ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইডেন টেস্টেও ইনিংসে হার বাংলাদেশের সিরিজ জিতল ভারত

প্রকাশিত: ১০:৪১, ২৫ নভেম্বর ২০১৯

 ইডেন টেস্টেও  ইনিংসে হার বাংলাদেশের  সিরিজ জিতল ভারত

মিথুন আশরাফ, কলকাতা থেকে ॥ বাংলাদেশকে ইনিংসে হারাতে পারলেই বিশ্বরেকর্ড গড়বে ভারত। ইতিহাস গড়বে। সেই ইতিহাসটি আবার প্রথমবারের মতো গোলাপী বলের দিবারাত্রির টেস্টে খেলেই হবে। হলোও তাই। যেমনটি ভাবা হয়েছিল, হলো তেমনটিই। গোলাপী বলে ধাঁধায় পড়ে এমনই করুণ অবস্থা হয়েছে বাংলাদেশ দলের, ইনিংসে হেরেছে। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে দ্বিতীয় টেস্টে সোয়া দু’দিনেই শেষ হয়ে গেল। ইনিংস ও ৪৬ রানে হারল বাংলাদেশ। ভারত টেস্ট ইনিংসে জিতে টানা চার টেস্টে ইনিংসে জেতার ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশকে ইনিংসে হারিয়ে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশও করেছে। দ্বিতীয় দিন যখন ৮৯ রানে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ, হাতে চার উইকেট, তখনই আসলে ইনিংস হারের আলামত স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথম ইনিংসে ভারতের ৩৪৭ রানও দুই ইনিংস মিলিয়ে করতে পারবে না, ভাবা হয়েছে যা, তাই হয়েছে। প্রথম ইনিংসে ১০৬ রানে অলআউট বাংলাদেশ দল দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯৫ রানে গুটিয়ে যায়। দুই ইনিংস মিলিয়ে ভারতের চেয়ে ৪৬ রান কম করে। তৃতীয়দিন তো ৪৭ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের বেশি খেলতেই পারেনি বাংলাদেশ! দুই ইনিংস মিলিয়ে আবার ৭১.৪ ওভারের বেশি খেলতেও পারেনি। সেই হিসেবে বাংলাদেশ তো একদিনও দুই ইনিংস মিলিয়ে টিকতে পারেনি। কারণ, একদিনে ৯০ ওভারের মতো খেলা হয়। বাংলাদেশ তাও খেলতে পারেনি। মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে ছিল অনেক আশা। তিনি অন্তত ইনিংস হার থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাবেন। কিন্তু সেঞ্চুরির আশা তৈরি করে, বাংলাদেশকে ইনিংস ব্যবধানে হার থেকে রক্ষা করার সম্ভাবনা তৈরি করেও পারেননি মুশফিক। ৭৪ রান করে আউট হয়ে যান। মুশফিক আউট হতেই বাংলাদেশের ইনিংস হারও যেন নিশ্চিত হয়ে যায়। নিজে অপরাজিত ৫৯ রান করে দলকে ১৫২ রানে নিতে গিয়ে দ্বিতীয়দিন শেষ করেন মুশফিক। তখন ৮৯ রানে পিছিয়ে বাংলাদেশ। মুশফিক যদি তৃতীয়দিনেও হাল ধরতে পারতেন, তাহলে ইনিংস হার এড়ানো আসলে কোন বিষয়ই ছিল না। কিন্তু মুশফিক শুরু থেকেই এমন আত্মঘাতী শট খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সবাই তখন ভাবতে থাকেন, কেন এমন করছেন? ইশান শর্মার গতি আর বাউন্সে একের পর এক ব্যাটসম্যানরা যখন আহত হচ্ছেন, আউট হচ্ছেন। সেই ইশান দুই টেস্ট মিলিয়ে ১২ উইকেট নিয়ে সিরিজ সেরা হয়েছেন। ইডেন গার্ডেনে দ্বিতীয় টেস্টে বাউন্সের পর বাউন্স দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের আতঙ্ক