ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাকিব জামাল

ভোগ্যপণ্য বাজারে ‘প্যানিক প্রাইস হাইক’

প্রকাশিত: ১২:৫১, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

ভোগ্যপণ্য বাজারে ‘প্যানিক প্রাইস হাইক’

গত কয়েকদিন ধরে আমাদের দেশের ভোগ্যপণ্য বাজারে চলছে প্যানিক প্রাইস হাইক বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আতঙ্ক! তবে হঠাৎ করে লবণের দাম বাড়তে পারে এই গুজবে বা চিন্তায় যখন বেশি দামে লোকজনে এটি কেনার জন্য হুড়মুড় খেয়ে পড়ছে তখন এই বিষয়টি সঙ্গত কারণে সামনে চলে এসেছে। এই ‘প্যানিক প্রাইস হাইক’ কি, কেন এর সৃষ্টি হয় এবং এর সমাধান কি- এসব এখন আলোচনা ও গবেষণার দাবি রাখে। প্যানিক বায়িং বা প্যানিক সেলিং সাধারণত পুঁজিবাজারে দেখা যায়, বিশেষ করে অস্থিতিশীল পুঁজিবাজারে। পুঁজিবাজারে যারা বিনিয়োগ করেন তারা যখন কোন সিকিউরিটিজের দাম বাড়তে দেখেন তখন এর পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনা না করে বেশি লাভের আশায় হঠাৎ করে ওই সিকিউরিটিজটি ব্যাপকভাবে কিনতে থাকেন- এটি হলো প্যানিক বায়িং। ঠিক তেমনই যখন কোন সিকিউরিটিজের দাম পড়ে যেতে দেখেন তখন ভবিষ্যতে ওই সিকিউরিটিজের বাজার কেমন হবে তা বিশ্লষণে না গিয়ে হুজুগে সিকিউরিটিজগুলো বিক্রি করে দেন- এটি হলো প্যানিক সেলিং। পুঁজিবাজারে- সাধারণত গুজব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক পরিবর্তন, কোন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক উত্থান বা পতন, এবং অনেক সময় বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিপূর্ণ মনিটরিংয়ের কারণে প্যানিক বায়িং বা সেলিং ঘটে থাকে। কিন্তু ভোগ্যপণ্য বাজারে এই ধরনের ঘটনা খুবই কম ঘটে। কারণ পুঁজিবাজারে সবাই বিনিয়োগকারী এবং বাজার নিয়ে নিজের বা প্রতিষ্ঠানের লাভের জন্য বা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্নভাবে বাজারে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক প্রভাব বিস্তার করেন, সহজভাবে বললে বাজার নিয়ে খেলা করেন! কিন্তু ভোগ্যপণ্য বাজারে- এখানে ভোক্তারা বেশি থাকেন বিনিয়োগকারী বা ব্যবসায়িকরা কম থাকে। তাছাড়া এটি শুধু ব্যবসাকেন্দ্রিক নয়, সেবা কেন্দ্রিকতাও আছে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগকারী বা পাইকারি ব্যবসায়ী ছাড়া মধ্যস্বত্বভোগী খুচরা বিক্রেতা থাকেন যারা ভোক্তাদের পরিচিত- তাই এখানে প্যানিক বা আতঙ্ক অনেকটা প্রশমিত হয়ে যায়। তৃতীয়ত, এই বাজারের সঙ্গে জনমতের বিষয় জড়িত থাকে এবং সেজন্য সরকারও সতর্ক থাকেন মনিটরিং করতে। এসব কারণেই প্যানিক বায়িং বা সেলিং এখানে কম ক্রিয়াশীল। কিন্তু ইদানীং আমাদের ভোগ্যপণ্য বাজারে ‘প্যানিক প্রাইস হাইক’ সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় বছরেই নীরবে এটি ঘটে! যেমন সম্ভবত চালের কারণে একবার এটি ঘটেছিল। এবারে গত কয়েকদিন ধরে পেঁয়াজের দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলায় এই আতঙ্কটি সৃষ্টি হয়েছে জনগণের মনে। ভোক্তাবাজারে একটি পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের দামের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই জনসাধারণ যখন বেশ কিছুদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত বাজার পর্যবেক্ষণ করেন তখন তার ফলাফল হিসাব তাদের মনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভয় জায়গা করে নেয় এবং তারা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো কিনতে শুরু করেন। এর পেছনের কারণ হলো সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাসিক খরচের একটি নির্দিষ্ট বাজেট থাকে- সেই বাজেটে মাস চলতে যাতে সমস্যা না হয় তাই তারা দৈনিক বাজার করার পরিবর্তে এককালীন মাসিক বাজার শুরু করে দেন- এটি বাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়, চাহিদা এবং যোগানের সূত্রানুসারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এটিই মূলত ‘প্যানিক প্রাইস হাইক’। সুতরাং, এটি স্পট- ‘প্যানিক প্রাইস হাইক’ এর কারণ আর কিছু না- কারণটি প্যানিক বা আতঙ্ক। এই আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে যেসব কারণে তা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। যা আন্ডারলাইন করলে পাওয়া যায়- ‘অনিয়ন্ত্রিত বাজার’। অনিয়ন্ত্রিত বাজারে ‘প্যানিক প্রাইস হাইক’ এর নির্মমতার প্রধান শিকার হয়ে থাকেন- দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই শ্রেণীত্রয় ভীষণভাবে আর্থিক সমস্যায় পড়তে পারেন। তাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। হাতের পাঁচ শেষ করতে হয়- নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে। মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। তাই এই প্যানিকটি দূর করা জরুরী। প্যানিক প্রাইস হাইক দূর করতে মূল কাজটি হলো দক্ষতার সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা করা। অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত বাজারের লাগাম টেনে ধরা। কি কি করণ এবং কোন কোন ব্যবসায়ী, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কারণে বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে তা চিহ্নিত করা এবং এসব অনাকাক্সিক্ষত প্রভাবকসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ পূর্ব পদক্ষেপ হিসেবে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা। এর সঙ্গে জড়িত বিষয়সমূহ হলো- পণ্য বা সেবার কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি যাতে না হয় সেজন্য সজাগ থাকতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের যথাসময়ে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া। গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশের মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের দ্রুত প্রয়োগের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি, মানুষের মনে বাজার ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি জনগণের আস্থা স্থাপন। এই আস্থার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ- কারণ আস্থা রাখতে না পারলে জনগণ প্যানিক বায়িং চালিয়ে যাবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে। আস্থা মূলত আইনের দৃশ্যমান প্রয়োগের সমানুপাতিক। পরিশেষে বলা যায়, যেহেতু প্যানিক প্রাইস হাইক- অনিয়ন্ত্রিত বাজারে বিশেষ কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাবার বৃহৎ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাই ওইসব মূল পণ্যসমূহের দাম, দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করে- কমিয়ে এনে, জনগণের মনে বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে ভোগ্যপণ্য বাজার থেকে প্যানিক প্রাইস হাইক বিষয়টি দূর করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যেতে পারে।
×