ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

সাদা টেস্টের গোলাপি আয়োজন

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ২৭ নভেম্বর ২০১৯

সাদা টেস্টের গোলাপি আয়োজন

টেস্ট ক্রিকেটে জয়টাকে ইদানীং নিয়মে পরিণত করেছে ভারত। বিশ্বকাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর, ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ হয়ে বাংলাদেশ, উড়ছে বিরাট কোহলির দল। তবু কলকাতা টেস্ট ঘিরে ছিল সাজসাজ রব। উপমহাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গোলাপি বলে ফ্লাডলাইটের আলোয় ডে-নাইট টেস্ট খেলতে নেমেছিল দু’দেশ। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীর মধ্যে মেলবন্ধনের পুরনো রোশনাই উস্কে দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের নতুন বস্ সৌরভ গাঙ্গুলী। অসম দুই প্রতিপক্ষের ম্যাচ তিন দিনে গড়াবে কি না, সেই শঙ্কা সত্ত্বেও পঞ্চম দিনের টিকেট পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গিয়েছিল! যা হওয়ার তাই হয়েছে। আড়াই দিনেরও কম সময়ে ইনিংস ব্যবধানে হেরে গেছে বাংলাদেশ। তবে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত আলোচনার কেন্দ্রে ছিল কেবলই গোলাপি বলের আয়োজন। কোহলি থেকে মুমিনুল হক, বর্তমান থেকে সাবেক, ইডেনে ডে-নাইট টেস্টের রোমাঞ্চ ছুঁয়ে গেছে সবাইকে। এই যে আবেগ, উন্মাদনা, সাদা পোশাকের টেস্টকে আরও আকর্ষনীয় করতে নতুন ধারণার উতপত্তিটাই তো হয়েছিল এ কারণে। দর্শক হবে, ফল আসবে, আভিজাত্যের ক্রিকেট নিয়ে মেতে উঠবে বিশ্ব। ১৯৭৭ সালে ওয়ার্ল্ড সিরিজ ওয়ানডে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করে অস্ট্রেলিয়ান টিভি চ্যানেল নেটওয়ার্ক চ্যানেল নাইন। সেই ওয়ার্ল্ড সিরিজের ম্যাচগুলো হতো ফ্লাডলাইটে। সন্ধ্যার পর খেলা হওয়ায় খুব দ্রুতই তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে দু’বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায় এই ওয়ার্ল্ড সিরিজ। তবে একটা বড় কাজ হয়। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি ফ্লাডলাইটের মর্ম বুঝতে পেরে পরবর্তী সময় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো এই ফ্লাডলাইটের আলোতে আয়োজন করা শুরু করে। এরপর টি২০ আসার পর প্রায় সব ম্যাচই ফ্লাডলাইটের আলোতে অনুষ্ঠিত হয়। তবে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের জনপ্রিয়তার চাপে পরে হারিয়ে যেতে বসার উপক্রম হয় টেস্ট ক্রিকেটের। টেস্টকে বাঁচাতে অনুসন্ধান শুরু করে আইসিসি। পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যদি ওয়ানডে ও টি২০র মতো টেস্ট ম্যাচও মানুষ রাতে অবসর সময়ে ঘরে বসে দেখতে পারে তাহলে এটির জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব। ডে-নাইট টেস্ট আয়োজনের অন্যতম অন্তরায় ছিল গতানুগতিক লাল বল। কারণ রাতের বেলা লাল বল স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। ফলে হলুদ, কমলা ও গোলাপি বল দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। তা ছাড়া একবার পরিকল্পনা করা হয়েছিল ৮০ ওভার পর্যন্ত টিকে থাকবে এমন সাদা বল তৈরি করার। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় টিকে যায় গোলাপি বল। ২০০৬ সালে মূলত শুরু হয় পরিকল্পনা। রিহার্সেল। এরপর বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু অনেকেই গোলাপি বল দিয়ে খেলতে চায়নি। অনেকের কাছেই অজানা ২০১০ সালেই কিন্তু বাংলাদেশ গোলাপি বলের টেস্ট খেলত। কথা ছিল ওই বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতে ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচ খেলবে টাইগাররা। কিন্তু পরবর্তী সময় সেটি আর হয়নি। তবে অবশেষে ২০১৫ সালের নভেম্বরে এ্যাডিলেড স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ দিয়ে হয় প্রথম আন্তর্জাতিক ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচ। ম্যাচটির প্রথম দিন প্রায় ৪৭ হাজার দর্শক স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিল। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ওই ম্যাচটি তিন দিনের মধ্যে জিতে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ওই ম্যাচ শেষে বলের মানসহ বিভিন্ন দিকগুলো সামনে এসেছিল। অনেকেই এটির সমালোচনাও করেছিলেন। এমনকি ২০১৮ সালে ভারত নিজেই অস্ট্রেলিয়ার দেয়া গোলাপি বলে টেস্ট খেলার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিল। তবে টেস্টকে বাঁচানোর জন্য এখন মন গলেছে বিশ্ব ক্রিকেটের অঘোষিত মোড়ল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিাআই)। বিশেষ করে সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি বিসিসিআইয়ের সভাপতি হওয়ার পর। সৌরভের হাত ধরেই বিদেশের মাটিতে টেস্টে দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছিল ভারত। তাঁর নেতৃত্বেই ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জোর লড়াই দিয়েছিল দল। হোঁচট খেয়েও সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন তিনি। সেই সৌরভই আগামীর অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পেরেছেন। ব্যাটসম্যান এবং অধিনায়ক হিসেবে দলকে নানা সাফল্য এনে দিয়েছেন। এবার বিসিসিআইয়ের সর্বোচ্চ মসনদে বসেও ইতিহাস রচনা করলেন। গোলাপি বলে ডে-নাইট টেস্ট করার সাহস দেখালেন তিনি, ‘দাদার দলই জয়ের অভ্যেসটা তৈরি করে দিয়েছে। আমরা সেই ধারাটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি মাত্র। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পাল্টা দিতে শিখেছি। গত তিন-চার বছরের কঠিন পরিমের পুরস্কার পাচ্ছি।’ বলে কোহলি। তবে কোহলির মুখে সৌরভের প্রশংসা শুনে অধিনায়ককে খোঁচা দিতে ছাড়েননি সুনীল গাভাস্কার, ‘আমি জানি, দাদা এখন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট। তাই ওঁর নামে ভাল ভাল কথা বলতেই হবে। আজ একজনের মনে হচ্ছে ১৯৯৪-৯৫ বা ২০০০ সালে ভারতের ক্রিকেট রাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু বিরাট ১৯৮৮ সালে জন্মেছে। ও হয়তো জানে না ৭০ ও ৮০-র দশকেও ভারত জিতেছে কিংবা ড্র করেছে!’ যদিও এ নিয়ে কোহলির কোন প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি। এদিকে সুষ্ঠুভাবে প্রথম গোলাপি টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করতে পেরে খুশি সৌরভও, ‘অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও খুশি। টেস্ট ক্রিকেটের স্বার্থেই এটা করতে চেয়েছিলাম। দর্শকরা টেস্ট দেখতে মাঠে আসছিলেন না। ম্যাচের আগে নানাভাবে প্রচার করেছিলাম আমরা। চারদিনের টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়, শুধু ইডেন নয়, ভারতের যে প্রান্তেই টেস্ট হবে, এবার এভাবেই গ্যালারি ভরাবেন সমর্থকরা।’ এই ম্যাচ খেলতে রাজি হওয়ার জন্য বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ জানান দাদা। সেই সঙ্গে আগামী বছর মার্চে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলেও জানান তিনি। ঢাকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আয়োজিত বিশ্ব ও এশিয়া একাদশের মধ্যে টি২০ ম্যাচে উপস্থিত থাকবেন সৌরভ। গোলাপি টেস্টের হাত ধরে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক যে আরও মজবুত হল, তা বলাই বাহুল্য। ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে এর আগে পর্যন্ত এগারোটি ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচ হয়েছিল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ম্যাচটি ছিল দ্বাদশ ম্যাচ। ১২ ম্যাচের সবকটিতেই ফল এল। ড্র হয়নি কোনো ম্যাচ। উদ্দেশ্য সফলই বলতে হবে। সবচেয়ে বেশি পাঁচটি ম্যাচ খেলেছে অস্ট্রেলিয়া। আর পাঁচটিতেই জয় পেয়েছে তারা। সমান তিনটি করে ম্যাচ খেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা খেলেছে দুটি ম্যাচ। আর একটি করে ম্যাচ খেলেছে ইংল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ে। ডে-নাইট টেস্টে এখন পর্যন্ত সেঞ্চুরি করেছেন তেরো জন ব্যাটসম্যান। এর মধ্যে দুবার সেঞ্চুরি করেছেন পাকিস্তানের আসাদ শফিক। গোলাপি বলে সর্বোচ্চ ৩০২ রান করেছেন পাকিস্তানের আজহার আলী। অন্যদিকে গোলাপি বলের টেস্টে পাঁচ ম্যাচ খেলে ২৬ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান পেসার মিচেল স্টার্ক। চার ম্যাচ খেলে ২১ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে জস হ্যাজেলউড। ইডেন গার্ডেনসের এটি ছিল ইতিহাসের ১২তম ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচ। ভারত-বাংলাদেশের আগে ডে-নাইট টেস্ট খেলা দলগুলো হলোÑঅস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ে। চার বছরে এ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ৫টি, নিউজিল্যান্ড ২টি, পাকিস্তান ৩টি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩টি, দক্ষিণ আফ্রিকা ২টি, ইংল্যান্ড ৩টি, শ্রীলংকা ৩টি ও জিম্বাবুয়ে ১টি করে ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচ খেলেছে।
×