ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাত জঙ্গীর মৃত্যুদন্ড ॥ হলি আর্টিজান মামলার রায় ॥ দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

সাত জঙ্গীর মৃত্যুদন্ড ॥ হলি আর্টিজান মামলার রায় ॥ দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার

শংকর কুমার দে/ফরিদা ইয়াসমীন জেসি ॥ দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বহুল আলোচিত গুলশান হলি আর্টিজান হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেছে আদালত। বুধবার আদালতে জনাকীর্ণ রায়ে মামলায় অভিযুক্ত জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির ৮ আসামির মধ্যে ৭ জনকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন বিচারক। রায়ে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রেখে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয় সাত আসামিকে। খালাস দেয়া হয়েছে নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে। আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেয়ার রায় শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান। মামলার একটি ধারায় মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি তাদের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড দেয়া হয়। আরও দুটি ধারায় তাদের কয়েকজনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড। এর মধ্যে ৬ আসামি দিয়েছেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। মামলায় ১১৩ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। মামলার অভিযোগপত্রে আসামি ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন মারা যাওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়। নিহত ১৩ জনের মধ্যে ৮ জন বিভিন্ন অভিযানের সময় নিহত হয়। জঙ্গী হামলাকারী ৫ জনের সবাই ঘটনাস্থলে নিহত হয়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে বুধবার সকালে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতে আনা হয় আসামিদের। বেলা বারোটায় রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। এ সময় আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিল সব আসামি। আসামিদের আদালতে আনা নেয়ার সময়ে কোন অনুশোচনা দেখা যায়নি। উল্টো আসামিদের হাসি মুখে আঙ্গুল উঁচিয়ে জঙ্গী সংগঠনের পক্ষে স্লোগান দিতে দেখা যায়। রায় শুনে আসামিদের একজন উচ্চস্বরে বলতে থাকে, ‘আল্লাহু আকবর, আমরা কোন অন্যায় করিনি।’ আদালতের রায়ে যাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে তারা হচ্ছে নব্য জেএমবির মূল সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ, ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ। গত ১৭ নবেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য এ তারিখ নির্ধারণ করেন বিচারক। মামলায় ১১৩ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তিন বছর আগে ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গী হামলায় ২২ জনকে হত্যার দায়ে নব্য জেএমবির সাত সদস্যের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটসের (আইএস) মতাদর্শী উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল তরুণের ওই আত্মঘাতী হামলা বাংলাদেশকে বদলে দিয়ে জঙ্গীবাদের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেদিন দেখা যায় কেবল মাদ্রাসা পড়ুয়া গরিব ঘরের ছেলেরা নয়, নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া ধনী পরিবারের সন্তানরাও বাড়ি থেকে পালিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে জঙ্গীবাদের ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়িয়েছে। বিচারকের রায়ে যা বলা হয় বিচারক মজিবুর রহমান তার রায়ে বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা জঙ্গীবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোন অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সাত আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রেখে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয় রায়ে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, বাংলাদেশ তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকান্ড ঘটায়। নিরপরাধ দেশী-বিদেশী মানুষ যখন রাতের খাবার খেতে হলি আর্টিজানে যায়, তখনই আকস্মিকভাবে তাদের