মিথুন আশরাফ, কলকাতা থেকে ॥ উমেশ যাদবের অফ সাইডের বাইরের বলটি কি জন্য যে শট করতে গেলেন মুশফিকুর রহিম। তা বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক, বর্তমান নির্বাচক কমিটির সদস্য হাবিবুল বাশার সুমনেরও বোধগম্য হলো না। ভারতের এমন শক্তিশালী বোলিংয়ের বিরুদ্ধে এক মুশফিকই সাহস জুগিয়ে ব্যাটিং করছিলেন। ইনিংস হার এড়ানোরও আশা দেখান। অথচ নিজের ৭৪ রানে মুশফিকের অহেতুক এক শটেই সব আশা শেষ হয়ে যায়। তিনি আউট হতেই বাংলাদেশের ইনিংস হারের পথও পরিষ্কার হয়ে যায়। ইনিংস ও ৪৬ রানে হারেও বাংলাদেশ। তাতে করে ভারত টানা চার ম্যাচে ইনিংস ব্যবধানে জিতে ইতিহাসও গড়ে। এর আগে যে কোন দলই এমনটি করতে পারেনি। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশও হয় বাংলাদেশ।
এটা কী হল ভাই? মুশফিক আউট হতেই হাবিবুলকে প্রশ্নটা করা হলো। তিনি হতাশ। মুখ তার ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠিক যেমনটি বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের মুখটাও হয়েছে। বাংলাদেশ সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রেস বক্সে আনাগোনা করা একমাত্র হাবিবুলই তাই তাৎক্ষণিক বলতে পারলেন, ‘ভারত অনেক শক্তিশালী দল। তাদের পেস আক্রমণ এতটাই শক্তিশালী যে কোন দলই কুলিয়ে উঠতে পারবে না। বাংলাদেশের সেখানে আবার কয়েকজন ক্রিকেটার নেই। যা হয়েছে তা থেকে এখন শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এমন হারে হতাশা তো থাকবেই। আমি হতাশ।’
হতাশ হওয়ারই কথা। ভারতে প্রথমবার পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে এসে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে বাংলাদেশ। ২-০ ব্যবধানে সিরিজে হেরেছে। দুই টেস্টেই আবার ইনিংস ব্যবধানেও হেরেছে। ইন্দোর টেস্টে ইনিংস ও ১৩০ রানে হারের পর ইডেন টেস্টেও ইনিংস হার হয়েছে। প্রথমবার দিবারাত্রির টেস্টে দুই দলই খেলতে নামে। বাজিমাত করে ভারতই। তা করারই কথা। দল অনেক শক্তিশালী। ব্যাটিং, ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে এখন পেস আক্রমণও যে তাদের বিশ্বসেরা হয়ে গেছে। কিন্তু ইডেন টেস্টে ইনিংস হার এড়ানো যেত। প্রথম ইনিংসে ১০৬ রানে অলআউট হওয়ার পর ভারত প্রথম ইনিংসে বিরাট কোহলির ১৩৬ রানে ৯ উইকেটে ৩৪৭ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। বাংলাদেশ থেকে ২৪১ রানে এগিয়ে থাকে ভারত। তখনই আসলে ভারতকে যে আর দ্বিতীয় ইনিংসে নামতে হবে না তা বোঝা হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে মুশফিক অসাধারণ ব্যাটিং করতে থাকেন।
বাউন্সে একের পর এক ব্যাটসম্যান আহত হচ্ছেন। ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন। আউট হচ্ছেন। মাথায় আর শরীরে আঘাত লাগা থেকে বাঁচাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেখানে মুশফিক বুক চিতিয়ে খেলতে থাকেন। ইশান্ত শর্মা, মোহাম্মদ শামি, উমেশ যাদবদের গতি, বাউন্স আর সুইংও মুশফিককে বিচলিত করতে পারেনি। দ্বিতীয়দিন দলকে ১৫২ রানে নিয়ে দিন শেষ করে মাঠ ছাড়েন। ৮৯ রানে পিছিয়ে থাকে বাংলাদেশ। নিজেও ৫৯ রান করে ফেলেন। মুশফিক যেভাবে দাপটের সঙ্গে ব্যাটিং করতে থাকেন তাতে ইনিংস হার এড়ানোর আশা তৈরি হয়ে যায়। ইনিংস হার এড়াতে তো ৮৯ রান করলেই হয়। দ্বিতীয়দিনই ৬ উইকেট হারানোয় তৃতীয়দিন উইকেট থাকে চারটি। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে দ্বিতীয়দিন স্বেচ্ছায় অবসর নেন, তিনি তৃতীয়দিন নামলে চার উইকেট হাতে থাকে। আর না নামলে তিন উইকেট হাতে থাকে। তার মানে মুশফিক যদি একটু বুঝে খেলেন, উইকেট আঁকড়ে থাকতে পারেন, তাহলেই ইনিংস হার এড়ানো খুবই সম্ভব। ভারত বোলাররা যেভাবে চাপ তৈরি করেছেন, তাতে ইনিংস হার এড়ানোই তো অনেক বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক দেখে সবাই অবাক। বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায় খেলা শুরু। তার আগেই স্টেডিয়াম ভরে যায়। সবারই জানা থাকে, যদি মুশফিক দ্রুতই আউট হয়ে যান তাহলে এক ঘণ্টায়ও খেলা শেষ হয়ে যেতে পারে। এই এক ঘণ্টার জন্য হলেও ঐতিহাসিক দিবারাত্রির টেস্টের সাক্ষী হতে হাজির হন ক্রিকেটপ্রেমীরা। তারা এসে মুশফিকের প্রতিটি রান নেয়ার সময় এমনভাবে করতালি দেন যেন মুশফিকের ব্যাটিংটাই দেখতে এসেছেন। তা হতেও পারে। কারণ ভারত যে দ্বিতীয় টেস্টটা সহজেই জিতবে তা সবারই জানা হয়ে গেছে। ঐতিহাসিক গোলাপি বলের দিবারাত্রির টেস্টে ভারতকে জয় দেখতে পারা, ভারত ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অনেক বড় ব্যাপারই। যারা তৃতীয়দিন স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখেছেন, তাদের ভাগ্যবানই বলতে হবে। তারা যে ইতিহাস গড়া টেস্টে ভারতের জয়ের সাক্ষী হতে পেরেছেন। তবে মুশফিক যদি তৃতীয়দিনও নিজেকে মেলে ধরে ইনিংস হার এড়াতে পারতেন তাহলে যতটা প্রশংসা সাহসী ব্যাটিংয়ে মিলেছে, তারচেয়েও অনেক বেশি প্রশংসা মিলত। এমনকি যখন আউট হয়ে মাঠ ছাড়তেন তখন দর্শকরা দাঁড়িয়েও হয়তো করতালিতে তাকে অভিনন্দন জানাতেন। কিন্তু মুশফিক এমন এক বলে আউট হয়ে গেলেন, হতাশই করলেন।
অনলাইনে তৃতীয়দিনের টিকেট কেটে খেলা দেখতে আসা সুরেশ নামের এক দর্শক মুশফিক আউট হতেই বলতে থাকলেন, ‘আর তো অল্প রানই দরকার ছিল। ৫৭টি রান হলেই তো ইনিংস হার এড়ানো যেত। মুশফিক কী করলেন এটা? এত ভাল খেলে, অফ সাইডের বাইরের একটি বলে শট নিতে গেলেন। এমন দুর্দান্ত ব্যাটিং করতে থাকা একজন ব্যাটসম্যানের এমন জ্ঞানহীন ব্যাটিং কি মেনে নেয়া যায়?’ তবে অনিরুদ্ধ নামের এক দর্শক আবার এও বলেছেন, ‘অসাধারণ ব্যাটিং করেছেন মুশফিক। তবে তার এমনভাবে আউট হওয়া ঠিক হয়নি। তার উইকেটে থাকা দরকার ছিল। আরে এমন মুহূর্তে বোঝাই যাচ্ছে, দল হেরে যাচ্ছে। তখন একটু স্বার্থপর হলেই তো হতো। তার সেঞ্চুরি দেখাটা খুবই আমোদে হতো।’
মুশফিক তা করতে পারেননি। সেঞ্চুরি করতে পারেননি। দলকেও ইনিংস হার থেকে এড়াতে পারেননি। এবাদত আউটের পর আল-আমিনের মারমুখী ব্যাটিংয়ে কিছুটা দূর এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু দলের ১৮৪ রান হতেই মুশফিক (৯৬ বলে ১৩ চারে ৭৪ রান) আউট হয়ে যান। মুশফিক আউট হতেই আসলে ম্যাচ শেষ হওয়া সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। দুইদিনেই ম্যাচ শেষ হয়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনা থেকে দলকে বাঁচান মুশফিক। কিন্তু তৃতীয়দিনে মাত্র ৪৭ মিনিটের বেশি খেলার সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। মুশফিক আউটের পর যখন ১৯৫ রানে ২০ বলে ২১ রান করে তৃতীয়দিন বাংলাদেশের তিনটি উইকেটই নেয়া যাদবের গতির কাছে পরাস্ত হয়ে আল-আমিনও আউট হয়ে যান, বাংলাদেশ অলআউট হয়ে যায়। মাহমুদুল্লাহ যে আর ব্যাট হাতে নামতে পারেননি। দ্বিতীয়দিনের সঙ্গে তৃতীয়দিন আর ৪৩ রান স্কোরবোর্ডে যোগ করা গেছে। খেলা গেছে মাত্র ৫২ বল।
বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা ৯ ওভারও তৃতীয়দিন খেলতে পারেনি। তাতেই ৪৩ রান এসে পড়ে। তাতেই বোঝা যাচ্ছে কত দ্রুত রান তোলায় মনোযোগী ছিলেন ব্যাটসম্যানরা। যেন যত দ্রুত শেষ হয় খেলা, ততই ভাল। ৫ উইকেট নেয়া যাদব ও ৪ উইকেট নেয়া ইশান্ত যেভাবে বোলিং করে দেখিয়েছেন, তাতে এত দ্রুত রান তোলা সম্ভব। কিন্তু উইকেট কী আর টিকিয়ে রাখা যাবে? যা করা খুব দরকার ছিল। অন্তত ইনিংস হার এড়ানোটা দরকার ছিল। তাই-ই করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। মুশফিকও পারেননি। আর তাই ইনিংসেই শেষ পর্যন্ত হার হয়েছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: