ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ রাজনীতিবিমুখতা ও রাজনীতিমুখিতা

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

সিডনির মেলব্যাগ ॥ রাজনীতিবিমুখতা ও রাজনীতিমুখিতা

বঙ্গবন্ধু তাঁর সুচিন্তা ও দূরদর্শিতায় দেশের যুবসমাজকে জাগিয়ে তোলা এবং দেশের কাজে লাগানোর জন্য যুবলীগ গঠনের পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমাদের ভেতর যাদের সে সময় মোটামুটি বুদ্ধি হয়েছিল, আমরা দেখেছি যুবলীগ তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি তেমন। সময়ও পায়নি। তার আগেই তাদের নেতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সে যুবলীগ তারপর আর কোনদিন তার স্বমহিমায় ফিরে আসতে পারেনি। পরপর বেশ ক’বার দেশ শাসনে আসার কারণে দেশ এখন আওয়ামীময়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব দল এবং দেশকে এমন জায়গায় এনেছে যে, মানুষ তাঁকে ছাড়া কাউকে ভাবতে পারে না। সে পরিবেশেও যুবলীগ একের পর এক দুর্নাম আর কাহিনী তৈরি করে চলেছে। এই ক’দিন আগেও যুবলীগ প্রধান এবং নেতাদের কর্মকা- মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। উপাচার্য থেকে দলের কর্মী সবাই পড়েছেন তোপের মুখে। সে অবস্থায় শেখ হাসিনা কঠোর ভূমিকা নিয়ে পরিবেশ অনুকূলে এনেছেন এবারও। যুবলীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা ছিল জরুরী। তিনি এমন একজনকে এনেছেন যিনি পড়াশোনাসহ তাঁর ক্যারিয়ারে উজ্জ্বল। বিদেশে লেখাপড়া ও অধ্যাপনা করার অভিজ্ঞতাপুষ্ট পরশ বলেছেন, রাজনীতিবিমুখতাকে তিনি রাজনীতিমুখী করবেন। কিভাবে করবেন, কতটা পারবেন তা এখনই বলা মুশকিল। তবে তিনি নিশ্চয়ই জানেন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সমাজ। এখন কে কাকে মারছে, কেন মারছে বা কে মাদক খায়, কে বেচে, সব মিলেমিশে একাকার। সবাই চায় দেশ ভাল চলুক। শান্তি আসুক। সবাই এও চায় নেশা দূর হোক। তবে যেভাবে চায় সেভাবে হয়নি, হয়ও না। একমুখী রাজনীতি যতই ঢোল বাজাক উন্নয়ন ও প্রগতি এখন মুখোমুখি। এভাবে মানুষ মারা কোন সমাজ অনুমোদন দেয় না। দেশ বা জাতির জন্য টেকসই উন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত শান্তি ও নিরাপত্তা। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার দিকটা যেমন প্রকাশ্য, তেমনি এর অনিরাপদ জীবন বা নিরাপত্তাহীনতাও এখন গোপন কিছু নয়। এটা মানতে হবে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা সন্দেহাতীত। সরকারে এমন কিছু মন্ত্রী আছেন যাদের সততা ও নিষ্ঠা প্রমাণিত। সবচেয়ে বড় কথা দেশের মেধাবী ও পরিশ্রমী মানুষের কৃতিত্বে আজ আমরা এগিয়ে চলেছি। যারা সবসময় নেগেটিভ বা দেশ ও সমাজের ভাল কিছু দেখতে পান না, তাদের চোখেও এখন সর্ষে ফুল। কিন্তু ওই যে বললাম শান্তি ও নিরাপত্তা, সে প্রশ্নে মাঝে মাঝেই হুমকি এবং প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ জননিরাপত্তা। যেভাবেই হোক প্রায়শ এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যা সবার জন্য অস্বস্তিকর। মানুষের জীবনের চাইতে বড় কোন সম্পদ নেই। দেশের নাগরিক সাধারণ মানুষ বা