ওপর নেমে আসে জঙ্গীবাদের ভয়াল রূপ। জঙ্গীরা শিশুদের সামনে এ হতাকান্ড চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য জঙ্গীরা নিথর দেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় হলি আর্টিজান বেকারি। কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় সাত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিচারক রায়ে বলেন, তাতে ভাগ্যহত মানুষের স্বজনেরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। আসামিদের দন্ডাদেশ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এর ৬(২)(অ) ধারায় জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড দেয়া হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৭ ধারায় জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অনাদায়ে আরও দুই বছরের সাজা দেয়া হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৮ ধারায় জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন, আব্দুস সবুর খান, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদকে ৬ মাসের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৮/৯ ধারা জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন, আব্দুস সবুর খান, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ রিপন ৫ বছরের কারাদন্ড, ১০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড, অনাদায়ে আরও ১ বছরের সাজা দেয়া হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এর ৬(২)(অ) ধারার অভিযোগ থেকে আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, ৭ ধারার অভিযোগ থেকে মামুনুর রশিদ রিপন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১০, ১১, ১২, ১৩ ধারার অভিযোগ থেকে আসামিদের সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত। রায়ে দন্ডিত আসামিদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকরের অনুমতির জন্য রায় ও মামলার নথিত হাইকোর্ট বিভাগে পাঠাতে বলেন বিচারক। শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গী হামলা গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের তীরে হলি আর্টিজান বেকারির সবুজ লন ছিল বিদেশীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। বিদেশীদের নিয়মিত আনাগোনা এবং শিথিল নিরাপত্তার কারণেই ওই রেস্তরাঁকে জঙ্গীরা হামলার জন্য বেছে নিয়েছিল বলে তদন্তকারীদের ধারণা। রোজার ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যেদিন ওই হামলা হয়, সেদিন ছিল শুক্রবার। পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে পাঁচ তরুণ রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই ক্যাফেতে ঢুকে শুরু করে নৃশংসতা। জবাই ও গুলি করে ১৭ বিদেশী নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে তারা। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযানের সময় ও পরে হাসপাতালে মারা যায় হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারী। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই হামলার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে চলে আসে। তখনও অনেকে হলি আর্টিজানের ভেতরে কার্যত জিম্মি হয়ে ছিলেন। শ্বাসরুদ্ধকর রাত পেরিয়ে ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা নামে অভিযানে। ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের সেই অভিযানে হামলায় সরাসরি অংশ নেয়া পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়ে। ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় মোট ১৩ জনকে। এরপর দুই বছরে হামলায় জড়িত আরও অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। গুলশান হামলার তদন্তে মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও তাদের মধ্যে জীবিত অবস্থায় গ্রেফতার আটজনকেই কেবল বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়। সেদিনের জঙ্গী হামলার ঘটনা জঙ্গী হামলা হয় : ১ জুলাই, ২০১৬, রাত পৌনে ৯টা। হামলার ঘটনাস্থল : গুলশান দুই নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর বাড়ির হলি আর্টিজান বেকারি। হামলাকারী : মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাজ ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। (সবাই অভিযানে নিহত)। বন্দুকযুদ্ধে নিহতরা : দেশের বিভিন্ন স্থানের জঙ্গী