ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স

প্রকাশিত: ০৯:০২, ২৫ নভেম্বর ২০১৯

 প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। দূরদর্শী নেতৃত্ব আজ সারা বিশ্বে তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। এ অবস্থান থেকেই তিনি অনুভব করছেন দেশকে আরও দ্রুততর সময়ের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিতে হলে জরুরী সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আর এ উপলব্ধি থেকেই তিনি সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি এখন যে কথাগুলো বলছেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কণ্ঠে বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে অনুরূপ কথাগুলোই উচ্চারিত হতে শুনেছি। তিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ নিয়ে বলেছেন- ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। এই চোরারা কিন্তু সময়মতো চোরই থাকেনি, হয়েছে খুনীর সহায়তাকারীও। প্রধানমন্ত্রী সব জানেন, সব দেখছেন। রাতারাতি মানুষ কিভাবে পাল্টে যায় সেটাও তিনি নিজ চোখেই দেখছেন। তাই আমরা আস্থা রাখতে চাই আজকের এই চক্র তেমন সুযোগ আর কখনও পাবে না। তবে পাশাপাশি শঙ্কায় হৃদয় কাঁপে। কারণ কালো টাকার ক্ষমতার দৌড় অনেক দূর। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সত্তর বছর পার করে একাত্তরে পা রেখেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম দল। সেইসঙ্গে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে দলটিতে কর্মী এবং নেতার সঙ্কট নেই। তবে দলের সভানেত্রীকে মনে রাখতে হবে ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর দলের সঙ্গে কারা ছিলেন। দুঃসময়ের বন্ধুরাই আসল বন্ধু, এটা পরীক্ষিত সত্য। অথচ আজকের প্রেক্ষাপটে বিভ্রান্তি এসে ভর করে, আজ চারদিকে শুধুই বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি। আসলেই কি তাই? এখানে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলা একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আজ যে মুক্তিযোদ্ধা, কাল যে সে রাজাকার হবে না, এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না কিন্তু আজ যে রাজাকার, সে অতীতেও রাজাকার ছিল, ভবিষ্যতেও রাজাকার থাকবে।’ পরিহাসের কথা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এই মন্তব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নিজেদের ক্ষমতা প্রতিপত্তি রাখতে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও তাদের সন্তানদের সাদরে বরণ করছেন প্রায় সর্বত্র। ফলে কি ঘটছে? নেতা কাউকে ধরে আনতে বললে এরা অতি উৎসাহে তাকে বেঁধে আনে। এর দায়টা নিতে হচ্ছে কাকে? শুরু হতে যাচ্ছে মুজিববর্ষ। চারদিকে শুধু বঙ্গবন্ধু ধ্বনি। জামায়াত-বিএনপি, এমনকি জাসদ, হক-তোহাবাদীদের মুখেও বঙ্গবন্ধু নামের জয়ধ্বনি শুনলে সত্যিকার বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের কষ্ট হয়। কারণ নব্য এসব বঙ্গবন্ধুপ্রেমীর স্লোগানের পেছনে আদর্শ নয়, কাজ করছে স্বার্থ। কারণে-অকারণে তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে টানাটানি করে। বঙ্গবন্ধুকে অতি সাধারণ স্তরে নামানোই তাদের লক্ষ্য। এসব দেখার কি কেউ নেই? ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে যেসব দুর্বৃত্ত ধরা পড়েছে, তাদের মুরব্বিরা শিষ্যদের পূর্ব কীর্তিকলাপ সামনে আসা মাত্রই আকাশ থেকে পড়ছেন। এসব মুরব্বি কোন্ যোগ্যতায় বড় চেয়ারটাতে বসার সুযোগ পেয়েছেন? শোনা যায় কোন এক সহযোগীর প্রধান ব্যক্তি রীতিমতো জোর তদবির করে বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হয়েছেন। মূল দলের কোন এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে বৃদ্ধ বয়সে তিনি যুবা সেজেছেন। পুরো বিষয়টা একবার ভাবুন। নেত্রীকে বেকায়দায় ফেলতে এটা কি ’৭৫-এর মতোই পাতানো জাল নয়? সর্বত্রই আলোচনার বিষয় হচ্ছে আসন্ন কাউন্সিলে দলকে ঢেলে সাজানো হবে। এ কাজটি নির্ভেজালভাবে করতে না পারলে সামনে অশনিসঙ্কেত। যারা নেতৃত্বে আসবেন তাদের সততা ও আনুগত্য যদি প্রশ্নাতীত না হয় তাহলে আবার ছিদ্র পথে ঢুকে পড়বে চাটার দল। তখন ‘জিরো টলারেন্স’ হয়ে যাবে মুখের কথা। প্রধানমন্ত্রী একবার নিজেই বলেছিলেন-‘ আওয়ামী লীগে আমাকে ছাড়া সবাইকেই টাকা দিয়ে কেনা যায়।’