বাড়িয়ে দেন তিনি। তার বলে একধাপ এগিয়ে গিয়ে খেলতে যান মুশফিক। উল্টাপাল্টা শটও করতে থাকেন। দ্বিতীয়দিন যেখানে বুক চিতিয়ে একাই লড়াই করেন, বীরত্ব দেখান, সেখানে তৃতীয়দিন ভিন্ন এক মুশফিকের দেখা মেলে। দল বাঁচাবেন কী, নিজেই যেন দ্রুত মরতে চান! ঠিক এমন করেই দলের ১৮৪ রানের সময় উমেশ যাদবের অফসাইডের বাইরের বল শট করতে গিয়ে কাভারে ক্যাচআউট হয়ে যান মুশফিক। তখন ইনিংস হার এড়াতে ৫৭ রান বাকি ছিল। মুশফিক উইকেটে থাকলেই হয়ত তা হয়ে যেতে পারত। তাতে প্রাপ্তি খোঁজা যেত। কিন্তু মুশফিক তো যেন আউট হতেই পাঁয়তারা শুরু করেন। সেঞ্চুরি করতে পারতেন। তা হলে ‘স্ট্যান্ডিং’ করতালি মিলত। ম্যাচে হার-জিতের চেয়ে মুশফিককে নিয়ে সবাই আলোচনা করতেন। কিন্তু একটি ভুল শটেই মুশফিক নিজে ডুবলেন, দলকেও ইনিংস হার থেকে রক্ষা করতে পারলেন না। মুশফিকই একমাত্র ভরসা হয়েছিলেন। এবাদত হোসেন, আল আমিন হোসেন, আবু জায়েদ রাহীরা কী আর ম্যাচ বাঁচানোর মতো ব্যাটসম্যান? তারা তো বোলার। এরপরও আল আমিন ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং করে ২১ রানের ইনিংস খেলেছেন। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে দ্বিতীয়দিন মাঠ ছাড়েন। তিনি আর নামতে পারেননি। দলের ১৯৫ রানে আল আমিন যখন আউট হন, তখন বাংলাদেশ গুটিয়ে যায়। ম্যাচ হারও নিশ্চিত হয়ে যায়। তৃতীয়দিনে উমেশ যাদবই চার উইকেট তুলে নিয়ে মোট ৫ উইকেট শিকার করেন। আর ইশান শর্মা প্রথম ইনিংসে পাঁচটি ও দ্বিতীয় ইনিংসে চারটি উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ ইনিংসকে ধসিয়ে দিয়ে ম্যাচের নায়কও বনে যান। প্রথমবারের মতো গোলাপী বলে দিবারাত্রির টেস্ট দুই দলই খেলেছে। ভারত ক্রিকেটাররা যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের এমন বেহাল দশা কেন হল? ভারতের সাবেক ব্যাটসম্যান ভিভিএস লক্ষন খুব ভালভাবে যুক্তি দিয়ে বিষয়গুলো পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একটি টেস্ট ম্যাচ জিততে কয়েকটি জিনিস লাগবেই। এক, টেস্ট জেতার মতো মানসিক দৃঢ়তা লাগবে। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী দল হলেও আগে থেকেই মুছড়ে পড়া যাবে না। দুই, টেস্ট জেতার মতো দল হতে হবে। তিন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, পরিস্থিতি অনুযায়ী পথ চলতে হবে।’ লক্ষন ঠিকই বলেছেন, বাংলাদেশের দুর্বলতাগুলো ভালভাবে ধরতেও পেরেছেন। ভারত শক্তিশালী দল। ইশান, শামি, যাদব, অশ্বিনদের মতো বোলারদের বিরুদ্ধে ব্যাটিং করতে হবে। আবার কোহলি, রোহিত, আগারওয়াল, পুজারা, রাহানেদের মতো ব্যাটসম্যানদের ঠেকাতে হবে। তা সম্ভব না। আবার ভারতের মাটিতেই খেলা। সেটি আবার দিবারাত্রির টেস্ট। গোলাপী বলে খেলা। যে বলকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। যে আলোচনাই ডুবিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা ভারতের সঙ্গে খেলতে হবে, এই