আস্তানায় অভিযান পরিচালনার সময়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ৮ আসামি। নিহতরা হলো তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান। জঙ্গীদের হামলায় নিহত : বিদেশীদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানী, একজন ভারতীয় নিহত হন। নিহত বাংলাদেশীরা হলেন ইশরাত আকন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও অবিন্ত কবীর। নিহত পুলিশ কর্মকর্তা : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম এবং বনানী থানার ওসি মোঃ সালাহউদ্দিন খান। জীবিত উদ্ধার : ভোরে কমান্ডো অভিযান শেষে জীবিত উদ্ধার করা হয় নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে। মামলা দায়ের : ২০১৬ সালের ২ জুলাই, সন্ত্রাস দমন আইনে, গুলশান থানায়। মামলার এজাহারকারী : গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস। তদন্তকারী অফিসার (আইও) : কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। জিজ্ঞাসাবাদ : জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পরে আসামি করা হয়নি। অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল : ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই। হামলায় জড়িত মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও জীবিত আটজনকেই কেবল আসামি করা হয়। ঘটনাস্থলে নিহত : ৫ আসামি হলো রায়হান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। জঙ্গী হামলায় জড়িতরা অভিযানে নিহত : তামিম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, সরোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, বাশারুজ্জামান চকোলেট, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ছোট মিজান ও রায়হানুল কবির রায়হান। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী : ৬ আসামি দিয়েছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী। দেয়নি শরিফুল ও মামুনুর। অভিযোগ (চার্জ) গঠন : ২০১৮ সালের ২৬ নবেম্বর, ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু : ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর। প্রথম সাক্ষ্য দেন বাদী এসআই রিপন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ : ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর। যুক্তিতর্ক শেষ : ২০১৯ সালের ১৭ নবেম্বর। জঙ্গী হামলার উদ্দেশ্য দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। অভিযোগপত্রে বলা হয়, হলি আর্টিজানে হামলার পেছনে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গীদের। ১. কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্যরে জানান দেয়া। ২. বিদেশী নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো। ৩. দেশে বিদেশে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়া এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা। ২০১৮ সালের ২৬ নবেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ৩ ডিসেম্বর মামলার বাদী এসআই রিপন কুমার দাসের জবানবন্দী নেয়ার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে সর্বশেষ সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির। সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলার আগে জঙ্গীরা বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া বাজার এলাকার কলেজ মোড়ে একটি বাসায় মিটিং করে প্রথমে তারা হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা করে। জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা নব্য জেএমবির জঙ্গীরা ছয় মাস ধরে ওই হামলার পরিকল্পনা করে জানিয়ে পরিদর্শক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং বাংলাদেশকে একটি জঙ্গী রাষ্ট্র বানানো। রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য শোনার পর উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শুনানি হয়। সব বিচারিক কার্যক্রম শেষে গত ১৭ নবেম্বর রায়ের দিন ধার্য করে দেন বিচারক মজিবুর রহমান। রায়কে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাত থেকেই আদালতপাড়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতা বাড়ানো হয়। সকালে আট আসামিকে কারাগার থেকে নিয়ে আসা হয় আদালতে। বিপুলসংখ্যক সংবাদকর্মী সকাল থেকেই উপস্থিত ছিলেন আদালত প্রাঙ্গণে। গুলশান হামলায় যেসব দেশের নাগরিকরা নিহত হয়েছিলেন, সেসব দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও রায় শুনতে আদালতে এসেছিলেন। রায়ে রাষ্ট্র পক্ষের সন্তোষ প্রকাশ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু হলি আর্টিজান মামলার রায়ে নব্য জেএমবির সাত জঙ্গীর সর্বোচ্চ সাজার আদেশে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বুধবার রায়ের পর ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত প্রাঙ্গণে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। একজনের খালাসের বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করে যদি মনে করি, আপীল করা যাবে। আবদুল্লাহ আবু বলেন, আইএসের বরাত দিয়ে তারা হামলার দায় স্বীকার করেছে, কিন্তু এদেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে, সেটা তদন্তে আসেনি। এখানে যারা বিক্ষিপ্তভাবে জঙ্গী আছে, তারা পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। ‘আপীল করবে’ ফাঁসির আসামিরা আসামি পক্ষের অন্যতম আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মনে করি সাক্ষ্যগুলো ডাউটলেস না। অনেক কন্ট্রাডিকশন আছে, অনেক ইনকসিসটেন্সি আছে, লেক অব কোলাবেরশন আছে। আমরা এ নিয়ে উচ্চ আদালতে আপীল করব। দেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র বানানোর লক্ষ্য ছিল অভিযোগপত্রে (চার্জশীটে) বলা হয়েছে, হামলা করেছে জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি। ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গীরা। জঙ্গীদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে ‘অস্থিতিশীল করা’ এবং বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গী রাষ্ট্র’ বানানো। তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ওই বছরের ২৩ জুলাই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। জঙ্গী হামলার আলামত মামলায় আলামত হিসাবে জব্দ দেখানো হয় ১টি সাদা কাপড়ের রুমাল, ৫টি নাইন এমএম পিস্তল, তিনটি একে ২২ মেশিনগান, ১৩টি ম্যাগাজিন, নাইন এমএম ক্যালিবারের ৬টি তাজা গুলি, সেভেন পয়েন্ট সিক্সফাইভ ক্যালিবারের ২৮টি গুলি, একে-২২ এর ৩৫টি গুলি, পয়েন্ট টু টু বোরের ৪৪টি গুলি, ৬ পয়েন্ট ১৬ ক্যালিবারের ১২টি গুলি, সেভেন পয়েন্ট সিক্সটু ক্যালিবারের দুটি গুলি, একই ক্যালিবারের ১৯৫টি গুলির খোসা, নাইন এমএম ক্যালিবারের গুলির ১০৫টি খোসা, নয়টি গ্রেনেড সেফটি পিন, দুটি ছোরা, একটি চাপাতি ও একটি চাকু। আমের ঝুড়িতে আসে অস্ত্র আমের ঝুড়িতে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে গুলশান হামলার অস্ত্র। নব্য জেএমবির কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজান সেই অস্ত্র গ্রহণ করে এবং বসুন্ধরায় পাঠায়। তবে অস্ত্রের গায়ে কোন দেশের নাম লেখা ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, বর্ডার থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে আমের ঝুড়িতে করে গুলশান হামলার অস্ত্র ঢাকায় আনা হয়। সেই অস্ত্র নব্য জেএমবির কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজান গ্রহণ করে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যে বাসাটি জঙ্গীরা ভাড়া নিয়েছিল, সেখানে সেই অস্ত্র পৌঁছে দেয় মারজান। পরবর্তীতে সেই অস্ত্র দিয়েই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা করা হয়। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ও সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে তামিম চৌধুরী নিহত হয়। তবে মেজর জিয়া এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অস্ত্র ও অর্থের উৎসের বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। গুলশান হামলা বাস্তবায়নের জন্য দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে ১৪ লাখ টাকা আসে। অস্ত্র ভারতের সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সেই অস্ত্রই চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে আমের ঝুড়িতে করে ঢাকায় আনা হয়। অস্ত্র সংগ্রহের পর মারজান হামলাকারীদের তা চালানো শেখায় বলে পুলিশ দাবি করেছে। মারজানের গ্রামের বাড়ি পাবনার সদর থানার পৌরসভার পাইটকাবাড়ি। তার বাবার নাম নিজাম উদ্দিন, মা সালমা খাতুন। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম মারজান। অপারেশন প্ল্যান ঢাকায় হামলার পরিকল্পনা রাজশাহীতে, কৌশল নির্ধারণ গাইবান্ধায়, চূড়ান্ত অপারেশন প্ল্যান ঢাকায়। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গীদের ভয়াবহ হামলার ঘটনাটি নিছক কোন আক্রমণ ছিল না, এটি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। এই হামলার পরিকল্পনা করা হয় রাজশাহীতে, সেই পরিকল্পনার প্রাথমিক কৌশল ঠিক করা হয় গাইবান্ধায়। এরপর ঢাকায় বসে দিনের পর দিন রেকি করে হামলার লক্ষ্যবস্তু, সমর কৌশল ও অস্ত্র প্রবেশের উপায় নির্ধারণ করে জঙ্গীরা। চার মাস ধরে এই পরিকল্পনা করা হলেও ওই হামলায় যে ৫ জঙ্গী অংশ নেয় তারা ‘আত্মঘাতী’ হওয়ার নির্দেশ পেয়েছিল ঘটনার মাত্র দুই মাস আগে। ইসলাম ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ‘শহীদ’ হওয়ার জন্য ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করানো হয়েছিল ওই ৫ তরুণকে। আর সিরিয়াভিত্তিক ইসলামিক স্টেটস (আইএস) জঙ্গীদের পরিচয় ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হলেও হামলাকারী ও তাদের মাস্টারমাইন্ডরা ছিল দেশী নব্য জেএমবি’র সদস্য। হলি আর্টিজানে হামলাটির পরিকল্পনা ও এ ঘটনার নেপথ্যের রূপকারদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ্এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে যা বলা হয় জঙ্গীর আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ও সিটিটিসি কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে হামলার পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত। তাদের বক্তব্যে জানা গেছে, সারাবিশ্বের মনোযোগ পাওয়ার জন্যই বেছে নেয়া হয় গুলশানের কূটনৈতিক পাড়াকে। বিদেশীদের আনাগোনা আছে এমন একটি জায়গায় হামলার পরিকল্পনা থেকে টানা চার মাস ধরে রেকি করেই বেছে নেয়া হয়েছিল হলি আর্টিজানকে। রাজধানীর বিদেশী অধ্যুষিত কূটনৈতিক পাড়ায় একটি জায়গায় হামলার পরিকল্পনা থেকেই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিকে জঙ্গীরা প্রথম বেছে নেয় গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। রাজশাহীর একটি আস্তানায় বসে এ বিষয়ে প্রথম পরিকল্পনা করা হয়। এরপর গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানাধীন বোনারপাড়া বাজার কলেজ মোড় সংলগ্ন এলাকায় সাখাওয়াত হোসেন শফিক ও বাইক হাসান নামে দুই জঙ্গীর ভাড়া নেয়া বাসায় এ বিষয়ে বৈঠক করে নব্য জেএমবি’র মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী, মেজর জাহিদ, সারোয়ার জাহান মানিক ও তাদের সহযোগী তারেক, মারজান, শরিফুল ইসলাম খালিদ ও রাজীব গান্ধী। সেখানেই গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে আত্মঘাতী হামলার বিষয়ে দায়িত্ব বণ্টন ও বিস্তারিত পরিকল্পনা করে মাস্টারমাইন্ডরা। ওই বৈঠকেই হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলায় দেশী-বিদেশী হত্যার মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয় তামিম চৌধুরী ওরফে তালহাকে। কিন্তু, মাস্টারমাইন্ডদের কেউ এই আত্মঘাতী হামলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে না চাওয়ায় তাদের হামলাকারী নির্বাচনের দরকার পড়ে। পাঁচ হামলাকারীকে বাছাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে আত্মঘাতী হামলার জন্য কয়েক তরুণকে বেছে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে জেএমবির মাস্টারমাইন্ডরা। এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা মেলে ঘটনার পর গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধীর জবানবন্দীতে। আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সে জানিয়েছে, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে খালিদ (জঙ্গী শরিফুল ইসলাম খালিদ) আমার কাছে দুজন যুবক চায়, যারা আত্মঘাতী হামলায় অংশ নেবে। আমি শরিফুল ইসলাম ওরফে ডন এবং খাইরুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাধন নামে দুই যুবককে খালিদের কাছে বুঝিয়ে দেই। এই দুইজন আমার কাছে ‘বাইয়াত’ নেয়া (ধর্মের নামে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ)। খালিদ তখন আরও বলে যে তার হাতে আরও ৪ আত্মঘাতী যুবক আছে। তারা হলো রোহান ইমতিয়াজ ওরফে স্বপন, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ, নিবরাস ও মোবাশ্বের। এ ছাড়া ছয় জনের সঙ্গে সে সময় আবির নামে আরও এক তরুণকে হামলার জন্য নির্বাচন করা হয়। মোট সাত তরুণের মধ্যে শরিফুল ইসলাম ডন ও আবীর হোসেনকে পরবর্তীতে শোলাকিয়ায় হামলার জন্য প্রস্তুত করা