যাদের আমরা আমজনতা বলি, তারা কিন্তু শান্তি বা নিরাপত্তা ব্যতীত কোন উন্নয়নের তোয়াক্কা করে না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় তারা কি চায়। দেশের মানুষের মনে এখন নিরাপত্তাহীনতার যে সংশয় তা কিন্তু অলীক কিছু নয়। ক’দিন পর পর হত্যা, রাজপথে লাশ স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত করার জন্য রক্তপাত কারও জন্য মঙ্গলের কিছু নয়। সরকারের যত অর্জন বা যত ধরনের সফলতা থাকুক, এ দিকটা ঠিক না হলে তাদের মূল্যায়ন করবে না মানুষ। বরং অসন্তোষ আর হতাশা একদিন এত বড় হয়ে দাঁড়াবে যে, সামাল দেয়াই মুশকিল হয়ে যাবে। এসব অকল্যাণ বা অসুন্দরের পেছনে যত বড় অশুভ শক্তির হাত থাকুক তাকে বাগে আনতেই হবে। এ দায়িত্ব সরকারের। যেসব দেশে মানুষ নিরাপদ জীবনযাপন করে বা যে সমাজে মানুষ মানুষের মতো বাঁচতে পারে, তাদের হাতে আলাদা কোন ম্যাজিক নেই। তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি আইনের শাসন। আমাদের দেশে আইনের শাসন আছে কি নেই সে তর্কে না গিয়েই বলব অপরাধের সঠিক বিচার নেই। এ লেখা যখন লিখছি টিভিতে মিডিয়ায় রানা প্লাজা দুর্ঘটনার তিন বছর পূর্তির আয়োজনে মায়াকান্নার বহর দেখছিলাম। মায়াকান্না এ কারণে যে, মানুষগুলো এখন ধুঁকছে, যাদের এখনও জীবন আছে; কিন্তু পরিশ্রমের সামর্থ্য নেই। যারা পঙ্গু বা অচল যাদের জীবনের স্বাভাবিকতা কেড়ে তাদের অথর্ব অচল করে রেখেছে রানা প্লাজা। তাদের আসলে খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই। গরিব নিম্নবিত্ত এই মানুষরা চ্যানেলগুলোর একটা ট্যালেন্ট শো বা গানের প্রতিযোগিতার টাকায় বেঁচে যেতে পারে। দেশে এত এনজিও, এত প্রতিষ্ঠান, এত সরকারী ও আধাসরকারী সহায়তার গালগল্প, যে কেউ পাশে দাঁড়ালেই হয়ে যেত। আমরা সেদিকে মনোযোগী নই। মনোযোগ দেয়ার সময় নেই কারও। সময় হচ্ছে দিন-তারিখ মনে রেখে প্রচার আর মায়াকান্নার ধুম। এক ভদ্রলোক তো এমন অভিযোগ করলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আদেশের পরও তার কাছে অনুদানের টাকা যায়নি। এরা কারা? কারা আদেশ-নির্দেশ অমান্য করে খেয়াল-খুশিমতো কাজ করে? কারও আদেশ মানে না? এদের কারণেই আজ আমাদের ডলার ফিলিপিন্সে পাচার হয়ে এক অনিশ্চয়তার এবং ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে। এদের কারণেই দেশে এত খুন, এত হানাহানি। কথাটা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। কারণ এরা কোনদিন শাস্তি পায়নি। অপরাধ করে নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ানো এরা এখন পাপ বা মানুষ খুনের পর হেলিকপ্টারে উড়ে বেড়ায়। রানা প্লাজার ঘটনার কয়েক বছর পর আমরা কেউ খবর রাখি না অপরাধী রানা এখন কোথায়? তাকে শাস্তি দেয়ার চাইতে আমাদের আগ্রহ হতভাগ্যদের নিয়ে আবেগপ্রবণ কয়েক ঘণ্টা পার করা। এ প্রবণতা সবকিছুতে দৃশ্যমান। ক’দিন হৈচৈ বা মাতমের পর আবার যে কপাল সেই মাথা। এ সরকারের আমলে আমরা এর ব্যতিক্রম কিছু দেখতে চেয়েছি। তার যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে বৈকি। কোন সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার কথা বলে, যখন