ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের কবিতার লোক

প্রকাশিত: ০৯:০০, ২৯ নভেম্বর ২০১৯

আমাদের কবিতার লোক

ষাটের দশকের নিরলস কবি রবিউল হুসাইনের কবিতায় ভিন্ন মাত্রা খেলা করে অনন্য রূপ নিয়ে। পয়ায়ে, পত্রে, ছন্দে, বিষয়ে, কল্পনার ছবিতে সে অভিন্ন রূপটি স্পষ্টত দেখা যায় খোলা চোখে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবকাঠামোর ব্যাস-ব্যাসার্ধ ব্যবচ্ছেদ করে কবি রবিউল হুসাইন তার কবিতার ভেতর দিয়ে এঁকেছেন সময়ের সফেদ শরীর। ব্যক্তিগত দেখা, অদেখা, অনুভূতির সারসংক্ষেপও তুলেছেন কবিতার গঠনে। ব্যক্তিজীবনের আশা-আকাক্সক্ষা, নিরাশা-হতাশা, পূর্ণতা-অপূর্ণতার যা আরক তা’ও ব্যক্ত করেছেন কবিতায়। কবিতায় কবি রবিউল হুসাইন নিজেই যেন তার জীবন-দর্শনের ফটোগ্রাফার। দীর্ঘ সময় অবলোকন, যাপন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির যোগ-বিয়োগের পরীক্ষক তিনি নিজেই। কবিতার খাতা কাটাছেঁড়া করে সময়ের, সমাজের, সংসারের, রাষ্ট্রের মুখ তিনি দেখিয়েছেন আত্মদৃষ্টির চোখ দিয়ে। যা দেখেছেন তা’ই টুকে রেখেছেন বৃত্তের সরল বন্ধনীতে। এই টুকে রাখাতে কবি রবিউল হুসাইনকে দেখা যায়-না শব্দের সাথে, বাক্যের সাথে বক্তব্যের সাথে সমঝতা করতে কখনো। যা সত্য, যা স্পষ্ট, যা ধ্রুব-তারার মতো জ্বলজ্বল উজ্বল অথবা যা অসত্যের চাপে মুখ থেতলে পড়ে আছে আড়ালে তার কথা তিনি বলেছেন উজান কন্ঠে। স্বজাতি, স্বগোত্র, স্বদেশের ত্রুটিকেও কবি রবিউল হুসাইন আদরনীয় হাতে লুকিয়ে রাখেননি বুক পকেটের ভাজে। যা ভাজপড়া তা সম্মুখে বাহির করে আপন হাতে চেষ্টা করেছেন নিভাজ করতে- সে স্বরটি তার কবিতায় পাওয়া যায় সর্ব-উঁচুতে। স্থাপত্যবিদ্যায় পটু এ কবি তার নকশার মতোই কবিতায় তৈরি করেছেন আলাদা নকশা। চালে, চলনে নিখুঁত এঁকেছেন বিষয়ের ভ্রু, বলার ঢঙ, কল্পনার অবয়ব, চিন্তার শিল্পীত প্রতিফলন। ‘‘নিশ্চিত হওয়ার কী প্রয়োজন/ যেখানে অনিশ্চয়তার এত আয়োজন/ বরং এই বিপদসঙ্কুলতায় দুলে দুলে/ ভেসে ভেসে উৎপাটিত হই সমূলে/ কোথাও স্থিরতা নেই, নেই কোনো নিজস্বতা/ নদীতে নৌকা ভাসে জলের কী স্বাধীনতা/ কুলুকুলু বয়ে চলে সেদিকে ঢালুভূমি/ দ্ইু দিকে সারি সারি বিবর্তনের উষর জমি/ পূর্ণ সতেজচ সর্বংসহা দু:খ-কষ্ট বহমান/ মাঝ মাঝে কিছু আনন্দ-সুখ ¤্রয়িমাণ/ এটাই অনেক পাওয়া, সমসূত্রে সময়বান্ধব/ অপমান দুর্ব্যবহার ব্যক্তিস্বাধীনতার তা-ব/ এভাবেই নাকি ব্যক্তিত্বের হাস্যকর সূচনা/ দূশ্যমান অর্থসম্পত্তি রক্ষায় এরূপ অবমাননা/ ক্ষমতাবানদের আগ্নেয়াস্ত্রের মতোই শব্দাস্ত্র। যুগে যুগে ব্যবহৃত হতে হতে এখন ব্রক্ষ্মাস্ত্র/ সুখ-দু:খও এখন শ্রেণিবিন্যাসে বহুবিভক্ত। যদিও হর্ষ বিষন্নতা যার