ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকারের ক্ষতি শত কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ২৭ নভেম্বর ২০১৯

সরকারের ক্ষতি শত কোটি টাকা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের (প্রথম পর্যায়ে) ভূমি অধিগ্রহণে সরকারের ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিচালকের অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ আত্মসাতের কারণে এই টাকা গচ্চা যাচ্ছে। বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ যেন থামছেই না। দুর্নীতির দায়ে প্রকল্প পরিচালক মোঃ আমিনুল হাসিবকে সাময়িক বরখাস্তের পর অনিয়মের বহু তথ্য বেরিয়ে আসছে। জানা গেছে, ৩০০ কেভিএ জেনারেটর কেনার নামে ৬০ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের পর সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণ, ফেল্ট পরিদর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিলেছে পাহাড়সম দুর্নীতির প্রমাণ। রানওয়ে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের ৫৭৮ কোটি টাকায় পুরনো ‘ডাম্বেলে ওভারলে’র মাধ্যমে অন্তত ১৫ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রাপ্ত অভিযোগে প্রকাশ, রানওয়ে নির্মাণে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। পুরনো ডাম্বেলে করা হয়েছে ওভারলে। যে কারণে প্রকল্প কাজে কাজের মান ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর এসব অনিয়ম দুর্নীতির মূলে রয়েছে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্র্রকল্প পরিচালক আমিনুল হাসিব। বিশ্লেষকরা বলেন, এ ঘটনায় সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী কোনভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরের যেসব প্রকল্প চলমান আছে, সেগুলো সবধরনের কার্যক্রম প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে করা হয়ে থাকে। এজন্য তাকেও জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দাবি করে প্রকল্প পরিচালক মোঃ আমিনুল হাসিব জনকণ্ঠকে বলেন, এলজিইডির টাকা না পেলে আমি কোথা থেকে দেব? তাতে আমার দোষ কি? তবু আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন সরকারী নিয়ম অনুসারে যা হবার তাই হবে। ডাম্বেলে দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ওটা নতুন কনস্ট্রাকশন। দুর্নীতির কোন সুযোগ নেই। মানসম্মতভাবে কাজ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন রানওয়ের ডাম্বেলে ‘ওভারলে’ করা হয়েছে। ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পুরাতন রানওয়ে না ভেঙ্গে তার উপরে নির্মাণ কাজ চালিয়ে দেয়া হয়েছে। বাউন্ডারি ওয়ালে সিরামিকের ইটের নির্দেশনা থাকলেও ব্যবহার করা হয়েছে লোকাল ইট। এক্সপার্ট দিয়ে তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে ভয়ানক দুর্নীতির বহু চিত্র। প্রধান প্রকৌশলীসহ দু’জনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এসব দুর্নীতি চলেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক আমিনুল হাসিব কর্মস্থলে থাকতেন সপ্তাহে দু’দিন। সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট অন্য কাজও পছন্দের লোক দিয়ে করিয়েছেন আমিনুল হাসিব। তার দুর্নীতি ও গাফিলতির কারণে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। জনৈক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ১৮ কোটি টাকা অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নেন প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী ও প্রকল্প পরিচালক আমিনুল হাসিব। এর আগে জেনারেটর ক্রয়ে সাড়ে ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় পাঁচজন বরখাস্ত হলেও কৌশলে রক্ষা পেয়ে যায় নির্বাহী প্রকৌশলী নুর উদ্দিন চৌধুরী। সূত্র জানিয়েছে, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমানের টেবিলে রানওয়ে প্রকল্পের কাজের অনেক বিল এখন জমা আছে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর যেগুলো স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে, এ বিষয়ে হাবিবুর রহমানের কাছে জানতে চেয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের (প্রথম পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক হিসেবে মোঃ আমিনুল হাসিব নিয়োগ পান। তখন তিনি ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। প্রধান প্রকৌশলীর আজ্ঞাবহ হওয়ায় ২০১৭ সালের দিকে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশলী হন। সরিয়ে দেয়া হয় সিনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে। যিনি বর্তমানে ডিভিশন-৩ এর সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প চলাকালীন বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পটি আমিনুল হাসিবের ওপর ন্যস্ত করা হয়। ২০১৮ সালের ৪ নবেম্বর সরকার এই প্রকল্পটি অনুমোদন করেন। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য কক্সবাজার জেলায় ০৪/২০১৫-২০১৬ নং ভূমি অধিগ্রহণ কেসে ৬৯ কোটি ২৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা গত ২৩ মের মধ্যে জমা দিতে চিঠি পাঠান কক্সবাজার জেলা প্রশাসক। বিশ্লেষকদের মতে, প্রকল্প পরিচালক হিসেবে মোঃ আমিনুল হাসিবের দায়িত্ব ছিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ অর্থ জেলা প্রশাসকের তহবিলে জমা দেয়া। কিন্তু তিনি নির্ধারিত সময়ে অর্থ জমা দিতে ব্যর্থ হন। যার পরিপ্রেক্ষিতে আইন অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণ কেসটি বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুসারে সরকারকে তিনগুণ বেশি জমির মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এতে করে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে অন্তত ১০০ কোটি টাকা। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, মোঃ আমিনুল হাসিব স্থানীয় ভূমি মালিক ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মচারীর সঙ্গে মিলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাত করার ষড়যন্ত্র করেছেন। বিমানবন্দরের ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়নি। প্রকল্প পরিচালকের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে এ প্রকল্পের কাজে মারাত্মক ত্রুটি হয়েছে।
×