ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অনুপম আদর্শ প্রিয়নবী (সা.)

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ২৯ নভেম্বর ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অনুপম আদর্শ প্রিয়নবী (সা.)

প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পৃথিবীতে তশরিফ আনেন সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য, সমগ্র বিশ্বজগতের কল্যাণের জন্য। মূলত তাঁর নূর মুবারক সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তামাম কায়েনাত-সমগ্র সৃষ্টির সূচনা করেন। নূরে মুজাসসামের মাটির পৃথিবীতে আশরাফুল মাখলুকাত মানব সুরতে তশরিফ আনার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটে। তাঁর নূর মুবারক সৃষ্টি করে আল্লাহ জাল্লা শানুহু সৃষ্টির সূচনা করেন। মূলত তাঁর নূর মুবারকই সমগ্র সৃষ্টির উৎস। তাঁর থেকেই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন খালিক-মালিক আল্লাহ। তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন- বিশ্বজগতের জন্য রহমত। তাঁর মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ-অনুপম আদর্শ। কবি শেখ সাদী (র.)-এর ভাষায় : ‘হাসুনাত জামি’উ খিসালিহি’। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে অনুপম আদর্শ।’ (সূরা আহ্জাব : আয়াত ২১) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পৃথিবীতে তশরিফ আনলেন এমন এক যুগকালে, যখন সমগ্র পৃথিবীতে মানবতা ধুঁকে ধুঁকে মরছিল, অজ্ঞতা আর শিরক-কুফরে সারা পৃথিবী ছেয়ে গিয়েছিল। আইয়ামে জাহিলিয়াতের সেই ঘনকালো অমানিশা দূর করতে, মানবতাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে, সত্য-সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি এলেন মুক্তিদাতা হিসেবে। তিনি রাউফুর রাহিম, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর নিজের গুণে তাঁকে গুণান্বিত করেছেন। প্রিয়নবী (সা) সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ‘অবশ্যই তোমাদের মাঝ থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছেন। তোমাদের যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য খুবই কষ্টের হয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি অত্যন্ত স্নেহশীল পরম দয়ালু।’ তাঁর আবির্ভাব হলো এমন এককালে যখন অজ্ঞতা আর অন্ধকারে নিমজ্জিত পৃথিবীর মানুষ ধর্মহীনতা ও অধর্মের বিষবাষ্পে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নিপতিত। পৃথিবীর মানুষ, শিরক্, কুফর, কুসংস্কার আর মস্তিষ্কজাত অন্ধবিশ্বাসের বিষাক্ত ছোঁবলে জর্জরিত। পৃথিবীর মানুষ পথভ্রষ্টতার নিকষকালো অন্ধকারে দিশাহারা। পশুত্ব আর লোলুপতার শেকলে বিপর্যস্ত পৃথিবীর মানুষ এক করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছিল। আশরাফুল মাখলুকাত বনী আদম আল্লাহকে ভুলে গিয়ে কল্পিত দেব-দেবীর পূজা করে, গাছ পূজা করে, পাথর পূজা করে, সূর্য, পাহাড় এমনকি পুরোহিতদেরও পূজা করে। ত্রিত্ববাদ ও বহুত্ববাদের আবর্তে নিপতিত হয়ে মানবিক মূল্যবোধ পৃথিবী থেকে উঠে গেছে। সত্য বলতে কোথাও কিছু নেই, সততা বলতে কোথাও কিছু নেই, মনুষ্যত্ব নেই, ন্যায়-নীতি নেই, ন্যায়বিচার নেই, দয়া-মায়া বলতে কোথাও কিছু নেই। ক্রীতদাস প্রথা, নারী নির্যাতন, যুলুম-অত্যাচার বিশ্বকে কুরে কুরে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল। পৃথিবীর সর্বত্র তখন নৈরাজ্য, নৈরাশ্যের বিষণ্ণতা ছায়া ফেলে। সামন্তবাদ, প্রভুত্ববাদ, আধিপত্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং রাজতন্ত্রের শৃঙ্খলে পৃথিবীর প্রায় আটানব্বই ভাগ মানুষ বন্দী দশায় কোনমতে বেঁচে আছে। তাঁর আবির্ভাবে পৃথিবী আলোর সন্ধান পেল, শান্তির সন্ধান পেল, মুক্তির সন্ধান পেল। তিনি তো আলোর আলো। তাঁর এই পৃথিবীতে তশরিফ আনার ফলে শিরক ও কুফরের ভিত্তি ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়, মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি আর হিংস্রতার পৃথিবীতে নেমে আসে শান্তির হাওয়া, সত্য-সুন্দর ও মানবতার বিজয় বারতা ঘোষিত হয়। ঘোষিত হয়- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ- আল্লাহ্ ছাড়া নেই কোন ইলাহ্ হযরত মুহম্মদ (সা) আল্লাহর রসূল। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীব সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতামুন্নাবীয়ীন রহমাতুল্লিল ‘আলামীন শাফিউল মুযনিবীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা আহমদ মুজতবা (সা)-কে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন তাঁর মনোনীত পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য। আর সেই আল্লাহর দেয়া একমাত্র জীবন ব্যবস্থাই হচ্ছে ইসলাম। এই জীবন ব্যবস্থাই দুনিয়ার কল্যাণ বয়ে আনে, আখিরাতের কল্যাণ বয়ে আনে, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে, আল্লাহর রবুবিয়্যাত কায়েম করে। এটাই আদ্দীনুল হক, এটাই আস্সিরাতুল মুস্তাকীম। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘তিনি (আল্লাহ্) যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন অপর সমস্ত ধর্ম-এর ওপর বিজয়ী করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট (সূরা ফাত্হ : আয়াত ২৮)।’ প্রিয়নবী (সা) এর মহান আখ্লাকে সমস্ত গুণের সমাবেশ ঘটেছে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেন : ‘আর আপনি অবশ্যই সুমহান আখ্লাকের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত’ (সূরা কলম : ৪)। একবার এক সাহাবী উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর কাছে প্রিয়নবী (সা) এর আখ্লাক সম্পর্কে জানতে চাইলে হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা) বললেন : কুরআন মজীদই তাঁর আখ্লাক। হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা) এর এই একটি ছোট্ট উক্তির মধ্যে প্রিয়নবী (সা) এর মহান জীবনাদর্শের সার্বিক চেহারা প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘মহান আখ্লাকসমূহ পূর্ণভাবে বিকশিত করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে।’ কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘আল্লাহর নিকট হতে এক নূর ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এর দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান (সূরা মায়িদা : আয়াত ১৫-১৬)।’ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর আখ্লাক, তাঁর জীবনাদর্শ আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুই গড়ে তুলেছেন। তিনি যা কিছু বলেছেন তা সবই আল্লাহ্ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে বলেছেন এবং তিনি যা কিছু করেছেন তা সবই আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের জন্য করেছেন। আল্লাহ্ তাঁকে যা করতে আদেশ করেছেন তিনি তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করেছেন, যা করতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু নিষেধ করেছেন তা আদৌ করেননি। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নির্দেশ মোতাবেকই তিনি মানুষের সামনে হিদায়াতের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং মানুষকে সত্য ও সুন্দর পথের দিশা দান করেছেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘এবং তিনি নিজের থেকে কিছুই বলেন না, তাঁর কাছে যে ওহী আসে তিনি সেই ওহীই বলেন।’ তিনি মহান আখ্লাকসমূহকে নিজে যেমন আমল দ্বারা পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করেছেন, তেমনি তাঁর সাহাবীগণ তাঁকে হুবহু অনুসরণ ও অনুকরণ করে সেই মহান আখ্লাকের গতিধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যার প্রবাহ যুগে যুগে শ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শরূপে গতি সঞ্চারিত করে আসছে। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ- ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই, মুহম্মদ (সা) আল্লাহর রসূল’- কালেমা তায়্যেবার এই চিরন্তন সত্য তাঁর জীবনাদর্শের মূল চেতনা, তাওহীদ ও রিসালতের সুদৃঢ় বুনিয়াদের ওপর তা সংস্থাপিত। সে জীবনাদর্শের সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত বিধানের সমুজ্জ্বল ধারা মানবিক মূল্যবোধকে বুলন্দ করেছে, আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সুনিবিড় করে দিয়েছে। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×