হয়। হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ গুলশান হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের মূল প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম, সংগঠনে যাকে মেজর মুরাদ নামে সবাই জানত। সহযোগী প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে আবু রায়হান তারেক নামে এক জঙ্গী। মেজর মুরাদ মিরপুরের রূপনগরে আর তারেক কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় সিটিটিসির অভিযানে মারা গিয়েছে। এর সত্যতা মেলে জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধীর জবানবন্দীতে। এ বিষয়ে সে জানিয়েছে, ছয় আত্মঘাতী নিয়ে তামিম চৌধুরীর পরিকল্পনায় ২০১৬ সালে প্রথম সপ্তাহে গাইবান্ধার সাঘাটা থানাধীন ফুলছড়ি চরে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। এই সামরিক প্রশিক্ষণে তারেক বোমা প্রশিক্ষণ দিত, মেজর জাহিদ অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিত, তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহান মানিক, মারজান, রিগ্যান, খালিদ, রিপন এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মাঝে মাঝে আসত এবং নব্য জেএমবির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিত। আমিও মাঝে মাঝে ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গিয়েছি। হামলাকারীদের বসুন্ধরার বাসায় অবস্থান গুলশান হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীরা হামলার মাস খানেক আগে বসুন্ধরার বাসায় ওঠে। ওই বাসাতেই হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হয়। সেখানে তামিম চৌধুরী, মারজানসহ অন্যরা নিয়মিত যাতায়াত করত। রাজীব গান্ধী তার জবানবন্দীতে বলেছে, ২০১৬ সালের মে মাসের শেষের দিকে প্রশিক্ষণ শেষে তারেক ও মারজান প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৬ জনকে নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি ৬ তলা বিল্ডিংয়ে নিয়ে আসে। ওই বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় আগে থেকেই তানভীর কাদেরী তার পরিবারসহ অবস্থান করছিল। তামিম চৌধুরী সেখানে সবাইকে নিয়ে দফায় দফায় মিটিং করে। রাজীব গান্ধী বলে, গত বছরের ৩০ জুন সকাল ৯টার সময় বসুন্ধরার বাসায় মানিক ভাই এলে তামিম ভাই নিবরাসদের নিয়ে মিটিং করে। সেখানে মানিক ভাই নিবরাসদেরকে জানায়, আগামীকাল তোমরা সবাই গুলশানে হলি আর্টিজানে অপারেশন করবে। সেখানে বিদেশীদের আনাগোনা বেশি। অস্ত্র ও গ্রেনেড সংগ্রহ গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলায় জঙ্গীরা একে-২২ রাইফেল, পিস্তল, গ্রেনেড, চাপাতি ব্যবহার করে। পাশের দেশ ভারতের বিহার রাজ্য থেকে একে-২২ রাইফেল এবং ছোট অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করা হয়। গ্রেনেড তৈরির উপকরণ বিশেষ করে পাওয়ার জেল, ডেটোনেটরও সংগ্রহ করা হয় ভারত থেকে। এ বিষয়ে রাজীব গান্ধী তার জবানবন্দীতে বলেছে, হলি আর্টিজানে হামলা করার জন্য ৩/৪টি একে-২২ রাইফেল এক মাস আগেই রিপনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। মারজান, ছোট মিজানের মাধ্যমে ভারত হতে ৩/৪টি ছোট অস্ত্রগুলিসহ এবং বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকদ্রব্য সংগ্রহ করে। মারজান তার ভগ্নিপতি সাগরের মাধ্যমে গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরক আমের ঝুড়িতে করে ঢাকার বসুন্ধরার বাসায় নিয়ে আসে। মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় চকোলেট নামে এক জঙ্গীর বাসায় সোহেল মাহফুজ হলি আর্টিজান হামলার গ্রেনেড তৈরি করে। গ্রেনেডগুলো মারজান ও চকোলেট বসুন্ধরার বাসায় নিয়ে আসে। হামলার জন্য অর্থ সংগ্রহ এ হামলার জন্য বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে জঙ্গীরা। নব্য জেএমবির যে ‘কমন ফান্ড’ সেখান থেকেই হলি আর্টিজানে হামলার জন্য অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। রাজীব গান্ধী তার জবানিতে বলেছে, গত বছরের ২৮ জুন তামিম চৌধুরী বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে ১৮ লাখ টাকা আনান। সে টাকা তার হাতে তুলে দেয় চকোলেট। এই টাকা গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র, গ্রেনেড ও বোমা কেনার কাজে খরচ হয়। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, গুলশান হামলার জন্য জঙ্গীদের ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অস্ত্র ও গ্রেনেড সংগ্রহ, বাসা ভাড়া, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কাজে এসব খরচ করা হয়েছে। তবে এসব টাকা কমন ফান্ড থেকেই খরচ করা হয়েছে। হামলার আগের দিন সারোয়ার জাহানের বয়ান হামলার আগের দিন বসুন্ধরার বাসায় চূড়ান্ত মিটিং করে নেয় জেএমবির শীর্ষ নেতারা। ওই মিটিংয়ে তামিম চৌধুরী ছাড়াও নব্য জেএমবির আরেক শীর্ষ নেতা সারোয়ার জাহান মানিক উপস্থিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে রাজীব গান্ধী তার ভাষ্যে বলেছে, হামলার আগের দিন জোহরের নামাজের পর মানিক ভাই গুলশান হামলার বিষয়ে খুতবা দেয়। খুতবায় তিনি বলেন, তোমরা হতাশ হবে না। একজনের গুলি শেষ হলে অপরজন ব্যাকআপ দেবে। মনে রাখবে, আমাদের হারানোর কিছু নেই। অপারেশনের সময় তাড়াহুড়ার দরকার নেই। খুব গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবে। আর মুশরেকদের দয়া দেখাবে না। এমনকি সে যদি সাংবাদিকও হয়। সর্বদা জিকিরের মধ্যে থাকবে। যদি কেউ বন্দী হয়ে যাও তাহলে নিজে নিজেকে শেষ করে দেবে। আর একটা জিনিস মনে রাখবে যে, হলি আর্টিজানের গেট পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই আমরা সফল। কারণ, বিশ্ব জেনে যাবে যে বাংলাদেশেও হামলা হয়েছে। তাই শুধু হামলা হলেই আমরা সফল। খুতবা শেষ করার আগে আবারও তিনি বলেন, আমাদের হারানোর কিছু নেই, আমরা বিজয়ী। এর পর জোহরের সুন্নত নামাজ পড়ে মানিক ভাই তামিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে চলে যায়। হামলার আগে হলি আর্টিজান রেকি গুলশান হামলার আগে একাধিকবার হলি আর্টিজান রেকি করা হয়। এই হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী নিজেও হলি আর্টিজান রেকি করেছিল। এছাড়া পাঁচ হামলাকারীও পরপর দু’দিন হলি আর্টিজানে গিয়ে রেকি করে আসে। রাজীব গান্ধী তার জবানবন্দীতে বলেছে, তামিম চৌধুরী গুলশানে হামলা করার জন্য মারজান, চকোলেট ও আমাকে নির্দেশ দিয়ে বলে যে রোহান, নিবরাস, খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাধন, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ, মোবাশ্বের যেন সন্ধ্যার পর আলাদা আলাদা করে হোটেলটি রেকি করে আসে। তামিমের কথামতো মারজান, রোহান ও নিবরাসকে নিয়ে ’১৬ সালেঠর ২৭ জুন সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে রেকি করে আসি। পরেরদিন সন্ধ্যায় আবার চকোলেট, বিকাশ ও বাধনকে নিয়ে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে যাই। রাত আনুমানিক সাড়ে দশটায় বসুন্ধরার বাসায় ফিরে এসে সবার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করি। রোহান কমান্ডার, নতুন প্যান্ট ও টি-শার্ট সংগ্রহ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার জন্য পাঁচ হামলাকারীর মধ্যে রোহান ইমতিয়াজকে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। রাজীব গান্ধী তার জবানবন্দীতে বলেছে, ২৯ জুন সন্ধ্যার পর তামিম, রোহান ও মোবাশ্বের বের হয় এবং ওই দিনও হলি আর্টিজানে রেকি করে রাত ১১টায় ফিরে আসে। তামিম ভাই (তামিম চৌধুরী) তখন হামলাকারী দলের সবাইকে নিয়ে বসে। রোহান ইমতিয়াজকে হামলার মূল দায়িত্ব দেয়া হয়। তামিম চৌধুরী চকোলেট ভাইকে নির্দেশ দেয় নিবরাসসহ ওদের ৫ জনের জন্য ৫টি টি-শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট কিনে আনতে। সে অনুযায়ী আমরা গুলশান-১ নম্বর থেকে প্যান্ট ও টি-শার্ট কিনে নিয়ে আসি। হামলার দিন দুই দলে বের হয় পাঁচ জঙ্গী গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার জন্য বিকেলের দিকে দুই দলে বের হয় পাঁচ জঙ্গী। প্রথম দলে রোহান, মোবাশ্বের ও নিবরাস একসঙ্গে বের হয়। এর এক ঘণ্টা পর বের হয় পায়েল ও উজ্জ্বল। রাজীব গান্ধী তার জবানবন্দীতে জানিয়েছে, ১ জুলাই সকাল ১০টার সময় চকোলেট বসুন্ধরার বাসায় এসে হলি আর্টিজানে হামলাকারী প্রত্যেকের ব্যাগে একটি করে বড় অস্ত্র (একে-২২), একটি পিস্তল ও একটি ছিটকিনি, বড় চাকুসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে গুলি ও গ্রেনেড ঢুকিয়ে দেয়। এরপর বসুন্ধরার কাছে আমরা জুমার নামাজ পড়ি। বেলা ৩টার দিকে তামিম ভাই (তামিম চৌধুরী) সিদ্ধন্ত নিয়ে জানায় যে, প্রথমে আমি আমার স্ত্রীসহ মিরপুরের নতুন বাসায় চলে যাব। তারপর আছর নামাজের পর রোহান, নিবরাস, মোবাশ্বের তাদের অস্ত্র-গুলির ব্যাগসহ বের হয়ে যাবে। এর এক ঘণ্টা পর উজ্জ্বল ও পায়েল তাদের অস্ত্র ও গুলির ব্যাগসহ বের হয়ে যাবে। পরে বিকেল ৫টার