ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পেসারদের সাফল্যে বাড়ল আক্ষেপ, এবাদতের ক্যারিয়ারসেরা বোলিং, প্রত্যাবর্তনে আলো ছড়ালেন আল-আমিন

ইডেনে বাংলাদেশ দলের ‘গোলাপি’ কষ্ট

প্রকাশিত: ১২:০২, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

ইডেনে বাংলাদেশ দলের ‘গোলাপি’ কষ্ট

মোঃ মামুন রশীদ ॥ বেদনার রং নীল, কষ্টের রং বেগুনি আর শোকের ‘কালো’! কিন্তু ইডেন টেস্টে বাংলাদেশ দলের কষ্ট, বেদনা এবং শোকের রং এক হয়ে গেছে। আর সেই রং গোলাপি। গোলাপি বল নিয়ে যত অস্বস্তি, অজানা ভয় ছিল, সেটি যে একেবারে অমূলক নয় তা বোঝা গেছে ভারতের শক্ত ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে বাংলাদেশী পেসারদের দারুণ বোলিংয়ে। ভারতীয় পেসারদের গোলাপি বলের আগুনে পুড়ে খাক হয়েছেন প্রথমে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা। বাংলাদেশের ইনিংস ১০৬ রানেই ধসে পড়ার পর কষ্টটা শুরু হয়েছিল, শোকের কালো ছায়াই যেন গ্রাস করে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিং রুম। ভারত বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপ নিয়ে যখন বাংলাদেশী পেসারদের বিপক্ষেও ভিড়মি খেতে শুরু করেন তখন তা হয়ে ওঠে বেদনাময় আক্ষেপ। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ঐতিহাসিক দিবারাত্রির টেস্টে গোলাপি বলে জ্বলে উঠলেন বাংলাদেশের একাদশে ঠাঁই করে নেয়া তিন পেসারই। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ দলের পেসারদের এভাবে দুরন্ত হয়ে উঠতে দেখা গেছে। ৫ বছর পর টেস্ট দলে ফেরা আল-আমিন হোসেন ৩টি এবং ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করে এবাদত হোসেন চৌধুরী ৩টি উইকেট নিয়ে আক্ষেপ বাড়িয়েছেন। আবু জায়েদ রাহীও নেন ২ উইকেট। শেষ পর্যন্ত ২৪১ রানের লিড নিয়ে ভারত প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে দেয় ৯ উইকেট হারিয়ে ৩৪৭ রান তুলে। সবমিলিয়ে ব্যাটসম্যানরা চরম ব্যর্থতা না দেখালে হয়তো ইডেন টেস্টে মুমিনুল হকের দল দারুণ কিছুই করতে পারতো। কষ্ট, বেদনা হয়ে ওঠা গোলাপি রংয়ের বলটা সেই আক্ষেপেই এখন পোড়াচ্ছে বাংলাদেশ দলকে। গোলাপি বলের সিম মুভমেন্ট, সুইংয়ের প্রকারটা আলাদা। ২০১৫ সাল থেকে দিবারাত্রির টেস্ট শুরু হয় এবং অনেক গবেষণার পর গোলাপি বলেই খেলার সিদ্ধান্ত হয়। তখন থেকে মোট ১১ টেস্টে এই বল ব্যবহার করার পর এর সুবিধা-অসুবিধা বোঝা গেছে। টেস্ট খেলুড়ে ৮টি বড় দলই খেলে ফেলেছে দিবারাত্রির টেস্ট। ভারত কিংবা বাংলাদেশ সেখানে নতুন করে যোগ হয়েছে ইডেন টেস্টের মাধ্যমে। এর আগে কয়েকবার ভারতকে গোলাপি বলের দিবারাত্রির টেস্ট খেলার আহ্বান জানালেও ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই) তা প্রত্যাখ্যান করে। কারণ দিনরাত্রির টেস্টে গোলাপি বলকে সমঝে ওঠার প্রয়োজন আছে। তাই ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে তারা এবং এরপর দুর্বলতর বাংলাদেশ দলকে পেয়েই টেস্ট খেলে তাতে মানিয়ে নেয়ার সুযোগটা ছাড়েনি। কিন্তু বাংলাদেশ দলের জন্য এটি ছিল একেবারেই আনকোরা অভিজ্ঞতা। গোলাপি বলে অনুশীলন করার কয়েকদিন সুযোগ হলেও খেলা হয়নি কখনও। সেই গোলাপি রংয়ের বল যে এত কষ্ট ছড়াবে তা হয়তো ভাবতেও পারেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। আগে ব্যাটিং করে ১০৬ রানেই প্রথম ইনিংসে থুবড়ে পড়ে বেদনার্ত হন মুমিনুলরা। বলার মতো শুধু সাদমান ইসলাম অনিক ও লিটন কুমার দাসের ইতিবাচক ব্যাটিং, বাকিরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে গোলাপি বলের ভীতি নিয়ে ব্যাট চালিয়ে। দিবারাত্রির টেস্টে গোলাপি বলে পেসাররা দারুণ সহায়তা পান এটা বেশ ভালভাবেই জানা ছিল। তাই দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশ দল ৩ পেসার নিয়ে খেলতে নামে। উপমহাদের মাটিতে বর্তমানে ভারতীয় দল ৩ পেসার নিয়ে নিয়মিত খেললেও বাকিরা স্পিন আক্রমণকে প্রাধান্য দিয়েই একাদশ গড়ে। ভারত পেস বোলিংয়ে অনেক এগিয়ে গেছে তা গত কয়েক বছরে