ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডিগনিটি বক্স

প্রকাশিত: ১৩:০৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডিগনিটি বক্স

অপরাজিতার যাত্রা শুরু কিভাবে? পেছনের গল্প জানতে চাই নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা আমাদের কাছে সব সময়ই একটি মারাত্মক দুঃশ্চিন্তায় বিষয় ছিল। স্বাস্থ্যের প্রতি তাঁদের এই অবহেলা থেকে পরিত্রাণ দিতে কিভাবে অবদান রাখতে পারে সেই ভাবনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের মূল সংগঠন ‘জীবন’-এর স্বতন্ত্র শাখা অপরাজিতার। অপরাজিতার যাত্রা শুরু মূলত নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলা করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দৃঢ় সঙ্কল্প থেকে। পার্বত্য জনপদের দুর্গম এলাকার নারীদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই কাজ করতে অপরাজিতার মতো সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। অপরাজিতা বর্তমানে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কী কী বিষয় নিয়ে কাজ করছে? নারীদের স্বাস্থ্যের প্রতি যতœশীল করে তুলতে সংগঠনটি ইতোমধ্যে মাসিক সম্পর্কে সচেতনতা, মাসিক নিয়ে কুসংস্কার প্রতিরোধ, মাসিককালীন স্বাস্থ্যের যতেœ করণীয়, স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভিন্নধর্মী কর্মসূচী পরিচালনা করছে। আমরা চাই, নারীরা বিশেষ করে আমাদের কিশোরীরা একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠুক। আমরা কৈশোর কর্মশালা আয়োজন করছি এবং আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার, যেসব ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা সচরাচর কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে সেসব ব্যাপারে তাদের বিভ্রান্তি দূর করতে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষার সুযোগ রয়েছে সেখানে শিক্ষার্থীদের পরস্পরের সমস্যাগুলো সহজ ও স্বাভাবিকভাবে নেয়ার জন্য তাদের উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি মুক্তালাপের আয়োজন করছি। অপরাজিতা শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মাসিকবান্ধব টয়লেট স্থাপনে গুরুত্বারোপ করছে। আমাদের সংগঠন এর পক্ষ থেকে একটি উরমহরঃু ইড়ী দেয়া হয় যেটাতে স্যানিটারি প্যাড, লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ, টাওয়েল, অন্তরবাস থাকে। ডিগনিটি বক্স এর মাধ্যমে নিশ্চিত করছে স্যানিটারি প্যাডের সহজলভ্যতা। একজন শিক্ষার্থী যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হতে পারে সে জন্যই এই পদক্ষেপ। পুরুষদের বিশেষভাবে ছাত্রদের প্রতি মাসিক ও বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তনগুলোকে স্পষ্ট করতে অপরাজিতার রয়েছে নিজস্ব গবেষণা কর্নার। একজন শিক্ষার্থীর কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপন করতে নিরলসভাবে তথ্য উপাত্তের পরিবেশনের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হয় অপরাজিতার গবেষণায় নিয়োজিত প্রত্যেক সদস্যকে। ঠিক কি জিনিসগুলো আপনাকে এমন সামাজিক কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করল পার্বত্যাঞ্চলে এক দশক রক্তদান নিয়ে কাজ করার সুবাদে জানতে পারি, এই জনপদের মানুষজন স্বাস্থ্যের প্রতি খুবই উদাসীন। নারীদের ব্যাপারে এই উদাসীনতা আরও ভয়াবহ! নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাটুকুও নেই তাঁদের। পাহাড়ী জনপদের প্রায় সব গৃহস্থালির কাজে নারীদের সরাসরি সম্পৃক্ততা, এমতাবস্থায় একজন নারী তার মাসিককালীন সময়ে নিজের স্বাস্থ্যের কোন বিশেষ যতœই নেন না। অনেকেই ব্যবহার করেন না স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড বা পরিষ্কার কাপড়। অস্বাস্থ্যকর উপায়ে ঋতু¯্রাব ঠেকাতে তারা নিজেই নিজেকে ঠেলে