যেমন একান্তই ব্যক্তিগত’’ (কবিতা: একান্তই ব্যক্তিগত)। ‘সুখ-দু:খও এখন শ্রেণিবিন্যাসে বহুবিভক্ত’ এই একটি পদের মধ্যে সমগ্র সমাজ, সমগ্র সংসার, সমগ্র ব্যবস্থা উঁকি দিয়ে আছে! বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের প্রয়োজনহীন ভাবেই বলা যায় কবি ভাবনার কত অতলে ডুব দিয়ে থাকতেন। তিনিও সাধারণ আট-দশজনের মতোই হাঁটতেন, চলতেন, বলতেন, দাঁড়াতেন, হাসতেন, খেলতেন কিন্তু এতসবের আড়ালে একান্ত নিজের ভেতরে যে এমন করে চিন্তা করতেন, মগ্ন থাকতেন তা তার কবিতার ভেতর প্রবেশ না করলে অনুমান করা দুষ্কর। পাঠ না করলে ধরা কঠিন। কবি রবিউল হুসাইন জলের উপড়ে ভাষা কোনো কচুরীপানা নন, জলের গভীরে ভেসে চলা এক-প্রকাশ মাছ। চোখ কান খোলা সমাজ সচেতন, দর্শনে বিজ্ঞ চিন্তক, কথনে পরিপাটি- সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ সুশীল। এ তার ব্যক্তিগত চরিত্র নয়- এ তার কবির চরিত্র, কবিতার চরিত্র, কবিতায় ব্যক্তিপ্রতিচ্ছায়ার চরিত্র। উক্ত কবিতার মনযোগী পাঠে যে চিত্রকল্প দেখা যায় তা কি ভিন দেশের, বিদেশী প্রেক্ষাপটের কোনো চিত্র! নাকি এ স্বভূমেরই অন্যপাশে রাখা সামাজিক প্রবহমানতায় বয়ে চলা কোনো চিত্র? এতো এক সত্যনিষ্ঠ ছবি। এ ছবি অন্য কারো হাতে হয়তো তৈরি হয়েছে অন্যভাবে, রবিউল হুসাইন তা তৈরি করেননি, তিনি তা নির্মাণ করেছেন আপন ভঙ্গিতে নিখুঁত নকশায়। এখানেই কবি রবিউল হুসাইন অন্য অনেকের চেয়ে ভিন্ন স্বরের-সুরের। নিভৃতচারী, নিশ্চুপ, একা পথ চলা এ কবিকে কেবল সমাজ অবক্ষয় আর ব্যবচ্ছেদের দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে থাকতে দেখা যায় না; কবিতায় তাকে দেখা যায় দেশমাতৃকার স্বাধীনতার স্বাধীনতা ভাবনায় নত, জড়োসড়ো, এক সাগর রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মুক্ত চিন্তায় ব্যস্ত- ‘‘আমাদের সুখগুলো বিষন্ন হলে দু:খগুলো হেসে ওঠে/ আনন্দরা অশ্রুসজল হলে বেদনারা পুলকিত বোধ করে/ বিখ্যাত ব্যক্তিগণ আরো খ্যাতি পান যাবতীয় খ্যাতি লোপ করে/ কুখ্যাতরা যাবতীয় কুকর্ম করে আরো কুখ্যাত হন এবং এভাবে/ অতিখ্যাতি লাভ করেন/ সম্মানীয়রা আরো সম্মানিত হন নিজেদের সম্মাান হারিয়ে/ অসম্মানীয়রা আরো অসম্মানিত হন সমাজে সম্মান অর্জন করে/ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি অন্যদের অপমানিত করে থাকেন হীনমন্যতায়/ নিজেদের তথাকথিত ব্যক্তিত্ব বাড়াতে/ আর বেচারা অন্যজনেরা তাদের দ্বারা ব্যক্তিত্ব হারিয়ে/ নিজেদের শুধু শুধু বিশিষ্ট ভাবেন/ নি:স্বতা নি:শূন্য খুব সবকিছু পেয়ে, পূর্ণতা পরিপূর্ণতা পায় সর্বস্ব হারিয়ে/ বিজয়ী জয়ী হয় অপরাজয়ে. পরাজয়ী হেরে যায় বিজয়ী হয়ে/ পরাধীনতা পরাধীন পরাধীনতায়/ স্বাধীনতা স্বাধীন স্বাধীনতায়।’’