প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশ দলকেও তারা ইন্দোর টেস্ট ও চলতি ইডেন টেস্টে তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিল। স্বাভাবিকভাবেই এবার ভারত সফরে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ দল স্বাগতিকদের ভয়ানক স্পিন আক্রমণ নিয়েই বেশি ভেবেছে এবং পরিকল্পনাও করেছে। আর টেস্টের সেরা বোলার জাসপ্রিত বুমরাহ ইনজুরির কারণে না থাকায় একটু সাহস নিয়েই টেস্ট সিরিজে নামতে পেরেছে। কারণ বাংলাদেশ দলের মূল লক্ষ্য ছিল রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজার স্পিন সামলানো। কিন্তু ইন্দোরে ইশান্ত শর্মা, উমেশ যাদব ও মোহাম্মদ শামি রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করার পর গোলাপি বলে ইডেনে আরও আতঙ্ক হয়ে ওঠেন। আল-আমিন, এবাদত ও রাহীকে নিয়ে বাংলাদেশ দলও ৩ পেসারের সমন্বয়ে একাদশ গড়েছিল। ব্যাটসম্যানরা তাদের কাজ হয়তো করতে পারেননি, কিন্তু এ তিন পেসার অবিশ্বাস্য বোলিং করেছেন। অথচ কিছুদিন আগে ঘরের মাটিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে ৪ স্পিনার খেলালেও কোন পেসার খেলায়নি বাংলাদেশ দল। দেশের মাটিতে টেস্ট খেলতে নামলে এমনটা অহরই হয়ে চলেছে পেসারদের সঙ্গে। তারা বল হাতে ইডেন টেস্টে প্রথমদিন কৃত্রিম আলোয় দারুণ কার্যকারিতা দেখিয়েছেন। শুরুটা ৫ বছর পর ফিরে আল-আমিন করলেও সবচেয়ে বড় কাজটি করেছেন এবাদত। আগের ৩ টেস্টে মাত্র ২ উইকেট নেয়া এ ডানহাতি পেসার রোহিত শর্মা, চেতেশ্বর পুজারা ও বিরাট কোহলির মতো তিন সেরা ব্যাটসম্যানের উইকেট তুলে নিয়েছেন। আল-আমিন ইন্দোর টেস্টের ডাবল সেঞ্চুরিয়ান মায়াঙ্ক আগারওয়ালকে (১৪) ইনিংসের পঞ্চম ওভারেই সাজঘরে ফেরান। এরপর রোহিতকে (২১) ইনিংসের ১৩তম ওভারে এবং পরে হাফ সেঞ্চুরিয়ান পুজারাকে (৫৫) শিকার করেন এবাদত। প্রথমদিনই বাংলাদেশী পেসারদের এমন সাফল্যে উজ্জীবিত হয়েই দ্বিতীয়দিন নেমেছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু কোহলি কত উঁচু দরের ব্যাটসম্যান, সেটি বুঝিয়ে দিয়েছেন ভালভাবেই। তিনি সেঞ্চুরি তুলে নেন, টেস্ট স্পেশালিস্ট অজিঙ্কা রাহানেও অর্ধশতক পেয়ে যান। এতেই মূলত পেসারদের প্রাথমিক সাফল্য ম্লান হতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাহানেকে (৫১) বদলি হিসেবে নামা তাইজুল ইসলাম তুলে নেয়ার পর পেসাররা দুর্দান্তভাবে প্রত্যাবর্তন করেছেন। জাদেজাকে (১২) বোল্ড করে দেন ইন্দোর টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে সফলতম বোলার রাহী। এরপর ক্যারিয়ারের আরেকটি বড় সাফল্য পান এবাদত, তিনি ফিরিয়ে দেন কোহলিকে। ১৯৪ বলে ১৮ চারে ১৩৬ রান করেছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক। গোলাপি বল হাতে বাংলাদেশী পেসাররাও কম যান না, তা তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন এরপরই। বাকি ৩ উইকেট আল-আমিন-রাহী তুলে নিয়েছেন দ্রুতই। আর সে জন্যই অনেক বড় ইনিংস গড়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় ভারতের। অবশেষে ৯ উইকেটে ৩৪৭ রানেই প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে দেয় তারা। ৫ বছর পর ফেরা আল-আমিন তার সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়েছেন ৩ উইকেট নিয়ে। আর এবাদত আগের ৩ টেস্ট খেলে ৩ ইনিংসে বোলিং করে মাত্র ২টি উইকেট পেয়েছিলেন। এবার তিনি ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করে ৯১ রানে তুলে নেন ৩ উইকেট। আর উইকেটগুলোও ছিল সেরা তিন ব্যাটসম্যান- রোহিত, পুজারা ও কোহলির। ইন্দোর টেস্টে অবিশ্বাস্য বোলিং করেছিলেন শুধু রাহী, নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। এবার তিনি নিয়েছেন ২টি। ৩ পেসারের ৮ উইকেটে ভারতীয় ইনিংসটা খুব বেশি দীর্ঘ না হওয়াতে আক্ষেপটা আরও বেড়েছে। যদি বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা কিছুটা প্রতিরোধ গড়তে পারতেন, যদি রান আরেকটু বেশি হতো প্রথম ইনিংসে! হয়তো পরাজয় ঠেকানো যেত না, কিন্তু ইতিবাচক খেলার মাধ্যমে তীব্র গোলাপি কষ্টটা আরেকটু কম হতো।
×