দিকে তামিম ভাই ও চকোলেট বের হয়ে যাবে। তার কিছুক্ষণ পর তানভীর কাদেরী তার পরিবার নিয়ে বের হয়ে যাবে। ওই সময় তামিম চৌধুরী তানভীর কাদেরীকে বলে আমরা বের হওয়ার পর আপনি আর কোনভাবেই দেরি করবেন না। আপনি অবশ্যই মাগরিবের আগে বের হয়ে যাবেন। প্রয়োজনে ইফতার সঙ্গে নিয়ে যাবেন। চকোলেট ভাই একটি সিএনজি ভাড়া করে দিলে আমি বেলা অনুমান ৩টার সময় পরিবারসহ মিরপুর মধ্য পীরেরবাগ ভাড়া বাসায় চলে যাই। জঙ্গীরা রিক্সা ও হেঁটে বসুন্ধরার বাসা থেকে হলি আর্টিজানে পৌঁছায়। হলি আর্টিজান বেকারিতে যাওয়ার জন্য তারা নর্দ্দা হয়ে বারিধারা ডিওএইচএস গেট দিয়ে লেকের পাড় ঘেঁষে হলি আর্টিজানের দিকে এগিয়ে যায়। এই সড়কের কোথাও পুলিশী চেকপোস্ট ছিল না। চেকপোস্ট এড়ানোর জন্যই তারা ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশের সড়ক দিয়ে ৭৯ নম্বর সড়কের চৌরাস্তায় গিয়ে পৌঁছায়। হামলার রাতে মাস্টারমাইন্ড তামিম ও তার সহযোগীদের অবস্থান হলি আর্টিজানে হামলার ওই রাতে মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ও নূরুল ইসলাম মারজান শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় অবস্থান করে। ভেতরে থাকা জঙ্গীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ও বার্তা আদান-প্রদানের প্রমাণও পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এসময় মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকার একটি বাসায় অবস্থান করছিল জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী। রাজীব তার জবানীতে বলেছে, রাত ৯টার দিকে মারজান ভাই আমাকে থ্রিমা আইডির মাধ্যমে হলি আর্টিজানে হামলার আপডেট দেখতে বলে। তখন আমি নামাজ, দোয়া ও জিকির করতে থাকি। যেন আল্লাহ আমাদের অপারেশন সফল করে এবং আমার ভাইদের শহীদ করে। সারারাত নেটের মাধ্যমে আমাদের অপারেশনের সফলতা দেখে আমি খুব খুশি ছিলাম। সকাল ৭টার দিকে মারজান ভাই আমাকে থ্রিমা আইডির মাধ্যমে জানায় যে, সেনাবাহিনী প্রস্তুত কিছুক্ষণের মধ্যে ভাইয়েরা শহীদ হবে। আপনারা দোয়া করবেন। আমি ও আমার পরিবার ভাইদের জন্য দোয়া করি এবং সেনাবাহিনীর অভিযানে ভাইয়েরা শহীদ হলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলি। হলি আর্টিজানের ভেতর থেকে জঙ্গীদের বাইরে যোগাযোগ হলি আর্টিজানে হামলার পর জিম্মি হওয়াদের দু’জনের মোবাইল থেকে জঙ্গীরা বাইরে থাকা তামিম ও মারজানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। হলি আর্টিজান বেকারি থেকে উদ্ধার করা ৩০টি মোবাইল ফোন এফবিআইয়ের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। ফরেনসিক পরীক্ষায় হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহত ইতালীয় ক্লদিও এবং বেঁচে ফিরে আসা শ্রীলঙ্কান নারী ফেফতা সায়মার মোবাইল ব্যবহারের প্রমাণ পায়। জঙ্গীরা এই দুটি মোবাইল থেকে হলি আর্টিজানের ভেতর থেকে ১৪টি ছবি বাইরে পাঠায়। এছাড়া প্রটেক্টেডটেক্সট নামে একটি এ্যাপসের মাধ্যমে ভেতরে থাকা জঙ্গীদের বাইরে থাকা নেতাদের সঙ্গে কথপোকথন হয়। ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে আটটি বার্তা আদান-প্রদানের প্রমাণ পাওয়া গেলেও কেবল একটি বার্তা উদ্ধার করা গেছে। সেখানে পরস্পরকে ‘আঁখি’ বলে সম্বোধন করা হয়। একটি বার্তায় বলা হয় ‘বনানীর ওসি কিলড’। আবু তালহা নামে একজন ভেতরে থাকা জঙ্গীদের বলেন, আঁখি, আপনারা যে কোন পিকচার বা ভিডিও আপলোড করতে পারবেন নেটে? তারপর আমাদের লিংক দিলেই হবে। অপারেশন গাজওয়াত-২০১৬ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার একটি নাম দিয়েছিল জঙ্গীরা। তা হলো ‘অপারেশন গাজওয়াত-২০১৬’। এই নাম দিয়েই প্রটেক্টেডটেক্সট-এ ইউজার আইডি খুলেছিল জঙ্গীরা। অপারেশন গাজওয়াত-২০১৬ এর হামলা দলের প্রধান বা কমান্ডার নির্বাচন করা হয় রোহান ইমতিয়াজকে। রোহানই হলি আর্টিজানে প্রবেশের পর সারারাত অপর চার হামলাকারীকে নির্দেশনা দেয়। এমনকি ভেতর থেকে বাইরে থাকা তামিম ও মারজানের সঙ্গে যোগাযোগও করে সে। হলি আর্টিজান বেকারিতে যে হামলা হয়েছে, জঙ্গীবাদের ভাষায় এটাকে ‘ইঙ্গিমাসি’ হামলা বলে। এই হামলার একটি ধরন রয়েছে। বিশেষ করে একই ধরনের পোশাক পরিহিত অবস্থায় তারা হামলায় অংশ নেয়। টার্গেট ব্যক্তিদের হত্যার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত একাধিক ব্যক্তিকে জিম্মি করে রাখে,যাতে বিষয়টি সারা দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়, আলোচনায় আসে।
×