ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডঃ মিহির কুমার রায়

প্রধানমন্ত্রীর সমবায় ভাবনা, বাজার অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিতর্ক

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

প্রধানমন্ত্রীর সমবায় ভাবনা, বাজার অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিতর্ক

বিগত ২ নবেম্বর ২০১৯ ৪৮তম জাতীয় সমবায় দিবস উদযাপন ও জাতীয় সমবায় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পণ্যের অপচয় রোধ করে সহজে বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে সমবায়ের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের সীমিত জমিতে যা উৎপন্ন হয় তা অনেক ক্ষেত্রে মূল্যের যথাযথ সুযোগের অভাবে কৃষকরা প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় গ্রামীণ সমবায়কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে উৎপাদনের মূল্য কৃষকের অনুকূলে যাবে। আমরা কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে একটি সম্মানজনক স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছি। যেমন- সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থান, চাল উৎপাদনে চতুর্থ স্থান, আলু উৎপাদনে অষ্টম স্থান, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় স্থান, ফল উৎপাদনে দশম স্থান, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ স্থান ও বিশ্বের মোট ইলিশের উৎপাদনের ৮৩ শতাংশ হয় বাংলাদেশে। এই সকল সাফল্যের পেছনে যে সকল সহায়ক শক্তি রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সেচ এলাকা বৃদ্ধি (৭০ লাখ হেক্টর ), কৃষি উদ্যোক্তা ঋণ (৩৩,৪৩২ জন কৃষক), কৃষি সহায়ক কার্ড (২.১০ কোটি কৃষক), সেচ পাম্প (১২৫০ সৌরচালিত সেচ পাম্প স্থাপন), উৎপাদনমুখী প্রশিক্ষণ (৪১,৫০০ কৃষক, ২৮৮৬ উদ্যোক্তা, ৭০০ জন এনজিও কর্মী, ৩৮০ ব্যাংকার ও ২৮৪ সরকারী কর্মকর্তা, কৃষি তথ্যকেন্দ্র ২৫৪টি ও কৃষি খাতে শেষ আট বছরে বিনিয়োগ হয়েছে ৫৭৭৬ কোটি টাকা উৎস : প্রথম আলো প্রতিষ্ঠাবাষিকী সংখ্যা, ৪ নবেম্বর ২০১৯)। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, দেশের উন্নয়নে যুবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাটি, জল, বাযু ও পরিবেশের সমন্বয়ে সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামাঞ্চলের বাধ্যতামূলক উৎপাদনমুখী সমবায়ের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা যে সকল পণ্য উৎপাদন করছে সেগুলো তারা শিল্প কারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে যদি প্রক্রিয়জাতকরণ করা যায় তাহলে গ্রাম-বাংলা আর অবহেলিত থাকবে না। বিদ্যমান সমবায় আইনকে যুগোপযোগী করে সমবায় ব্যাংককে কার্যকর করতে হবে এবং বর্তমান যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে সমবায়ের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, সমবায় হলো একটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র, উৎপাদন, সুশাসন, আন্দোলন, চেতনা ও আদর্শ। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন কতর্কৃ আয়োজিত সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ১৯৭২ সালে ২৬ মার্চ জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা উপলক্ষে কর্মসূচীতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পাঁচ বছরের প্ল্যানে দেশের ৬৫ হাজার গ্রামে বাধ্যতামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠিত হবে। বর্তমান তিনি উন্নয়নে দর্শনে প্রাধান্য দিয়েছিলেন সমবায়কে। সেই সমবায় ভাবনাকে পাথেয় করে প্রধানমন্ত্রী বহুবিধ সমবায়বান্ধব কার্যক্রম নেয়ার প্রত্যয়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বা আশা বাস্তবায়নের সহযোগী কারা হবে- সরকার না জনগণ? যদি জনগণ হয় তবে তারাই সমবায়ের পতাকাটিকে বয়ে নিয়ে যাবে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে, যেখানে সরকার হবে সহযোগী। আর সরকার যদি সূচনা করে, তবে তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে তা বেড়ে উঠবে জনগণের সহযোগিতায়। বাংলাদেশের সমবায়ের ইতিহাসে দুটিরই উপস্থিতি পাওয়া যায় বিভিন্ন অবয়বে-ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলেও। এই অভিজ্ঞতার ফসলগুলো আমাদের গবেষণার খোরাক যোগাবে এবং বাড়তি নতুন প্রকল্প তৈরিতে সহায়তা করবে। যেমন দুস্তর কিংবা সমবায় কাঠামোর আদলে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচী, পল্লী দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচী, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে আবারও সমবায় আইনের সংস্কারের প্রসঙ্গটি উচ্চারিত হয়েছে। এর আগেও এই আইনের বিভিন্ন ধারার সংস্কার হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নেই যত সমস্যা দেখা দেয়, যাতে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দেশে প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির সমবায় (সমবায় অধিদফতর) ও কুমিল্লা পদ্ধতির সমবায় এই দুটি কেবল দাফতরিক নথিতেই সচল আছে তা বলা যাবে না, যদিও সরকারী দফতর হিসাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের চাকরির সকল সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষির রূপান্তরের যে সূচনা হয়েছিল বিশেষত সঞ্চয়ে বিপণনে ঋণ প্রদানে প্রশিক্ষণে সামাজিক পুঁজির বিকাশে, তা আর তেমনটি নেই। এখন সেই জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে অন্যান্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, যাদের বলা হয় (ঘমড়ং)। অথচ অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা ব্যবসায়িক সংগঠন হিসেবে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে সমবায়ের বিকল্প নেই। চায়নার কমিউন সিস্টেম, ইসরাইলের কিভোজ, রাশিয়ার স্টেট কিংবা কালেকটিভ ফার্ম, ভারতের সমবায় খামার, জাপানের কৃষিপণ্য বিপণন সমবায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবে যথেষ্ট অবদান রাখছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকারী পরিকল্পনা দলিলে ( ৬ষ্ঠ ও ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা) এর উপস্থিতি তেমন দৃশ্যমান নয়। আর মাঠপর্যায়ের কথা বাদই দিলাম। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনকে পলিসি সাপোর্ট দেয়ার জন্য ষাটের দশকে তদানীন্তন সরকার পাকিস্তান গ্রাম উন্নয়ন একাডেমি বার্ড মানে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার প্রায়োগিক গবেষণার ফসল কুমিল্লা মডেল (দু’স্তর বিশিষ্ট সমবায় পল্লী পূর্ত কর্মসূচী থানা সেচ কর্মসূচী থানা প্রশিক্ষণ উন্নয়ন কেন্দ্র) তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের আনুকূল্যে থানা পর্যায়ে তাদের পরিকাঠামো বিস্তার করে সারা বিশ্বে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পরিবর্তীতে স্বাধীনতাত্তর বাংলাদেশে পল্লী উন্নয়নের জন্য এটাই ছিল সরকারী পর্যায়ে একমাত্র কার্যক্রম। সময়ের আবর্তে পল্লী পূর্ত কর্মসূচী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) দু’স্তর বিশিষ্ট সমবায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড রিআরডিবি থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র টিটিডিসি এবং থানা সেচ কর্মসূচী টিআইপি সরকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে বিআরডিবি