ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাচীন পেশা টিকে আছে নতুন যুগেও

শীত নামার আগেই তুলোধোনা শুরু, ছুটছে ধোনকার

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২৫ নভেম্বর ২০১৯

শীত নামার আগেই  তুলোধোনা শুরু,   ছুটছে  ধোনকার

মোরসালিন মিজান ॥ দৃশ্যটি মূলত গ্রামের। গ্রামেগঞ্জেই বেশি দেখা যেত। এখন দুর্লভ। তবে একেবারে দেখা যায় না, এমন নয়। বিশেষ করে শীত শুরুর প্রাক্কালে প্রায় প্রতিদিনই কমবেশি চোখে পড়ছে। রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে গুটি কয়েক লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে কাজের সন্ধানে। না, আর সব কাজের সঙ্গে তাদের কাজকে মেলানো যাবে না। ধোনকারদের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা। হ্যাঁ, ধোনকার নামেই পরিচিত তারা। আরও কিছু নাম আছে। একই কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ধুনারি, ধুনুরি, ধুনুরা বা ধুনক নামেও চেনেন অনেকে। অবশ্য চেনার কাজটিকে সহজ করে দেয় কাঁধের বেহালাটি। বেহালা বলতে, বেহালার মতো দেখতে একটি যন্ত্র। ধনুকের সঙ্গেও অনেক মিল। এ কারণে যন্ত্রটির প্রকৃত নাম ধুনট। কাঠ, বেত বা বাঁশের তৈরি ধুনট কাঁধে নিয়ে ধোনকাররা পাড়া-মহল্লা ঘুরে বেড়ান। ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখন। কাঁধ থেকে সামনের দিকে নেমে আসা লম্বা দ-টি ছাড়াও একটি বড় পুঁটলি বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। পুঁটলির ভেতরে তুলো। বিভিন্ন বাড়ির সামনে বসে তুলোধোনা করছেন তারা। তৈরি করছেন নতুন লেপ, তোষক, বালিশ। বহু ব্যবহারে পুরনো চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া লেপ, তোষকের তুলো বের করে এমন পেটাচ্ছেন যে, নতুন হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তেই। তার পর নতুন কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে সেলাই করছেন। সবই হচ্ছে চোখের সামনে। ধুনটযন্ত্র এবং কাজের একটি বর্ণনা দিয়েছেন ইতিহাসবিদ ছন শরীফ উদ্দিন আহমেদ। বর্ণনাটি এ রকম : ধুনটের শেষ প্রান্ত গরুর শুষ্ক পেশিতন্তু দিয়ে নির্মিত দড়ি দিয়ে শক্তভাবে আটকিয়ে রাখা হয়। ধুনটে রক্ষিত শক্ত রশির ক্রমাগত দ্রুত স্পন্দনের মাধ্যমে তুলো পরিষ্কার ও শোধন করে নেয়া হয়। রশির স্পন্দনের ছন্দ কাঠের তৈরি মাচু বা হাতলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কার্যপ্রক্রিয়া শুরু করে। তুলো, লেপ, তোষক প্রস্তুতের উপযোগী করার পর নক্সা ও আকার অনুসারে লেপ, তোষক, বালিশ, কুশন ইত্যাদি তৈরি করা হয়। জানা যায়, তুলোধোনার এই পেশা অনেক প্রাচীন। ধারণা করা হয়, মধ্যযুগ থেকে লেপ, তোষক, বালিশ, তাকিয়া ইত্যাদি তৈরি ও ব্যবহার জনপ্রিয় হতে থাকে। তুর্কী, পাঠান, মোগলরা এগুলো ব্যবহার করতেন। উনিশ শতকের ষাটের দশকে ঢাকার সিভিল সার্জন ছিলেন ওয়াইজ জেমস। একই সঙ্গে লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, সে সময় ধুনারিরা প্রতিদিন আট সের করে খুব উত্তম ধরনের তুলো এবং দশ থেকে বারো সের সাধারণ তুলোধোনা করতে পারত। তবে শীত পুরোপুরি বিদায় নিলে বিকল্প কাজ খুঁজতে হতো ধুনারিদের। তারা তখন ভিস্তি বা পাখা টানার কাজ করতেন। বর্তমানে অনেকেই লেপ, তোষক, জাজিম, বালিশ ইত্যাদি তৈরির দোকান দিয়েছেন। বাকিরা ছুটছেন বাড়ি বাড়ি। বর্তমানে ঢাকার অলিতেগলিতে চোখ রাখলে কাউকে না কাউকে ঠিকই পাওয়া যাবে। দুপুরের আগে আগে কিংবা বিকেলের দিকে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে লেপ সেলাই... বলে হাঁক দিচ্ছেন তারা। শনিবার রামপুরার রাস্তায় কথা হয় হোসেন মিয়ার সঙ্গে। সেই চেনা রূপে। বেহালাটি কাঁধে নিয়ে ছুটে চলছিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘বাপ দাদার ব্যবসা। তাই বাদ দিতে পারি না। আর কোন কাজও তো শিখি নাই। কী কইরা খাইমু?’ পেশা ছাড়ার প্রশ্ন কেন আসছে? জানতে চাইলে বেদনার ইতিহাসটি সামনে চলে আসে। সঙ্গে থাকা আরেক ধুনারি ফয়জুল বলেন, ‘আমাদের এখন আয় রোজগার নাই। সস্তায় বিদেশী কম্বল পাওয়া যায়। কমফোর্টার আছে। মানুষের টেকাও আছে। সমানে কিনে। আমাগোরে কাজ দেয় না। এই শীতটা তাও কোনরকমে চলে যাবে। পরে আবার খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হবে। এর পরও বাকি জীবন বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে চান বলে জানান তিনি। এর পর আর বোঝার বাকি থাকে না, প্রাচীন এই পেশা কী করে এতকাল টিকে আছে। টিকে থাক।
×