(কবিতা: স্বাধীনতা স্বাধীন স্বাধীনতায়)। তবে কি স্বাধীনতায় স্বাধীনতা নেই! স্বাধীনতায় স্বাধীনতা কি পরাধীন? স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে স্বাধীনতা বৃক্ষের ডালে, পালায়, শাখায়, বোটায়, বৃন্তে যে পোকার বাসা, পোকা কিলবিল করতে দেখা যায়, পোকাদের জয় উল্লাস শোনা যায়, বিজয়ী হবার আপ্রাণ চেষ্টার নূপূর নিক্কন অনুভব করা যায় সে বাঁশির অনাকাঙ্খিত সুরের কথা মজলিসে ময়দানে বলে বলে ক্লান্ত হবার পর কবি যখন দেখেন পোকার সংখ্যাধিক্য তখন প্রিয় স্বদেশের ভবিষ্যত কথায় শঙ্কিত কবি কবিতায় বলেন তার সে অশনি-সংকোচের কথা, স্বাধীনতা বিরোধীদের অগ্রসরতার কথা কবি কবিতায় তুলে ধরেন যেন কথার কন্ঠস্বর না হোক, কবিতার স্বর যেন সচেতনের হিম ঘুম ভাঙ্গায়। কথা যেন কবিতার মুঠোয় ভর করে পৌঁছে যায় সারা বাংলায়। কবির যুদ্ধ হাতাহাতিতে নয়, কবি কবিতায় যুদ্ধের রণ-আওয়াজ তোলেন, তার বাজনা ছড়িয়ে দেন আক্রান্ত উদ্যানে, শব্দ যুদ্ধ করে অপশব্দের সাথে, শক্তির সাথে। কবিতার কাছে হার মানে অপসংস্কৃতি, সে বিশ্বাস আর শক্তিতে বলিয়ান হয়েই কবি রচনা করেছেন এমন রচনা। কবির যুদ্ধ তো কবিতায়। কবি রবিউল হুসাইন দেশের জন্য, মাটির জন্য, মায়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য এমন করে যুদ্ধ করে গেছেন কবিতায়, কর্মে। পেশাগত উদ্যাণে প্রতিটি দালান, তোড়ন, হল-মহলের মতো চেছে-চেছে ছেনে-ছেনে প্রতিটি কবিতাও তিনি নিপুন হাতে নির্মাণ করেছেন পরম ভালোবাসার স্নেহে-যত্নে, আদরে- আহ্লাদে। কবির স্থাপত্য হয়তো সময়ে পরে ঝরে পড়বে আপনা ইচ্ছায় কিন্তু কবিতায় কবির যে নির্মাণ তা পাঠকের মনের-মন্দির থেকে দাগ কেটে থাকবে অনন্তের পথদিকে। সময় পাটাতনে কবিতা তো পড়া হয়, সব কবিতা পারে না জাগাতে। পারে না বোধের ছাদে ধপধপ আওয়াজ করতে। কবিতার আকালে কবিতা দেখাও যায়না খুব। কবিতার ঢঙে কথামালার সহজ, সরল, বাতাসের উপর হাওয়ার কথায় ঠাসা লাইন পাঠ করতে করতে বিতিষ্ণার সময়ে ষাটের এ কবিকে পাওয়া গেছে বিপরীত ডাঙ্গায়। কবিতা বলতে কথামালা নয়, কবিতারই আইনে কবিতা কবিতা করে তোলার মিছিলে অগ্রভাগের এ কবিকে দেখেছি নম্র ভদ্র আইন অমান্য না করা এক কবি। ধারা ভাঙ্গার কুমন্ত্রে কলুসিত যারা তাদের পাশ কেটে চলা এ কবির কবিতা নিয়মের মধ্যে থেকেই ধারা ভেঙ্গেছে আপন ধারাকে উৎরিয়ে, সে ধারায় ধরা পড়ে-না হযবরল, সেখানে ধরা দিয়েছে রূপ, রস, গন্ধের অমিয় সংলাপ। ‘‘ভালোবাসা দুই রকমের-/ মানোমিলনের আর মনোমালিন্যের/ বিয়েও এমনতরো হয়, প্রেমও/ অথবা হয় না, হলেও ভেঙ্গে যায় কখনো কখনো/ এমতো বিয়েও দুই ধরনের-/ মূলত মেয়েদের জন্যে বন্দোবস্তের/ এবং