ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সারতাজ আলিম

দ্য ইমিটেশন গেম

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

  দ্য ইমিটেশন গেম

বাংলাদেশেরই একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। ১৯৭১-এর আগস্ট মাস। সারাদেশে গেরিলা যুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পাক বাহিনীর এক ওয়্যারলেস বার্তায় আঁড়িপাতে মুক্তিবাহিনী। বিস্তারিত খবর পেতে ঢাকায় যায় মুক্তিবাহিনীর এক গুপ্তচর। জানা যায় কয়েকদিন পরেই যমুনার ওপর দিয়ে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ যাবে। উত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে মার খেতে থাকা পাকবাহিনী যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে তাই এত অস্ত্র পাঠানো। সপ্তাহখানেক পর যমুনার ওপর দিয়ে যাওয়া জাহাজের বহর হলো কাদেরিয়া বাহিনীর শিকার। কোটি কোটি টাকার অস্ত্র দখলে নেয় তারা। যুদ্ধের ময়দানে সময়ের সেরা প্রযুক্তির কোন অস্ত্র বা দুর্দান্ত কোন জেনারেলের চেয়েও বড় অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় ‘ইন্টেলিজেন্স’ বা শত্রুপক্ষের খবর। শত্রুপক্ষের হাঁড়ির খবর জেনে সময়মতো আঘাত কর। এই ইন্টেলিজেন্সের কল্যাণেই ৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল একাই আরব রাষ্ট্রগুলোকে ৬ দিনেই পরাজিত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ঘটনা। বিশ্বযুদ্ধের সময় এত প্রচেষ্টার পরও যে ফ্রান্সকে জার্মানি দখল করতে পারেনি সেই ফ্রান্সকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কয়েকদিনে দখল করে নেয় জার্মানি। আশপাশের ছোট বড় অনেক রাষ্ট্রই হিটলারের পদতলে। প্যানজারের মতো ট্যাংক আর রোমেলের মতো জেনারেলদের ওপর ভর করে জার্মানরা একটার পর একটা জয় আনছে। যুদ্ধের ময়দানে যোজন যোজন এগিয়ে দিচ্ছে জার্মানদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। তবে প্যানজার, টাইগার ট্যাংকের চেয়েও মিত্রবাহিনীর বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায় জার্মানদের ২৬ পাউন্ডের একটা যন্ত্র। জাদুর এই বাক্সটি জার্মানদের সব মেসেজকে এনক্রিপটেড করে দিচ্ছে। মিত্রবাহিনীর গোয়েন্দারা প্রতিদিন হাজার হাজার জার্মান বার্তা ইন্টারসেপ্ট করছেন। কিন্তু এলোমেলো কিছু অক্ষর ছাড়া সেগুলো কিছুই না। নির্দিষ্ট কোড দিলেই এলোমেলো অক্ষরগুলো মূল অক্ষরে ফেরত আসবে। এনক্রিপশনের ব্যবহার রোমান সিজার সময় থেকে থাকলেও জার্মানরা এনক্রিপশনকে ভীষণ রকম জটিল পর্যায়ে নিয়ে যায়। এনিগমা নামের যন্ত্রটিতে ১৫৮, ৯৬২, ৫৫৫, ২১৭, ৮২৬, ৩৬০,০০০ রকম কম্বিনেশন ছিল অর্থাৎ যন্ত্রটি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এতভাবে একটি শব্দকে লিখতে পারত। ব্রিটিশ সরকার মরিয়া হয়ে উঠে। এনক্রিপশন ভাঙতে হবে। একদল প্রোগ্রামার-গণিতবিদ দায়িত্ব পায়। প্রতিদিনে হাজার হাজার কাগজে লিখে কোন এক জাদুর সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি কিন্তু দিন শেষে কাগজগুলোর গন্তব্য হচ্ছে ময়লার বিনে। এরই মধ্যে স্রোতের বিপরীতে গা ভাসান দলের একজন। তার কথা একটা যন্ত্রই পারবে আরেকটা যন্ত্রকে পরাস্ত করতে। রীতিমতো যুদ্ধে নামেন তিনি। এনক্রিপশন ভাঙতে না, আগে নিজের আইডিয়া বাঁচাতে। বাকি গল্প সবার জানা। যুদ্ধে যে সৈন্য ছাড়াও আরও অসংখ্য মানুষের অবদান থাকে এবং সেই অবদানের বিনিময়ে তারা তেমন কিছুই পান না সেটা প্রচণ্ডভাবে অনুভব করা যায় এই সিনেমা থেকে। স্রোতের বিপরীতে যাওয়া সেই গণিতবিদ ছিলেন এ্যালান টিউরিং, আধুনিক কম্পিউটারেও যার ভূমিকা অনেক। কিন্তু এনিগমা ভাঙ্গার দারুণ এই উদ্ভাবন থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। ইন্টেলিজেন্সের নিয়মই যে এটা! প্রতিপক্ষের হাঁড়ির খবর জানলেও কিছু না জানার ভান ধরে থাকতে হবে! বিশেষজ্ঞদের মতে এনিগমা ভাঙ্গার ফলে জার্মানদের অন্তত ২ বছর আগে পরাস্ত করা সম্ভব হয়। এতবড় ব্রেকথ্রুরু“এনে দেয়ার পরেও এ্যালান টিউরিংকে সমকামিতার অভিযোগে দণ্ড দেয় সরকার। পরে একাকীত্ব বিষণ্ণতা থেকে তিনি আত্মহত্যা করেন। এটা প্রায় স্বীকৃত সত্য যে, প্রচণ্ড মেধাবীরা একাকী হয়। বেশিরভাগ সময় তারা অন্যদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। ছোটবেলা থেকেই বরং মশকরার পাত্র। হতে হয়। টিউরিংও ছিলেন তেমন একজন। দ্য ইমিটেশন গেম সিনেমায় এনিগমা ভাঙ্গা এবং পেছনের গল্প এ্যালান টিউরিং এর জীবনের গল্প চিত্রায়িত করা হয়েছে। টিউরিং চরিত্রে অভিনয় করেছেন কালজয়ী অভিনেতা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ। ইতিহাসনির্ভর সিনেমায় দর্শকদের জানা থাকে শেষটা কি হবে। কিন্তু শেষ দৃশ্য জানা থাকার পরেও এক মুহূর্তের জন্যও সিনেমাটি তার আকর্ষণ হারায়নি। দর্শকের মন নাড়িয়ে দেয়া সিনেমাটি বিশ্বজুড়ে ২৩৩ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
×