ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপার সৌন্দর্যমন্ডিত নীলগিরি

প্রকৃতির অনন্য দান উঁচু পাহাড়, ওপারে খেলা করে সাদা মেঘের ভেলা

প্রকাশিত: ১০:২১, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

প্রকৃতির অনন্য দান উঁচু পাহাড়, ওপারে খেলা  করে সাদা মেঘের ভেলা

রাজুমোস্তাফিজ, বান্দরবানের নীলগিরি থেকে ফিরে ॥ প্রকৃতির ঐশ্বর্য আর গিরি শোভায় সুশোভিত কারুকার্যময় বান্দরবানের নীলগিরি। মেঘ ছুঁয়ে দেখতে চাইলে যেতে হবে সেখানে। মেঘ এসে নিজে ধরা দেবে আপনার হাতে। মাথার উপর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা খেলা করে নীলগিরি পাহাড়ে। বান্দরবান শহর থেকে পূর্বদিকে মাত্র ৪৫ কিমি দূরে নীলগিরি পাহাড়ের চূড়ায় এ অঞ্চলটির অবস্থান। নীলগিরি যাওয়ার পথে আপনি দেখে যেতে পারেন বান্দরবানের অপার সৌন্দর্য্যময় গিরিখাতের জলপ্রপাত। জেলা শহর থেকে দুই ঘণ্টার রাস্তা হলেও পাহাড়ী গিরিপথ বলে এখানে যেতে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। নীলগীরি যেন প্রকৃতির এক অনন্য দান। নীলগিরি পাহাড় থেকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ পাহাড় কেওক্রাডাং, বগালেক, কক্সবাজার সমুদ্র, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের আলো-আঁধারী বাতি ও চোখ জুড়ানো সারি সারি পাহাড়ও দেখতে পাওয়া যায়। নীলগিরির কাছাকাছি রয়েছে কয়েকটি স্রোন উপজাতির গ্রাম। এখানে রয়েছে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প। নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই। তারা সব সময় সকলের সহযোগিতায় হাত বাড়ায়। আমাদের চাদের গাড়িটি যখন ধীরে ধীরে এঁকেবেঁকে নীলগিরি পাহাড়ের উপরে উঠছে তখন পাহাড়ের কোলঘেঁষে সবুজ বন। এত উঁচু উঁচু পাহাড় যে ওপারের নীল আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। আমরা যখন নীলগিরি পাহাড়ে পৌঁছলাম তখন সূর্য হেলে পড়েছে। আকাশের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। পাহাড়ের কোলজুড়ে সবুজে ঢাকা। অপূর্ব দৃশ্য। পর্যটকরা এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা। নিবিড় শ্যামলিমা, চোখ জুড়ানো নিসর্গ, পাহাড় ছুঁয়ে মেঘমালার উড়ে চলা, প্রাকৃতিক ঝর্ণা উপজাতির বৈচিত্র্যময় জীবনপ্রণালী, প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, প্রকৃতিকে করেছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এখানকার মানুষ শান্তিপ্রিয়, মৈত্রীভাবাপন্ন, ধর্মসহিষ্ণু ও সাংস্কৃতিকভাবে উদার। এ জন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎসবাদি সারা বছর লেগেই থাকে নীলগিরির আশপাশের গ্রামে। নীলগিরি পাহাড়ে বেড়ানোর অসংখ্য জায়গা রয়েছে। আকাশছোঁয়া গাছগাছালির বড় বড় পাহাড় কেটে তৈরি করা উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা সড়ক। এখানকার বিভিন্ন পাহাড়ের গায়ে সবুজ লতা-আর গুল্ম যেন হাত ধরাধরি করে চলে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়। দেখে মনে হয় পাহাড়। নীলিগিরি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় চমৎকার একটি জায়গা। পাহাড় এবং আকাশের মিতালির এক অপূর্ব নিদর্শন। কটেজের নিচ দিয়ে সাদা তুলোর মেঘ উড়ে উড়ে যাচ্ছে। বিচিত্র মেঘের খেলা। সকালে পরিষ্কার রোদ। দূরে সাদা মেঘ উড়ে উড়ে যায়। প্রকৃতি যে কত সুন্দর হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানকার মেঘগুলো মুহূর্তে ঢেকে ফেলে সমস্ত এলাকা। নীলগিরির এই দৃশ্য দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত পর্যটক বান্দরবান থেকে বাস,মাইক্রোবাস,কার, জীপ নিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড় অতিক্রম করে এখানে আসে। প্রতিটি মাইক্রোবাস, কার এবং জীপের ভাড়া ৪হাজার থেকে ৮হাজার টাকা নেয়। তবে শীতকালে গাড়ি আর হোটেল ভাড়া বেশি হলেও বর্ষকালে তুলনামূলক কম। বান্দরবান জেলা শহরের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট অফিস থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। গাড়িতে যাবার সময় পাহাড়ী রাস্তায় পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন গ্রামের পাহাড়ী অধিবাসী তরুণ-তরুণী পাহাড়ে গয়াল (পাহাড়ী গরু) পরিচর্যায় ব্যস্ত। সন্ধ্যা নামার আগেই কিষাণ-কিষাণীরা জুম চাষ শেষে টংয়ে ফিরছে,কারো কাঁধে জল, কেউবা ফল নিয়ে ছুটছে বাড়ির দিকে। সুনসান নীরবতা। বর্র্ষায় প্রকৃতিতে মেঘে আর বৃষ্টিতে পুরো অঞ্চল সবুজে ভরে যায়। নীলগিরি এলাকায় মানুষ আকাশে মেঘের খেলা দেখতে যায়। এখানে রাত যাপনের জন্য রয়েছে অসংখ্য কটেজ। রাতের প্রকৃতি যেন আরও সুন্দর। শুধুই নীরবতা। সন্ধ্যা নামার পর চারদিকে অন্ধকারের মাঝে কটেজের আলো শুধু দেখা যায়। জোনাকির আলোতে ভরে যায় সমস্ত নীলগিরি পাহাড়। মৃদু বাতাস যে কোন পর্যটককে বিমোহিত করে তোলে। এখানকার প্রতিটি কটেজ সেনা দ্বারা পরিচালিত। আগে থেকেই বুকিং করতে হয়। কটেজ ভাড়া ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। এখানে খাবার ব্যবস্থা আর্মিরাই করেন। এজন্য তারা আলাদা টাকা নেন। রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে আর দুপুর ১টা থেকে দুটার মধ্যে খাবার সারতে হয়। সকালের নাস্তার ব্যবস্থাও রয়েছে। নীলগিরি থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য যে কোন পর্যটককে মুগ্ধ করবে। সাদা মেঘের খেলা আর পূর্ণিমার রাতের আলো পর্যটকদের বিমোহিত করে। তারা হারিয়ে যায় স্মৃতির গভীরে। এসব দৃশ্য পর্যটকদের মন রাঙ্গিয়ে তোলে। আর তাই প্রতিদিন শত শত মানুষ মনের আকুতি জানাতে এবং নিজেকে প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে মেলাতে ছুটে আসে নীলগিরিতে।
×