ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা

প্রকাশিত: ০৯:০২, ২৭ নভেম্বর ২০১৯

ইতিহাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা

বিজেপি সরকার ভারতে ইতিহাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছে। বিজেপি এর আগেও ক্ষমতায় এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। তিনি শিক্ষিত ও উদার নেতা ছিলেন। শিবসেনা ও আরএসএসের কবলমুক্ত করে বিজেপি সরকারকে একটি উদারনৈতিক সরকারে পরিণত করতে চেয়ে আরএসএস ও শিবসেনাদের রোষের মুখেও পড়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কট্টরপন্থী। বাজপেয়ীর মতো উদারপন্থী নন। তিনি আমাদের খালেদা জিয়ার মতো স্বশিক্ষিত। গুজরাটে ১৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন। ফলে তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা প্রচুর। তবে বাজপেয়ীর মতো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা কতটা আছে তা বলা মুশকিল। বাজপেয়ী ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আরও পার্থক্য আছে। বাজপেয়ী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদির মতো কট্টরপন্থী আরএসএসের সদস্য ছিলেন না। ফলে তার সরকারে কট্টরপন্থীদের প্রভাব ছিল কম। তার প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ দিকে তিনি পাকিস্তান থেকে শেরোয়ানি এনে পরতে শুরু করেছিলেন। সভামঞ্চে উঠে যুক্তকর নমস্কার দেয়ার বদলে নেহেরুর মতো হাত তুলে অভিবাদন দিতেন। অনেকে বলেন, বিজেপির প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি দ্বিতীয় নেহেরু হতে চেয়েছিলেন। বিজেপির বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে রাজনৈতিক দার্শনিকতা নেই। তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় আধুনিক যুগের প্রভাব নেই। আছে পৌরাণিক হিন্দু ভারতের সঙ্কীর্ণতা। তিনি মূলত আরএসএস বা কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য ছিলেন। তার সরকারের কর্মকা-ে তাই রয়েছে আরএসএসের প্রচ- প্রভাব। আর এই প্রভাবের ফলে গান্ধী-নেহেরুর হাতে গড়া গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক ভারতের আধুনিক ভাবমূর্তি এখন দিনে দিনে মলিন হতে চলেছে। ভারতে মোদি সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়Ñ বিশেষ করে নি¤œবর্ণের হিন্দু বা দলিত শ্রেণী, মুসলমান সম্প্রদায় এবং কোন কোন রাজ্যে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ও নির্মমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। গো-রক্ষার নামে চলছে মুসলমানদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার। এই অত্যাচারের বিবরণ প্রকাশ করে কলকাতার স্টেটসম্যান (বাংলা সংস্করণ) পত্রিকায় একটি উপসম্পাদকীয়র হেডিং দেয়া হয়েছিল, ‘ভারতে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আছে গরুর নিরাপত্তা’। কিছুদিন আগে আরএসএস ও শিবসেনা ভারতে সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তকরণ শুরু করেছিল। এখনও তা বন্ধ হয়নি। রাজপথে হাঁটতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কেউ জয়রাম স্লোগান না দিলে তাকে বেদম প্রহার করা হয়। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে, এমনকি বিজ্ঞানের বইতে মনগড়া ও অসত্য তথ্য ঢোকানোর ফলে ভারতের বুদ্ধিজীবীরাই শঙ্কিত এবং তার প্রতিবাদ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি পর্যন্ত প্রকাশ্যে দাবি করছেন, আণবিক অস্ত্র পৌরাণিক হিন্দুযুগে হিন্দুরা আবিষ্কার করেছিল এবং মনুষ্য দেহে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন সেই আমলেই শুরু। প্রমাণ গণেশের শির কেটে হাতির মাথায় সংযোজন। এই একুশ শতকে এমন উদ্ভট কথা কেউ প্রকাশ্যে বলতে পারেন তা চিন্তা-ভাবনার অতীত। বিজেপি ক্ষমতায় এসেই আধুনিক ভারতের রূপকারদের নাম ও স্মৃতি মুছে ফেলতে শুরু করে। ভারতের ডাকটিকেটে নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধীসহ সেক্যুলার নেতা ও মনীষীদের ছবি এখন নেই। সেখানে শিবাজি, সাভারকর প্রমুখের ছবি এনে বসানো হয়েছে। ভারতের বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, ডাকটিকেটে শিবাজি, সাভারকরের ছবি এনে বসানো হোক, কিন্তু নেহেরু, ইন্ধিরা গান্ধীর ছবি মুছে ফেলা হবে কেন? এটাতো ইতিহাস বিকৃতি। এখন শুধু ইতিহাস বিকৃতি নয়, ইতিহাসের বিরুদ্ধেই যুদ্ধযাত্রা করেছে মোদি সরকার। ভারতের মুসলিম আমলের বিভিন্ন স্থানের নাম ঔরঙ্গাবাদ, আফজলনগর, ফতেহাবাদ ইত্যাদি নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিছুকাল আগে হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করেছিল দিল্লীর কুতুবমিনার এবং আগ্রার তাজমহলও প্রাচীনকালের হিন্দু রাজাদের দ্বারা তৈরি। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতে বিদেশী পর্যটকদের দর্শনীয় স্থানের তালিকা থেকে তাজমহলের নাম বাদ দেয়া হয়েছিল। তাজমহল প্রতিবছর বিদেশী পর্যটকদের কাছ থেকে কত কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, এটা বোঝার পর মোদি সরকারের ভ্রম ভাঙ্গে। ধর্মান্ধতা, তা যে ধর্মেরই হোক, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার তা আমরা পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের রাজত্বকালে দেখেছি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ময়মনসিংহের নাম বদল করে রাখা হয়েছিল মোমেনশাহী। এভাবে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের, সীতাকু- ইত্যাদি স্থানের নামের মুসলমানিকরণ হয়েছিল। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর নাম করার চেষ্টা হয়েছিল ইমামগঞ্জ। মুসলিম লীগের রাজাদের ইতিহাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধযাত্রা সফল হয়নি। এই পুরনো নামগুলো তারা উচ্ছেদ করতে পারেনি। পুরনো নামগুলো আবার ফিরে এসেছে এবং মুসলিম লীগ শাসনের শোচনীয় পতন ঘটেছে। ভারতে মোদি সরকার এখন দেশের গোটা ইতিহাসের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু করেছে। সম্প্রতি এক রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের স্কুল-কলেজে ইতিহাসের বই থেকে মহিশূরের অধিপতি টিপু সুলতানের নাম মুছে ফেলবে। এ জন্য তারা যুক্তি দেখিয়েছে টিপু সুলতান অত্যাচারী শাসক ছিলেন। টিপু সুলতানকে হত্যা করার পর বাংলার নবাব সিরাজের মতো ইংরেজেরা তার চরিত্রে যে কলঙ্ক ছড়িয়েছিল, সেগুলো মিথ্যা প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকার ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার অন্যতম বীরযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। ইতিহাসের কিংবদন্তি পুরুষ টিপু সুলতানের নাম ও কর্মকা- ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু পারবে কি? কম্যুনিস্টরা রাশিয়ায় ক্ষমতায় বসার পর ঐতিহাসিক শহরগুলো যেমনÑ পিটারগ্রেড, পিটার্সবার্গ ইত্যাদির নাম লেনিনগ্রাড, স্ট্যালিনগ্রাড রেখেছিল। কম্যুনিস্ট শাসনের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো নামগুলো ফিরে এসেছে। স্ট্যালিন ক্ষমতায় এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস বদলে ফেলে তার গৌরব গাথায় পূর্ণ করেন। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কম্যুনিস্ট নেতারাই সেই ইতিহাস পুড়িয়ে ফেলে আবার প্রকৃত পূর্ব ইতিহাসে ফিরে যান। এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ... দানবের মূঢ় অপব্যয়। গ্রন্থিতে পারে না কভু ইতিহাসে শাশ্বত অধ্যায়। মোদি সরকারও একদিন ক্ষমতা থেকে যাবে। তাদের মূঢ়তা ও ধর্মান্ধতা থেকেও ভারতের ইতিহাস মুক্ত হবে। কিন্তু তাদের শাসনে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার নামে তারা যা করে গেল, তা শুধু গান্ধী-নেহেরুর হাতে গড়া আধুনিক ভারতেরই ক্ষতি করবে না; ভারতের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও অন্ধ বিশ্বাস ও গোঁড়ামি ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের সর্বনাশ করে যাবে। এই সর্বনাশ থেকে ভারত কতদিনে মুক্ত হতে পারবে, তা বলা মুশকিল। আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারত হিসেবে দেশটি বিশ্বসভায় যে নেতৃত্ব অর্জন করতে যাচ্ছিল, সেই নেতৃত্ব থেকে ভারত বঞ্চিত হবে। মিসরের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট নাসের ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মিসরের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে ব্রিটেনের নাম বাদ দেবেন। তখন তার এক উপদেষ্টা তাকে বলেছিলেন, মিসরের ইতিহাস থেকে ব্রিটেনের নাম বাদ দেয়া হলে ব্রিটেনের কোন ক্ষতি হবে না। কেবল মিসরের স্কুল-কলেজের ছাত্ররাই মূর্খ হয়ে থাকবে। বিশ্বের ইতিহাস-ভূগোল সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করবে না। নাসের তার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করেছিলেন। বিজেপির মোদি সরকার যে ভারত গড়তে চাইছে, তা বিশ্বের আধুনিক অগ্রসরমান উন্নত দেশগুলোর সমকক্ষ দেশ নয়। তারা গড়তে চাইছে অন্ধকার অতীতে মুখ ফেরানো একটি দেশ। আমার ধারণা, ভারতের সচেতন মানুষ তা মেনে নেবে না। আমেরিকার ট্রাম্পের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদে নির্ভর করে মোদি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। বিশ্বের বাস্তব অবস্থা হয়তো অনুধাবন করতে পারছেন না। তাই ইতিহাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিশোধ বড় ভয়ঙ্কর। আজ হোক কাল হোক মোদি সরকারকেও ইতিহাসের আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। [লন্ডন, ২৬ নবেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৯]
×