ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে শব্দদূষণ কেড়ে নিচ্ছে শ্রবণশক্তি

প্রকাশিত: ১০:৪২, ২৫ নভেম্বর ২০১৯

  রাজধানীতে শব্দদূষণ  কেড়ে নিচ্ছে শ্রবণশক্তি

শাহীন রহমান ॥ মানুষের আস্তে কথা বলার মধ্যে যে মাধুর্য শব্দদূষণে দিন দিন তা হারাতে বসেছে। ভবিষ্যতে অন্তরঙ্গ আলাপই হয়তো হাঁকডাক করে করতে হবে। রাজধানী ঢাকায় এখন নিরিবিলি পরিবেশ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দীর্ঘক্ষণ ৬০ ডেসিবল শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। আর এক শ’ ডেসিবল শব্দে চিরতরে হারাতে পারে শ্রবণ শক্তি। অথচ রাজধানীতে শব্দের মাত্রা উঠছে ১০৭ ডেসিবল পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নীরব এই ঘাতকের সবর উপস্থিতি এখন রাজধানীর সর্বত্র। মানুষের স্বাস্থ্যহানির অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করছে এই শব্দদূষণ। তাদের মতে, প্রতিনিয়ত উৎকট শব্দে মানুষ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছে। অথচ সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সরকার প্রশাসন সবাই এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। তারা বুঝতে পারছে না সবার অজান্তেই এই নীরব ঘাতক মানুষের কত বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে এক নাগাড়ে বসবাস করতে করতে মানুষের মেজাজ ও স্বভাব খিটখিটে হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে অনেক সময় পারিবারিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত শব্দ যদি মানুষ দিনের পর দিন শুনতে বাধ্য হয়ে পড়ে তাহলে সেই শব্দের দূষণও অন্যান্য পরিবেশ দূষণের মতো মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। শরীর ও মনের মধ্যে এসবের তীব্র প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, আমরা যারা শব্দদূষণের শিকার হচ্ছি বা যারা উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত রয়েছে তারা সবাই এদেশের নাগরিক। অথচ বুঝতে পারছি না অজান্তেই কি ক্ষতি করছি পরিবেশ ও মানুষের। শুধু সরকারের দিকে না তাকিয়ে সবাইকে এর বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী বিশেষ এলাকা ভেদে শব্দদূষণের মাত্রা নির্ধারণ করা হলে তা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ খুবই কম দেখা যায়। কালেভাদ্রে পরিবেশ অধিদফতর থেকে এর বিরুদ্ধে কিছু অভিযান চালানো হলেও তা কোন কাজেই আসে না। পরিবেশ অধিদফতর এবং ওয়ার্ক ফর বেটার (ডব্লিউবিবি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর কোন পাবলিক স্থানের শব্দের মানমাত্রা ৬০ ডেসিবলের নিচে নেই। স্টামফোর্ডের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগও সম্প্রতি রাজধানীর কিছু এলাকায় শব্দদূষণের ওপর জরিপ চালিয়েছে। এতে দেখা যায় খোদ নীরব এলাকায় শব্দের মাত্রা ৭৫ থেকে ৯৭ ডেসিবল। অথচ নীতিমালা অনুযায়ী ওসব স্থানে থাকার কথা রয়েছে ৩৫ থেকে ৪৫ ডেসিবল। আবাসিক এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা রয়েছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২ গুণ বেশি। অপরদিকে বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড়গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে অসংখ্য সমস্যা বিদ্যমান থাকায় নীরব ঘাতক শব্দ দূষণ নিয়ে কেউ চিন্তাভাবনা করছে না। বেশিরভাগ লোক না বুঝেই প্রতিনিয়ত এ কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন না এতে পরিবেশের কতটা ক্ষতি হচ্ছে। রাস্তায় অযথা হর্ণ বা মাইক বাজিয়ে ক্যাম্পেন, উচ্চ আওয়াজে গান শোনাসহ ছোটখাটো অনেক শব্দদূষণ ব্যক্তি সচেতনায় বন্ধ করা যেতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এ বিষয়ে সচেতন নন। এটি রোধে এখন পর্যন্ত দেশে কোন আইন নেই। তবে একটি নীতিমালা রয়েছে। তার আলোকে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও তা কার্যকর নেই বললেই চলে। মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এর আওতায় শব্দদূষণ বিধিমালা অন্তর্ভুক্ত না থাকায় এ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। মাঠপর্যায়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মোবাইল কোর্ট আইনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০১০ থেকে ’১৫ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদফতর এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়ে শব্দ উৎপাদনকারী ১০৩ শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তারা বলছেন, মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। গাড়ির চাহিদা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে শব্দ দূষণও। ফলে দিনে দিনে এটি মহামারী আকার ধারণ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকস্মিক তীব্র শব্দে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘদিন মাত্রাতিরিক্ত শব্দের মধ্যে অবস্থান করলে কানে শোনার ক্ষমতা লোপ পায়, যা আর ফিরে পাওয়া যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্ব জনসংখ্যার ৫ শতাংশ শ্রবণজনিত সমস্যায় তাদের প্রাত্যহিক জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিন্ড ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এতে শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা তৈরি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি মানুষের দৈনন্দিন বিভিন্ন মাত্রার শব্দের মধ্যে অবস্থানের মানদন্ড নির্ধারণ করেছে। তাদের এই মানদন্ড অনুযায়ী একজন মানুষ যথাক্রমে ৯০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে আড়াই ঘণ্টা, ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ১৫ মিনিট, ১১০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ৩০ সেকেন্ড, ১২০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ৯ সেকেন্ড এবং ১৩০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে এক সেকেন্ডের কম সময় অবস্থান করতে পারেন। শব্দদূষণের ক্ষতির হাত থেকে জনসাধারণকে সুরক্ষা দিতে দেশে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এ এলাকাভেদে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে রাত-দিন ভেদে সর্বনিম্ন ৪০ ডেসিবল, সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবল শব্দ অনুমোদিত রয়েছে। এই নীতিমালায় ঢাকাকে পাঁচ এলাকায় ভাগ করে প্রতিটি এলাকার জন্য শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দিন-রাতের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দ হচ্ছে নীরব এলাকায় ৪৫ ও ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় ৫০ ও ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবল ও শিল্প এলাকায় ৭৫ ও ৭০ ডেসিবল। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে, নীরব এলাকা অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, উপাসনালয় রয়েছে এমন এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোন হর্ণ বাজানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫শ’ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে ইট বা পাথর ভাঙ্গার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না এবং সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত মিকচার মেশিনসহ নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্র বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে না। কোন ধরনের অনুষ্ঠানে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী কোন যন্ত্রপাতি দৈনিক ৫ ঘণ্টার বেশি সময়ব্যাপী ব্যবহারের অনুমতি দেয়া যাবে না এবং অনুমোদনের সময়সীমা রাত দশটা পেরোতে করবে না। অথচ ঢাকার কোথাও এই নীতিমালা মেনে কর্মকান্ড পরিচালনা করতে দেখা যায় না। এছাড়াও মোটর যান অধ্যাদেশ ’৮৩ এর ১৪০ ধারায় অপ্রয়োজনীয় হর্ণ বাজালে এক শ’ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু সীমাবদ্ধতার কারণে কাউকে কখনও এই বিধি মানতে দেখা যায়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন শব্দে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, সব ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশের জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত শব্দ। এছাড়া শব্দের কারণে চাপ তৈরি হয় এবং তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
×