-কথাটা অত্যন্ত দুঃখ থেকে উচ্চারিত হলেও বাস্তবতা থেকে কিন্তু খুব বেশি দূরে নয়। দু-চারজন যে নিবেদিত নেতা নেই তা নয়, আছে। তবে ধান্দাবাজদের দৌরাত্ম্যে তারা কোণঠাসা। আর মধ্যম সারির নিবেদিতপ্রাণ নেতারা হাইব্রিডদের দাপটে সামনে আসতে পারছে কই? চাঁদাবাজির সম্রাটকে ধরতে শেষ পর্যন্ত এমপি শেখ ফজলে নূর তাপসকে কথা বলতে হয়। এতেই বোঝা যায় দুর্নীতিবাজদের হাত কতটা লম্বা। তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও ঝুলিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এমতাবস্থায় নেত্রীকে সামনের পথে সতর্কাবস্থায় হাঁটতে হবে একক সিদ্ধান্তেই। এক্ষেত্রে তাঁকে নজর দিতে হবে ১৯৭৫-এর পর তাঁর পাশে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কারা ছিলেন? তাদের মাঝ থেকে যারা মারা গেছেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তুলে আনতে হবে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর প্রতি যারা বিশ্বস্ত ছিলেন তাদের রক্ত কখনও নেত্রীর প্রতি অবিশ্বস্ত হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, নেত্রী ১/১১তে আরও একবার দলীয় নেতাদের চারিত্র্যিক দৃঢ়তার পরিচয় পেয়েছেন। বিপদে পলায়নপর অথবা আপোসকামী মানুষগুলো কখনও সুসময়ের বন্ধু হতে পারে না। তৃতীয়ত, এ ঘাট ও ঘাট করা মানুষগুলো সব সময়ই অবিশ্বস্ত। তাদের ঝেড়ে ফেলাই বাঞ্ছনীয়। অতীতে দেখা গেছে, দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া অথবা অন্য দল থেকে আসি-আসি করা লোকদের ভোটের রাজনীতির কারণে দলে টেনে আদতে দলের ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। চতুর্থত, মাঠ পর্যায়ে দল ও সহযোগী সংগঠনে জামায়াত, বিএনপিসহ আওয়ামী বিরোধীদের দলে টানতে যে সব নেতা সক্রিয় ছিলেন বা আছেন তাদের চিহ্নিত ও শাস্তির (অর্থাৎ বহিষ্কার) ব্যবস্থা করতে হবে। পঞ্চমত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ভোগকারী সকলকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা, মর্যাদা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ দুর্নীতি করার চিন্তা না করে। নেত্রীকে মাঠ পর্যায়ে নজর নিতে হবে। কারণ কেন্দ্রে বসে ক্ষমতার জোরে নিজ এলাকায় একটা পাওয়ার গ্রুপ গড়ে তোলা যায়। এই গ্রুপগুলোই যত নষ্টের গোড়া। এলাকা এবং দলের ভেতর যত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এদের দিয়েই সংঘটিত হয়। এদের কারণে ত্যাগী এবং সৎ নেতৃত্ব উঠে আসতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেত্রীর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি মাঠ পর্যায়ের সব খবরাখবর রাখেন। সুতরাং, তাঁর পছন্দের বাইরে যেন মাঠ পর্যায়ের কোন কমিটি না হয় এটা তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে। মূল দলের নেতৃত্বে ত্যাগীরা সুযোগ পেলে সহযোগী সংগঠনেও তার বাতাস লাগবে। আর মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব ঠিক হয়ে গেলে কেন্দ্র ঠিক করতে নেত্রীর তেমন বেগ পেতে হবে বলে মনে হয় না। পরিশেষে একটা প্রসঙ্গে বলতে চাই- বঙ্গবন্ধুর বড় দুর্বলতা ছিল আবেগ। অজস্র কুকর্ম করেও তাঁর কাছে এসে ক্ষমা চাইলে মুখ ফেরাতে পারতেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত এই মহৎ গুণটাই তাঁর শত্রুরা কাজে লাগিয়েছিল। বাবার বহমান রক্তের কারণেই জননেত্রী মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ হয়ে যান। কিন্তু কোন আবেগকেই প্রশ্রয় দেয়া উচিত হবে না। মনে রাখতে হবে- যেখানটায় তিনি বসে আছেন তার নিচে বিষাক্ত সাপেরা কিলবিল করছে। তারা সুযোগের অপেক্ষায়। নেত্রী হয়ত তাঁর জীবনের পরোয়া করেন না; কিন্তু অভাগা জাতির জন্য তাঁর বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি জরুরী। প্রধানমন্ত্রী অন্তত দেশের জনগণের কথাটা ভাববেন। লেখক : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, কাউন্সিলর (২৭ নং ওয়ার্ড), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
×