ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে রায়ের শেষ মুহূর্তের সংশোধনী

পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পূর্ণাঙ্গ রায় যে কোন দিন

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

 পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পূর্ণাঙ্গ রায় যে কোন দিন

বিকাশ দত্ত ॥ বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাযজ্ঞ বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। পূর্ণাঙ্গ রায় মোটামুটি প্রস্তুত। এখন রায়ের কারেকশন (সংশোধনী) চলছে। যে কোন সময় পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হতে পারে। রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবী সূত্রে এ খবর জানা গেছে। আসামিসংখ্যার দিক থেকে এটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। দুই বছর আগে ’১৭ সালের ২৭ নবেম্বর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জনের মধ্যে বিডিআরের তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলমসহ ১৩৯ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। এছাড়া আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপীল আংশিক গ্রহণ করে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন দন্ড দেয়া হয়েছে। দুজনকে ১৩ বছর সাজা দেয়া হয়েছে ১০ বছর ১২ জনকে সাত বছর চারজনসহ তিন বছর মোট দুই শ’ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দন্ড দেয়া হয়। সাজা থেকে খালাস পায় ৪৯ জন। বিচারপতি শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশিষ্ট বিশেষ (বৃহত্তর) বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার। ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আশা করছি শীঘ্রই চাঞ্চল্যকর এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবে। বর্তমানে রায়ে সংশোধনীর কাজ চলছে। এটি একটি বড় জাজমেন্ট। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগে বিচারপতিরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছেন। তিনি আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর আপীল বিভাগে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপীল করতে পারবে। এরপর আপীলের বিচার প্রক্রিয়া চলবে। বিচার শেষ হওয়ার পর রিভিউয়ের সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করতে পারবে। রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষার আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে আসামিদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরে আর কোন বাধা থাকবে না। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি রায় লেখা শেষ হয়েছে। এও জানতে পেরেছি মোট ২৮ হাজার পৃষ্ঠার জাজমেন্ট হতে পারে। আশা করছি যে কোন সময় বিডিআর পিলখানা হত্যা ১৫ মামলার পূর্ণাঙ্গ জাজমেন্ট প্রকাশিত হবে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিতের পর নকল পাওয়ার দিন থেকে সংবিধানের ১০৩ ধারামতে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করা হবে। আসামি সংখ্যার দিক থেকে এটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ওই হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। ’১৩ সালের ৫ নবেম্বর পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দফতরে বিদ্রোহের ঘটনায় সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ আসামির ফাঁসির রায় দেয় বিচারিক আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোঃ আখতারুজ্জামান বকশিবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়া বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমসহ (৫৫) বাহিনীর ১৫২ জওয়ান ও নন-কমিশন্ড কর্মকর্তার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয় রায়ে। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এ মামলার সাড়ে আট শ’ আসামির মধ্যে জীবিত আছেন ৮৪৬। তাদের মধ্যে ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীকে যাবজ্জীবন দন্ড দেয় আদালত। তাদের দুজনকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও পাঁচ বছর কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছিলেন বিচারক। নাসির উদ্দিন পিন্টু কারাগারে থাকাকালে মারা যান। ১৬১ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের পাশাপাশি অস্ত্র লুটের দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদন্ড এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। তাদের পর্যায়ক্রমে এই সাজা খাটতে হবে। এ ছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দেয়া হয়। কারও কারও সাজা হয়েছে একাধিক ধারায়। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেন বিচারক। বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ঘটনায় প্রথমে লালবাগ থানায় মামলা হয়। পরে তা স্থানান্তরিত হয় নিউমার্কেট থানায়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সিআইডি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেয়ায় দুই অভিযোগের আলাদাভাবে বিচার শুরু হয়। হত্যার ঘটনায় অভিযোগপত্র দেয়া হয় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। ’১১ সালের ৫ জানুয়ারি হত্য মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন ঢাকার বিশেষ জজ জহুরুল হক। বছরের ২৪ আগস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। পরে এ মামলার দায়িত্ব পান মোঃ আখতারুজ্জামান। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাবেক ও বর্তমান সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা, পুলিশের সাবেক ও বর্তমান আইজি, বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ১ হাজার ৩৪৫ জনকে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী করা হলেও শেষ পর্যন্ত ৬৫৪ জন আদালতে জবানবন্দী দেন। ’১৫ সালের ৪ জানুয়ারি সব ডেথ রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপীলের শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চটি গঠন করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন। পরদিন ৫ জানুয়ারি বিশেষ বেঞ্চ বসে ১৮ জানুয়ারি শুনানি শুরুর দিন ধার্য করেন। ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে বিচারপতি শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানি শুরু হয়ে গত ১৩ এপ্রিল ৩৭০ কার্যদিবসে শেষ হয়।
×