আমরা দেখি তারাই এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান দল, স্বাভাবিক কারণেই তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা বাড়ে। সে আশার দিকটা এখন ঝাঁকুনির মুখে। এটা যতটা সরকারের দোষ, তারচেয়ে বেশি রাজনীতির। মানুষের জীবনে বন্ধ্যাকরণ যেমন সন্তানহীনতার জন্য ঠিক, আবার জনসম্পদের দিক থেকে ভয়াবহ, তেমনি রাজনীতির বন্ধ্যাকরণ দেশ শাসনকে চ্যালেঞ্জহীন রাখলেও আখেরে তার ফলাফল বিষময়। এক সময় সে সরকারও জনগণকে মুখোমুখি করে তোলে। আমরা যদি আওয়ামী লীগের অতীত বিশ্লেষণ করি দেখব বহু দল ও মতের পরিচর্যা আর মোকাবেলাই ছিল তার বিশাল হওয়ার অনুপ্রেরণা। আজ সে জায়গাটা নানা কারণে বিপদের মুখে। এটা মানতেই হবে বিরোধী দলের ভূমিকাও জঘন্য। যানবাহন জ্বালিয়ে মানুষ মেরে বোমা সন্ত্রাসে বিরোধী দল আর যাই পাক জনসমর্থন পেতে পারে না। সেটা বোঝার পরও কোন দলের হুঁশ নেই। আজ তাই বাংলাদেশের জনগণ ও তারুণ্য রাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ। আন্তর্জাতিকভাবেও তারুণ্য এখন রাজনীতিবিমুখ। এতে ইন্ধন দিচ্ছে বিশ্বায়নের খোলা হাওয়া। আনন্দ ও জীবনযাপনের এত উপকরণ খোলা থাকলে রাজনীতির মতো বোরিং ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে মন দিতে যাবে কে? কিন্তু এক শ্রেণীর যুবক বসে নেই। তারা এটিকে এখন চাঁদাবাজি, টেন্ডার বা অসততার হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। সে জায়গাটাই আসলে উন্নয়নকে ঢেকে দিয়ে খুন জখম অস্থিরতার পথ খুলে দিয়েছে বা দিচ্ছে। সরকারের কাছে এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। সমাজ ও জাতির কাছে এটাই এখন জিজ্ঞাসা, কে বা কারা আসলে সামনে এসে দাঁড়াতে পারে? যাদের কাছে আমাদের আশা ও প্রত্যাশা পথ খুঁজে পাবে? কারা আমাদের হানাহানিমুক্ত, বিদ্বেষমুক্ত শান্তির বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবে, যার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলবে উন্নয়ন। অন্যথায় শুধু উন্নতি বা শুধু মারামারির একটাও দেশকে দেশের মতো রাখতে পারবে না। এটাই ইতিহাস ও পৃথিবীর শিক্ষা। আমরা যদি সত্যি আমাদের আর্থিক উন্নতি ও সামাজিক প্রগতিকে সামনে নিতে চাই, বাংলাদেশীদের পূর্ণ গণতন্ত্র বিষয়ে পাঠদানের বিকল্প নেই। এটা আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখানো আর চর্চার বিষয়। মানুষকে লেখাপড়া বা জ্ঞানের পাশাপাশি উদারতার দিকে নিয়ে যাবার বিকল্প নেই। সে কাজটা থমকে গেছে। ভয়ে বিহ্বলতায় বা নানা প্ররোচনায় কোন দল কোন রাজনীতিই সেটা করতে চাচ্ছে না। একা মিডিয়া বা সুশীল বা কোন সাংস্কৃতিক শক্তিও তা করতে পারবে না। এর জন্য চাই সবার সম্মিলিত উদ্যোগ। মানুষ কিন্তু চাইলেই পারে আর করেও। পহেলা বৈশাখেই তার পরিচয় দেখেছি আমরা। বাকিটা সদিচ্ছা আর দেশ ভাবনার ওপর নির্ভরশীল। যুবলীগ প্রধান একা এসব সামাল দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। দল ও কর্মীর পাশাপাশি অশুভ সব শক্তিকে মোকাবেলা করা আজ অত্যন্ত জরুরী। জরুরী দুর্নীতি, দুঃশাসন ও নৈরাজ্য দূর করা। আমরা সে আশায় থাকলাম। [email protected]
×