ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আলম শাইন

রেমিটেন্স প্রবাহে বাধা পাসপোর্ট হয়রানি

প্রকাশিত: ০৯:০১, ২৫ নভেম্বর ২০১৯

রেমিটেন্স প্রবাহে বাধা পাসপোর্ট হয়রানি

মধ্যযুগীয় ইসলামিক খেলাফতের সময় শুল্ক প্রদানের রসিদ ছিল এক ধরনের পাসপোর্ট। যেই মুসলিম ব্যক্তি যাকাত ও জিজিয়া কর প্রদান করত, শুধু সেই মানুষগুলো খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করার সুযোগ পেত। এভাবে শুল্ক প্রদানের রসিদটাই ভ্রমণকারীদের জন্য পাসপোর্ট হিসেবে পরিণত হয়। যা এখন বিশ্ব ভ্রমণের অনুমতির দলিল দস্তাবেজ বা পাসপোর্ট নামে পরিচিত। পাসপোর্ট হচ্ছে এক ধরনের ভ্রমণ নথি। এটি আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাহকের জাতীয়তা ও পরিচয় বহন করে। পাসপোর্ট যে কোন দেশের সরকার কর্তৃক জারি করা হয়ে থাকে। পাসপোর্টের প্রচলন বিশ্বব্যাপী। সূত্রে মতে, ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে হিব্রু বাইবেলে পাসপোর্টের অনুরূপ কাগজের নথির উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও সেই তথ্যটি থেকে পাসপোর্টের প্রচলনের সাল-তারিখ প্রমাণ করা যায়নি। কিন্তু ইঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে, এ ধরনের কিছু একটা ছিল তখনও। বাংলাদেশের পাসপোর্ট সাধারণত তিন ধরনের মলাটে বন্দী। যথাক্রমে লাল, নীল ও সবুজ মলাটের। লাল মলাট হচ্ছে কূটনৈতিক পাসপোর্ট। নীল মলাট হচ্ছে সরকারী কর্মজীবীদের পাসপোর্ট। অপরদিকে সবুজ মলাটের পাসপোর্ট হচ্ছে সর্বসাধারণের জন্য। যা সংগ্রহ করতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় দেশের নিরীহ সাধারণের। শরীরের ঘাম ঝরাতে হয় সেই পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে, যা কোন মতেই কাম্য নয়। কারণ সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্যই পাসপোর্ট প্রাপ্তি হচ্ছে নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি অধিকার। অথচ সেই অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়মের শিকার হচ্ছেন আমাদের দেশের লাখো মানুষ। পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। বিষয়টাকে স্বচ্ছ ও সহজ করার প্রয়াসে সরকার সচেষ্ট হলেও কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর অপকৌশলের গ্যাঁড়াকলে পড়ে মানুষ হয়রানির কবলে পড়ছেন নিয়মিত। সূত্রমতে এ পর্যন্ত দেশের ২ কোটির বেশি মানুষকে পাসপোর্ট দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বিদেশে অবস্থানরত ৬ লাখ বাংলাদেশীকে পাসপোর্ট দেয়া হয়েছে। তুলনামূলক বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছেন দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই তুলনায় দেশে অবস্থানরত মানুষ বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন খানিকটা বেশি। বিবিধ কারণও রয়েছে এর। তার মধ্যে প্রথম কারণটি হচ্ছে আর্থিক লেনদেন। প্রবাসীদের তুলনায় দেশের মানুষ দালালের হাতে ঝটপট অর্থ-কড়ি সঁপে দিতে পারেন না। ফলে যথাসময়ে পাসপোর্টও হস্তগত হয় না তাদের। এখানে বলতে হয়, পাসপোর্ট আর দালাল দুটি একই সূত্রে গাঁথা, সমার্থক শব্দের মতোই যেন। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন ব্যাপারটা কত কঠিন। কত কষ্টেসৃষ্টে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হচ্ছে একেকজনকে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি প্রধান বাধা হচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশন। ভেরিফিকেশনের কারণেও কিছুটা জটিলতা তৈরি হতে দেখেছি আমরা। আর এটি হচ্ছে প্রকৃত বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রেই। পাসপোর্ট গ্রহণ দুঃসাধ্য না হলেও খুব সহজে মিলছে না এটি। পদে পদে বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করেই পাসপোর্ট গ্রহণ করতে হচ্ছে দেশের প্রকৃত নাগরিকদের। দালাল না ধরলে যথাসময়ে পাসপোর্ট হস্তগত হয় না। কর্মরত অফিসার ফিরেও তাকান না। কথা বলেন অন্যত্র তাকিয়ে। নানা অজুহাত দেখিয়ে কষে প্যাঁচ মারেন। এই কাগজ সে কাগজ জমা দেয়ার ফিরিস্তি দেন। কোনমতে সেসব কাগজপত্র জমা দিতে পারলেও ডেলিভারির তারিখ পেছাতে থাকে ক্রমান্বয়ে। ফলে যথাসময়ে পাসপোর্ট না পেয়ে অনেকেই বিপাকে পড়ে যান। ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে এ ধরনের ঘটনার। সে সব ফিরিস্তি টানা এখানে সম্ভব নয়। আগেই বলেছি, পাসপোর্ট প্রাপ্তি হচ্ছে নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি অধিকার। সেই অধিকার বাস্তবায়নে সরকার ইচ্ছা করলে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজনে জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো পাসপোর্ট ঘরে ঘরে পৌঁছানোর উদ্যোগও নিতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বিভিন্ন রকম খরচাদি মিলিয়ে একটি পাসপোর্ট গ্রহণ করতে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকার মতো পড়ে যায়। অবশ্য এটি নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে। আর যদি আর্জেন্ট প্রয়োজন পড়ে তাহলে তো কথাই নেই। সংস্থার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন জনকে খুশি করিয়ে তবেই পাসপোর্ট গ্রহণ করতে হয়। এতসব ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর কারণে সর্বসাধারণ যেমনি বিরক্ত হন তেমনি ভড়কেও যান। ফলে দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় অনেকেরই। আর চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনে পাসপোর্ট গ্রহণ করেন যারা তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন হতে পারে তাও অনুমেয়। অপরদিকে ভিনদেশীদের এত ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় না। ভুয়া কাগজপত্র সংগ্রহ করে কিংবা কেউ কেউ বৈবাহিকসূত্রে আবদ্ধ হয়ে নাগরিকত্ব সংগ্রহ করে খুব সহজে পাসপোর্ট হাতিয়ে নিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে তিনি বাড়তি কিছু খরচাদি করে থাকেন। পরবর্তীতে সেই লোভটি থেকে যায় পাসপোর্ট প্রদানকারীদেরও। যা দেশের সর্বসাধারণের ওপর গিয়ে বর্তায় এবং বাধ্য করানো হয় বাড়তি খরচাদি করিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে। এ বিষয়ে আমাদের আরও সজাগ হতে হবে। পাসপোর্ট গ্রহণের সহজীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে যেমন, তেমনি ভিনদেশীরা বাংলাদেশের পাসপোর্ট যেন কোন মতেই গ্রহণ করতে না পারেন সেই বিষয়ে নজরদারি কঠোর করতে হবে। যেমন রয়েছে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে। এ অজুহাতে যেন আবার দেশের প্রকৃত নাগরিক পাসপোর্ট গ্রহণে হয়রানির শিকার না হন, সেটিকে সবার আগে বিচেনায় রাখতে হবে। ভিসা সংগ্রহের ব্যাপারেও নজর দিতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীরা যাতে অধিক মুনাফার বিনিময়ে ভিসা হস্তান্তর না করতে পারেন সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রবাসীদের ছোটখাটো ভুলভ্রান্তিগুলোকে অনেক বড় করে দেখছে সম্প্রতি। এর প্রধান কারণই হচ্ছে ভিনদেশীদের উপদ্রব। তারা বাংলাদেশী পাসপোর্ট হাতিয়ে ওমরা ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে থেকে যাচ্ছে। চুরি-চামারিসহ নানা অপকর্ম করে ধরা পড়লে বাংলদেশী বলে পরিচয় দিচ্ছে। কাগজে কলমেও প্রমাণ মিলছে বাংলাদেশী, ফলে এখানে আর সাফাই গাওয়ার মতো তেমন সুযোগ থাকছে না। এসব বেশি করছে রোহিঙ্গারা। তারা পাসপোর্ট সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, মধ্যপ্রাচ্যে গমন করে অধিক কাজ প্রাপ্তির লোভে নিজেদের শ্রমের মূল্যও কমিয়ে নিচ্ছে। যাতে করে বাংলাদেশীরাও বাধ্য হচ্ছেন তাদের শ্রমের মূল্য আরও কমিয়ে দিতে। এতে করে বিপাকে পড়ে গেছেন বাংলাদেশী শ্রমিকরা। অধিক পরিশ্রম করেও পর্যাপ্ত অর্থকড়ি নিজ দেশে প্রেরণ করতে পারছেন না। অন্যদিকে আগের মতো বুক টান করে বিদেশের মাটিতে চলাফেরাও করতে পারছেন না। বাংলাদেশী পরিচয় জানলে সন্দেহের চোখে দেখছেন অনেকে অথচ আদতেই বাংলাদেশীরা অমন ধাঁচের নন, সেটি প্রমাণ করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন রোহিঙ্গাদের কারণেই। রোহিঙ্গারা সত্য-মিথ্যা বলে বিদেশীদের কান ভারি করছে, সে রকম তথ্যও আমরা খবরের কাগজ মারফত ইতোপূর্বে জানতে পেরেছি। অথচ রোহিঙ্গারা কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে লালিত-পালিত হচ্ছে। তদুপরি দেশের পাসপোর্টও হাতিয়ে নিচ্ছে, বিদেশ গিয়ে বদনামও করছে। বিষয়টা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে খুব দ্রুত। বিশেষ করে মাথায় রাখতে হবে পাসপোর্টের সঙ্গে রেমিটেন্স প্রবাহের যোগসূত্রটা। রেমিটেন্স প্রবাহের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে সর্বাজ্ঞে। বছর দুই আগে দেশে রেমিটেন্স ভাটা দেখা দিয়েছিল। যদিও সেটি এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রবাহ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রণোদনা দেয়ার কারণে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, চলতি বছর (২০১৯-২০) রেমিটেন্স ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। সম্প্রতি রেমিটেন্স প্রবাহে নিম্নমুখীর কারণ অনুসন্ধান করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তারা প্রথমত দায়ী করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘ অস্থিরতার কারণে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুতিসহ আয় কমে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য কম থাকায় প্রবাসীরা অর্থ পাঠাতে গড়িমসি করছেন। তৃতীয়ত, মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারের ফলে হুন্ডিওয়ালারা অবৈধভাবে প্রবাসীদের নিকটজনের কাছে টাকা দ্রুত পৌঁছে দেয়ায় রেমিটেন্স প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও পাসপোর্ট গ্রহণের হয়রানির কারণেও দ্রুত শ্রমিকরা ভিসা সংগ্রহ করতে পারছেন না। ফলে রেমিটেন্স প্রবাহে বিঘ্ন হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। পাসপোর্ট প্রাপ্তির জটিলতা দীর্ঘদিনের হলেও বিষয়টি যেন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। যদি আমরা মনে রাখতে পারি যে, একটি পাসপোর্ট বিতরণ মানে একজন বাংলাদেশীর বহির্গমনের সুযোগ লাভ করা এবং পরে তার মাধ্যমে দেশে রেমিটেন্স পৌঁছানো- বিষয়টি এভাবে ভাবলে বোধকরি অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেতে পারে অতি সহজে। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রকৃতি বিশারদ [email protected]
×