বসত্মাবন্দির পছন্দ থাকে না কোনো/ সাধারণত এই পুঁজিবাদী সামন্তচক্রে/ ভালোবাসা বা বিয়ে একটি উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষণতার/ সমাজতাত্ত্বিক ব্যবসা হিসেবে সেই আদিকাল থেকেই প্রচলিত/ এই পুরুষ দ্বার শাসিত সমাজে/ যৌবনে পৌঁছনো ছেলেমেয়েরা বাজারের পন্য হয়ে/ শরীরশান্ত্র অনুযায়ী বংশবিসত্মারী/ সমর্থতা অর্জন করে থাকে/ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অমোঘ প্রাকৃতিকতায়/ এই সময়েই বিপরীতধর্মী সঙ্গীদের প্রতি/ যে যৌন-আকর্ষণ তৈরি হয় সৃষ্টির প্রেক্ষেতে/ সেটাকেই ভালোবাসা বা প্রেম বলে/ প্রামাণিত এই বিশ্বসমাজ-সংসােের।/ ভালোবাসা বা বিয়ে বিষয়টি জীবনবীমাময়/ দৃশ্যমান শ্রী শ্রেণি ও সম্পত্তি-নির্ভর মনো-ব্যক্তিত্বতার ধূর্ত/ গণ ও গুণরঞ্জক ইহজাগতিকতায় প্রত্রিয়টি/ নতুন প্রজন্ম সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিক পালন করে আসছে সর্বজনীনতায়/ ভালোবাসা মানে পরস্পরেরা প্রতি সম্মানবোধ/ আর শ্রদ্ধাজাগানিয়ার পরস্পরা/ গাছে যেমন ফুল ফোটে , মনুষ্যবৃক্ষ তেমনি ভালোবাসা আর কবিতায়/ কবিতা সবসময় সত্যি কথা বলে/ ফুলেল সেই ভালোবাসায়।/ (কবিতা: কবিতা সবসময় সত্যিকথা বলে)। প্রতিটি লাইনে লাইনে কবিতার শিরোনামের মতোই সত্য উচ্চারিত। শুধু সত্য বললে একদিকে বলা হবে। এতো মনুষ্যজীবনের বাঁক নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা, গভীর চিন্তার অধ্যবসায়, সাধনার নিরিখে দৃষ্টির বিশালতায় সম্পর্কের প্রতি-ও-প্রান্ত চুলচেড়া অবলোকন। এখানেই কবি রবিউল হুসাইন প্রমাণ করেন কবি মানে কতগুলো কথা মাপা-কাঠামোর থরে থরে বসিয়ে দীর্ঘ জায়গা দখল নয়, কবিতা মানে অবলোকন, অবগাহন, অনুভবে অনুধাবন আর জীবন পরিক্রমায় সুপ্ত ব্যথা-বেদনা, মত-পথ, যুক্তি-তর্কের যুক্তিগত উপস্থাপন। সে চিন্তায়, সে ভাবনায়, সে কথায়, সে বলায় কবি রবিউল হুসাইন দার্শনিক মনোবৃত্তির মনোপুত কবি। তার কবিতায় সে উজ্জ্বল চিহ্নের ছায়া দেখা যায় পুন:পুন পাঠে। তিনি কবিতায় কথা লুকান না, বাক্যে অস্বচ্ছতা প্রকাশ করেন না, ঢেকে রাখেননা বিষয়ের ঘুঙুর। যা বলতে চান তা পরিস্কার করে বলেন সরল শব্দবিন্যাসে, অতিরঞ্জন আর অতি অলংকার ঠেসে-ধরে পাঠকের কাছে পান্ডিত্য প্রকাশের নেশায় হয়ে উঠেন না দৌড়বিদ। যা বলেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তা, তার সহজবোধ্য ভাষায় ও বর্ণনায়; তার কবিতা পাঠেই পাঠকের বোধগোম্য হবে কবিতার অন্তর্নিহিত লাবন্য। কবি রবিউল হুসাইন আগাগোড়ায় ছিলেন বাংলার বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের, মুক্তির স্বপক্ষের মহৎ প্রাণ। তার কবিতা পাঠ করলে, পাঠে বিশ্লেষনে বুঝার চেষ্টো