দিচ্ছেন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। যেহেতু মায়েরাই সঠিক পরিচর্যার নিয়ম জানেন না, তাদের সন্তানেরা তাই বঞ্চিত হয়ে থাকে এই গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকে। এই অজ্ঞতাই পার্বত্যাঞ্চলের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। রক্তদানের সংগঠন জীবন থেকে আমরা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। আর তাই এই বিশ্বাসের জায়গা কাজে লাগিয়ে আমরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শাখা ‘অপরাজিতা’ সৃষ্টির মাধ্যমে নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্বাস্থ্যসেবা তার ওপর আবার স্পর্শকাতর হওয়ায় সবার আস্থা অর্জন জরুরী ছিল। স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে পরামর্শ ও ভিন্নধর্মী কর্মশালার আয়োজন এর পাশাপাশি নিরাপদ স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করে যাচ্ছি। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের মাঝেও পর্যায়ক্রমে এই প্রকল্পটি বিস্তার লাভ করছে। কৈশোর কর্মশালার আয়োজন ও মাঠ পর্যায়ে চলছে বিভিন্ন কর্মকা-। নারীদের মাসিক ছোট করে দেখার মতো কিংবা অবহেলার বিষয় নয়। পুরুষেরা প্রায়শই বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে নেয়। কুসংস্কার এবং সঠিক স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে কিশোরী বয়স থেকেই অনেক মেয়ে নিজের যতœ নিতে পারে না। জরায়ু ক্যান্সার কিংবা স্থায়ী ব্যন্ধত্ব হতে পারে অসচেতনতার চরম পরিণতি। তাই বয়ঃসন্ধি, মাসিক এবং আত্মরক্ষামূলক শিক্ষার প্রসার করছি আমরা। ট্যাবু ভাঙতে গিয়ে কীরকম ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন? ?সংগঠনটির পথচলা খুব বেশি সময় নয় তবে ইতোমধ্যেই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠের প্রায় ২৫০০ শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতার বার্তা সফলভাবে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি আমরা। আমরা সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছি তা হলো মাসিক, বয়ঃসন্ধির মতো স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে এক ধরনের অস্বস্তিবোধ ও জড়তা কাজ করে সকলের। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেখানে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে সহশিক্ষা গ্রহণ করে সেখানে অনুমতি পেতেও বেশ কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। যদিও অপরাজিতার গবেষণা কর্নার থাকায় আমরা ব্যাপারগুলোকে খুব আকর্ষণীয় ও সহজভাবে উপস্থাপন করায় এখন সকলের সহযোগিতা পাচ্ছি। আরেকটি সমস্যা যেটা প্রায়শই আমাদের মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে পর্যাপ্ত সময়। কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য বেশি সময় দিতে চান না। একটি কর্মশালা পরিচালনা করতে এবং সেই কর্মশালায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে ন্যূনতম দুই ঘণ্টাব্যাপী একটি ধারাবাহিক কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হয় আমাদের অথচ আমাদের অনেক কম সময়ে শেষ করতে নির্দেশনা দেন অনেকে। নিজের সংগঠন নিয়ে আগামী দিনের পরিকল্পনা দিনশেষে আমাদের লক্ষ্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। আমরা যে লক্ষ্যমাত্রাকে অর্জনের সঙ্কল্প হাতে নিয়েছি তার মধ্যে রয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩, ৪, ৫, ৬, ১০ ও ১৭। ২০২৫ সালের মধ্যে রাঙ্গামাটিতে লক্ষমাত্রা অর্জন করার ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পাহাড়ের গ-ি পেরিয়ে দেশব্যাপী সংগঠনের পরিধি বিস্তারের ব্যাপারে আগ্রহ আছে আমাদের। আগামী বছর অন্তত দশ হাজার নারীকে জনকে স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা আছে।
×