্রথম নির্যাতিত হয় তাদের নিজের পরিবারে। ভাইয়ের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণে বোনটি থাকে সর্বদা সঙ্কুচিত আর বিড়ম্বিত। সব ধরনের অধিকারের ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানটি অনেকটাই পিছিয়ে থাকে। শুধু বিয়ের বেলায় সে থাকে ভাইটির চাইতেও অনেক আগানো। বালিকা বয়সেই তাকে বিয়ে দেয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সেখানে পুত্র সন্তানটিকে শিক্ষিত করার মানসিকতায় নিজেদের বৈষয়িক সম্পদকেও তুচ্ছ জ্ঞান করা হয়। প্রয়োজনে সর্বস্বান্ত হতে হয় ছেলেটিকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে। আর মেয়েটির বেলায় বাবা-মা শুধু বিয়ের কারণেই তা গচ্ছিত সম্পত্তিতে হাত দেয়। এমন চিত্র গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে। তথ্য-প্রযুক্তিতে সমাজ আধুনিক হলেও গণতানুগতিক প্রাচীন সংস্কারকে জিইয়ে রাখার কারণে পুত্র এবং কন্যা সন্তানের ফারাক এখনও সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। অবশ্য গত ১০ বছরে সে হার কমে এলেও সর্বগ্রাসী প্রকোপ এখনও বর্তমান। আর মূল শেকড়ের এসব অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব-বিরোধকে, নিশ্চিহ্ন করতে ব্যর্থ হলে নারীরা সহিংসতার বন্ধনজাল থেকে কোনভাবেই মুক্ত হবে না। শিক্ষায় সমান অধিকার অর্জন করে কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হয়ে নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়াতে না পারলে সার্বিক মুক্তি সুদূর পরাহত। এ মুহূর্তে সম্মিলিতভাবে মেয়েদের সেটাই করা জরুরী সেখানে তার যথার্থ মুক্তি নিহিত।
×