করলে দেখা যায় তিনি মাটির জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য, একটি দেশের জন্য হেসেছেন, কেঁদেছেন, উদ্বেলিত হয়েছেন। বলিষ্ঠ স্বরে বলেছেন তার পক্ষের কথা, মুক্তি ও যুক্তির কথা। ‘‘স্বাধীনতা স্বাধীনতা/ মানে না অধীনতা/ বাঙালি যে মুক্ত/ স্বপ্ন নয় সুপ্ত/ বাস্তবে তার রূপ/ ফুটেছে কি অপরূপ/ চারদিকে অনাবিল/ সবুজ টিয়া ঘুঘু চিল/ চড়–ই শালিক উড়ে উড়ে/ গান গায় গলা ছেড়ে/ ছেলে মেয়ে হাত ধরে/ ঘুরে ঘুরে খেলা করে/ পিছু পিছু প্রজাপতির/ রঙিন পাখা ধরিত্রীর/ এমনি করে সারাদিন/ নেচে নেচে তাধিন ধিন/ বারে বারে আসুক ফিরে/ বাঙালিদের জীবন ঘিরে/ সুখ শান্তি জয় জয়/ স্বাধীনতা সব সময়/ বাংলাদেশের সত্তায়/ মিশে আছে আত্মায়।’’ ( ছড়া কবিতা: স্বাধীনতা)। কবি চিরদিন চেয়েছেন নানান বাঁক ধরে, নানান দিক ধরে, নানান পথ মতে এ দেশটায় স্বাধীনতা আসুক। এ দেশ, এ জাতি যে পরাধীনতা কোনো কালে মানে নি, মানে না তা ছন্দের অন্তমিলে বলেছেন হৃদয় নিংড়িয়ে। বাঙালির জীবন ঘিরে এ স্বাধীনতা যেন অশেষ হয়ে বিঁধে থাকে মঙ্গল-শুভাকাঙ্খে, বাঙালির আজীবনের কল্যাণে কবি তার কবিতায় নিবেদন করে গেছেন নির্মল মনের একনিষ্ঠ প্রার্থনায়। আবার তিনি সবুজ শ্যামল এদেশের কথা বলেছেন অন্য আরেক রকম করে। মা-মাটির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছেন ধীর লয়ের বাক্য বুননে- ‘‘ সব কিছু খুলে বলা ভালো নয় এত আর/ রেখে ঢেকে বলা মানে কিছু বলা যায় ঠিক/ প্রায় সবে তাই করে মেঘে মেঘে অন্য দিক/ অতি জলে ভাসে ভূমি আর শস্য ফল সার/. . .সে-ই ভোগে বেশি যার নেই কম কোনো ভুলে/ হালে সুদে হারে ফের কী-না বারে বারে ঘটে/ তাতে কিছু যায় আসে কি-বা হবে তার বটে/ মনে পড়ে পাতা নড়ে শ্যাম রাখি তবু কূলে/. . .তাপে পোড়ে পাপ পূণ্য অন্য ভূত ভাব বোধ/ শীতে ধরা থাকে সুখ হাস্য হর্ষ শুরু ষেশ/ দিকে দিকে সব দেখা য়ায় পালা যাত্রা বেশ/ ভাষা থেকে হয় শুরু এতে হয় সব শোধ/. . .পাখি মাছ নদী পলি মাটি পড়ে গৌড় দেশ/ চির দিন কাল যাবে বয়ে এই প্রতি বেশ।’’ ( কবিতা: পলি মাটি গড়ে গৌড় দেশ) সকল খেয়ালের মতো কবি মনেও খেয়াল হয়েছিল পৌঢ় বেলার, বিকালে সন্ধ্যালোর, মিটিমিটি তারার রাজ্যে একলা হয়ে যাবার ধবল রহস্যের কূলহীন, সীমাহীন, অসীম কালের কথা। সে কথা রহস্যের জালে আটকিয়ে কবি বলে গিয়েছেন আপন মনের যতকথা অথবা বলেছেন অন্য কোনো চিরায়ত সত্য সহজ। ‘‘বাঁকে বাঁকে খালে বিলে ছোট ছোট জলে ঢেউ কেন খেলা করে/ কেন ওঠে নামে কেন তারা হাতে হাতে ধরে সব কিছু নিয়ে/ যায় দূরে যেতে যেতে শুধু তারা দূরে যেতে থাকে যেতে যেতে/ কিছু ফিরে চায় তবু তারা এই ভাবে যেতে যেতে আর কত/ দূরে দূরে যাবে চির কাল সেই পথ পাড়ি দিলে পথ হারা/ হবে তাকি তারা জানে দূরে গেলে কেন তারা কাছে আসে ধীরে/ তারা আর কত দূর যাবে এই রাতে চলে যেতে যেতে দিনে/ বারে বারে ফিরে ফিরে চেয়ে চেয়ে সেই দিন কত দিন হবে/ সারা রাত জলে ভিজে ভিজে মেঘে মেঘে কত বেলা যায় চলে/ আর ফেরা হয় নাকি নদী কূলে কত বড় মাছ মাথা তুলে/ ইতি উতি চায় চোখে চোখে চোখ রাখে ওই পড়ে গাছে গাছে/ পাখি সব ওড়া উড়ি করে পাতা ধরে ঝুলে পড়ে ডালে ডালে/ আর কোন দিন দেখা হবে কিনা হবে কিবা নাও হতে পারে/ তবে সব শেষে চলে যেতে হবে দেখা হবে যদি চোখ দুটি/ ভালো থাকে তবে ঠিক চলে যেতে হবে সেটা কেন কবে কোন/ দিনে বলা যয় কিবা এক থালা ভরে আদা নুন ঝাল মুড়ি/ নেড়ে নেড়ে ভেজে ভেজে মনে মনে কত কথা কি’যে ধরা পড়ে/ তার পরে ধীরে ধীরে তারা সব একে একে কাছে এসে বলে/ যাই তবে চলে যাই ডুবে ডুবে বহু দূরে এত পথ নিয়ে/ কিছু নেই সাথে সাথে তবু তাকে যেতে হবে যেতে যেতে দূরে/ এক দিন তারা ঘর ছাড়া হবে তাকি তারা জানে কিনা জানে/ বারে বারে কাছে আসা ফিরে ফিরে দূরে থাকা আর কত গত/ ভোর বেলা সাঁঝ রাতে সুখে দুখে বারে বারে ফিরে ফিরে. . .’’ (কবিতা: বারে বারে ফিরে ফিরে)। একি শুধু বারে বারে ফিরে ফিরে আসা যাওয়া, নাকি অন্য আরেক কিছু! কবির করটির ভেতর সে ভাবনা ঘোরে, কবিকে ভাবায়- আর কত কাল, আর কত কাল! ভালো থাকে, তবে ঠিক চলে যেতে হবে, সেটা কেন কবে কোন দিনে বলা যায় কিবা, এক থালা ভরে আদা নূন ঝাল মুড়ি! তবে সব শেষে চলে যেতে হবে, দেখা হবে যদি চোখ দুটি ভালো থাকে। কোথায় চলে যেতে হবে? আবার কোথায় দেখা হবে যদি চোখ দুটি ভালো থাকে? কবি এ-কি মরন চিন্তাকে শব্দের বাক্যের ছন্দের দোলায় দোলন দিলেন নাকি ঘুরে ফিরে আমাদের এক ও অভিন্নতার কথাই বললেন! মানুষ মাত্রই তো একাত্মা, এক প্রাণ, এক দেহ; সে দেহ, মন, প্রাণ কখনো কখনো লোভে লালসায় লিপ্সায় ভিন্ন হয়ে পড়ে, ভিন্নতায় একে অন্যের বিরুদ্ধে পাহাড় সমান উঁচু হয়ে দাঁড়ায় আপদ হয়ে। হিংসায় বিদ্ধেষে রক্ত ঝড়ায় আপন বংশের বাহু থেকে। কবি কি এ কথাই বলতে চেয়েছেন? কোন্ কথা তা আউড় করা যায়না, শুধু দেখা যায় পিাটহীন প্রলেপ, মুছনি। রাজমিস্ত্রী যেমন কাজের শেষে মেঝেতে গেরাটিন লেপে, মুছে মেঝ’কে চকচকে কালো করে অসামান্য মসৃণ রূপ দিয়ে বিদায় নেন মনিবের আঙুল থেকে পাওয়াটুকু বুঝে পেয়ে, কবিও তেমন যেন তার কবিতায় স্বচছ কথার গাঁথুনি বসিয়ে অপার রহস্যের মসৃণ লেপন দিয়ে জাগতিন লেনদেনের হিসাব চুকিয়ে জগত মনিবের হাত থেকে পাওনাদি বুঝে নিয়ে অবশেষে বিদায় নিলেন ঐহ্যিক এই কবিতার মায়া-ময়দান থেকে। কবি যেখানেই থাকেন, যেভাবেই থাকেন তিনি যেন ভালো থাকেন; এই আমাদের কবির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×