ভেবেই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ব্যাটিংয়ে তাই বোঝা গেছে। ইশান, শামি, যাদবদের বলে ভয় পেয়েই আউট হয়ে গেছেন। তাছাড়া টেস্ট জেতা বা খুব ভাল করার মতো দলও খেলতে নামাতে পারেনি বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসান ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়ে আইসিসিকে না জানানোর অপরাধে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ। সেরা অলরাউন্ডার নেই। পারিবারিক কারণে ওপেনার তামিম ইকবালও নেই। দল তাই আগে থেকেই দুর্বল হয়ে পড়ে। টেস্টে পরিস্থিতি, উইকেট অনুযায়ী খেলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা তা করতে পারেননি। মুশফিকের আউটটিই যেমন। আবার টিম ম্যানেজমেন্ট যে টস জিতে আগে ব্যাটিং নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটাওতো ভুলই ছিল। গোলাপী বলে প্রথমবার খেলছে। আগে একটু পরিস্থিতি বুঝে নেয়া দরকার। তা না করেই আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এমন হলে কী আর টেস্টে ভাল করা সম্ভব? টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হকের কাছেও এমন বেহাল দশা হওয়ার কিছু কারণ ধরা পড়েছে। মুমিনুল বলেছেন, ‘আমার কাছে মনে হয় একটি দল হিসেবে আমরা ভাল খেলতে পারিনি। একটি জুটিও গড়তে পারিনি।আমরা কিন্তু টেস্ট সেভাবে খেলি না। আমার কাছে মনে হয় লাল বলের চেয়ে গোলাপী বলে খেলা বেশি চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে নতুন বলে চ্যালেঞ্জটি বেশি। আমরা যদি নতুন বলের ওই চ্যালেঞ্জটি নিতে পারতাম, আপনি দেখবেন যে শেষের দিকে যখন শিশির পড়া শুরু হয়েছিল তখন থেকে বিষয়গুলো সহজ হয়ে গিয়েছিল। চ্যালেঞ্জ নিতে পারিনি, সেই কারণে আমরা পিছিয়ে গেছি। পরাজিতরা অজুহাত দেয়, তবে আমি দিচ্ছি না। ভারতও কিন্তু কখনও খেলেনি গোলাপী বলে। আমরাও খেলিনি। তো এভাবে (টস) চিন্তা করলে সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। সিদ্ধান্ত খুব ঠিক ছিল। ইতিবাচকভাবে দেখলে আমি আমার জায়গায় ঠিক।’ সঙ্গে মুমিনুল যোগ করেন, ‘মানসিকভাবে একটু পরিবর্তন হতে হবে আমাদের সবারই। যুদ্ধ করার জন্য যে মানসিকতা, সেটা উন্নতি করতে হবে।’ বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা পারবে মানসিকতায় উন্নতি করে টেস্টে ভাল কিছু করতে? বছরের শুরুটা হয়েছিল নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইনিংসে হার দিয়ে। বছরের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটিতেও ইনিংস হারই হলো। বছরটিতে পাঁচ টেস্ট খেলে সবটিতে হার হয়েছে। এরমধ্যে চারটি টেস্টেই ইনিংস হার হয়েছে। একটি টেস্টে যে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে হেরেছে বাংলাদেশ, সেটিতে লজ্জাও মিশে আছে। মানসিকতায় উন্নতি না করতে পারলে, ভুল থেকে শিক্ষা না নিতে পারলে, ভারতের বিরুদ্ধে যেমনটি হয়েছে, ইনিংস হারে হোয়াইটওয়াশ হওয়াই বারবার নিয়তি হবে বাংলাদেশের।
×