দু’স্তর বিশিষ্ট সমবায় বাস্তবায়নে নিয়োজিত ছিল এবং এখনও আছে। প্রতিটি থানায় (বর্তমানে উপজেলায় ) থানা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ এ্যাসোসিয়েশন (টিসিসিএ), যা গ্রাম সমবায় সমিতির (কেএসএস) থানা পর্যায়ে ফেডারেশন, সমবায় সংগঠনের কাজ করে যাচ্ছিল এবং সমিতির চেয়ারম্যান মডেল ফার্মার ও ব্যবস্থাপকগণ প্রতি মাসে আসতেন থানা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। সেই সমবায়ের আয়োজন সে সময়ে কৃষি উন্নয়নে একটি গতিশীল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল বিশেষ করে উফশী ধান সম্প্রসারণে। কিন্তু আশির দশকে যখন বাজার অর্থনীতি আত্মপ্রকাশ করতে থাকে তখন থেকেই কাজ করার সামাজিক আচরণগুলো বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে এককেন্দ্রিকতা (বঃযহড়পবহঃৎরংস) সমবায়ীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে নির্বাচিত নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় বসেই একটি ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে নিয়োজিত বিশেষত পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণের সুদ মওকুফ, যার আওতায় সমবায়ীরা না আসায় আন্দোলনের মুখে সমবায় সমিতিগুলো তাদের নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে সমবায়ীদের প্রদেয় সোনালী ব্যাংকের নয় শ’ কোটি টাকা আটকে যায়। যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না হওয়ায় দু’স্তর বিশিষ্ট সমবায় কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। কৃষকরা নিয়মিত থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা বন্ধ করে দেয় এবং চোখের সামনে একটি জীবন্ত কর্মসূচীর পতন ঘটে শুধু একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে। সমসাময়িক সরকারগুলোও তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা (৬ষ্ঠ ও ৭ম) সমবায়কে আর সেভাবে আনতে দেখা যায় না এবং পিআরএসপি (ঢ়ড়াবৎঃু ৎবফঁপঃরড়হ ংঃৎধঃবমু ঢ়ধঢ়বৎ) এর দলিল থেকে সমবায়কে বাদ দেয়া হয়েছে সম্পূর্ণভাবে। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে সমবায় সংগঠনকে আবার পুনর্জীবিত করার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে সমবায়কে ব্যবহার করে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত জাপানে এর সফল দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সফল উদ্যোক্তার প্রয়োজন, যারা অঞ্চলভিত্তিক কৃষি পণ্যের উৎপাদনের নিবিড়তা নিরিখে বিপণন সমিতি গড়ে তুলবে উৎপাদকদের সহযোগিতায়। উল্লেখ্য, কৃষি পণ্য বিপণনে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ফড়িয়া ব্যাপারি এক ধরনের (বীঢ়ষড়রঃধঃরাব) ভূমিকা পালন করে, যা কৃষকের স্বার্থে যায় না। সেই ক্ষেত্রে সমবায় সংগঠনের ভূমিকা জোরালো হতে হবে। দেশের উদ্যোক্তারা কৃষকদের দৃষ্টি সমবায়ের প্রতি ফেরাতে পারলে তা অনেকাংশে সম্ভব হবে, যদিও কাজটি যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। দেশে প্রতি বছর ব্যবসায় প্রশাসনে অগণিত ছাত্রছাত্রী স্মাতক ডিগ্রী নিয়ে বেরুচ্ছে এবং তারাই হতে পারে আগামী দিনের সমবায় আন্দোলনের সৈনিক ও কর্ণধার। বর্তমানে খামারবাড়ীতে অবস্থিত কৃষি বিপণন অধিদফতর সমবায় অধিদফতরের সঙ্গে একীভূত হয়ে কৃষি পণ্যের সমবায় বিপণন পদ্ধতি সারাদেশে চালু করতে পারে। বাংলাদেশের কৃষক লীগ, কৃষক ইউনিয়ন ও কৃষক আন্দোলন এ ব্যাপারে কৃষকদের সংগঠিত করে বিপণন ব্যবস্থাকে জোরদার করতে পারে। তাহলেই সোনার ফসলের মূল্য কৃষকের মুখে হাসি ফোটাবে এবং প্রধানমন্ত্রীর আশা পূরণ হবে এই বাংলায়। লেখক : ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভর্সিটি
×