ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক সেমিনারে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের অভিমত

নতুন প্রজন্মের জন্য গণহত্যার ইতিহাস রচনা গুরুত্বপূর্ণ

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

নতুন প্রজন্মের জন্য গণহত্যার ইতিহাস রচনা গুরুত্বপূর্ণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নতুন প্রজন্মের শিক্ষার জন্য গণহত্যার ইতিহাস রচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ইতিহাস চর্চাকে নাগরিক আন্দোলনে পরিণত করার আহ্বান জানালেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, ইতিহাসের পথ ধরেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণহত্যা হয়েছে। কিন্তু মৌলবাদী ধর্মান্ধরা কখনও সত্য ইতিহাস স্বীকার করে না। তারা ইতিহাসকে পছন্দ করে না। গণহত্যার যে যন্ত্রণা তা ইতিহাস চর্চার অভাবে নতুন প্রজন্মও উপলব্ধি করতে পারছে না। নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরার মধ্যে দিয়েই এর গুরুত্ব ও উপলব্ধি বাড়াতে হবে। ‘১৯৭১-এর গণহত্যা, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী দিন শনিবার বিশেষজ্ঞরা এই আহ্বান জানান। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সম্মেলনের সমাপনী দিনে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। অনুষ্ঠানে অন্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন ভারতের অধ্যাপক সঞ্জয় কে. ভরদ্বাজ, তুরস্কের ফেরহাত আতিক, কম্বোডিয়ার সোমালি কুম, মিয়ানমারের ড. খিন জ উইন, যুক্তরাজ্যের জুলিয়ান ফ্রান্সিস ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর। সমাপনী অনুষ্ঠানে শাহারিয়ার কবির বলেন, দেশের ইতিহাস চর্চা একটি নাগরিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। মৌলবাদীরা ইতিহাস পছন্দ করে না। অস্বীকার করে। ইতিহাসের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। সমাপনী বক্তব্যে ড. মুনতাসীর মামুন একাত্তরের গণহত্যা-নির্যাতনের কয়েকটি নিদর্শন তুলে ধরে বলেন, গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই ইতিহাসকে আমাদের জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। তিনি মাতৃভাষায় ইতিহাস চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, মাতৃভাষায় ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে ইতিহাস গণমুখী করা সম্ভব। মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ এসবের বিরুদ্ধে লড়তে এর প্রয়োজন অত্যধিক। দেশের প্রতি আমাদের যে ঋণ তা আমরা শোধ করতে না পারলেও, স্বীকার তো করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। এ ইতিহাস উঠে আসবে গণহত্যা নির্যাতনের ইতিহাসের মাধ্যমে। যারা গণহত্যা করেছে, যারা এর সমর্থন করে তারা সমান অপরাধী। তারা মানব সমাজের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তিনি সম্মেলনের অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানান। সভাপতির বক্তৃতায় ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল দেশী-বিদেশী সব অতিথিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীনতার চেতনা ধ্বংস করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল। ধ্বংসপ্রায় স্বাধীনতার চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে গণহত্যা জাদুঘর নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন সেই চেষ্টারই অংশ। গণহত্যা জাদুঘরকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যে সহযোগিতা করছে ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও তাদের বক্তব্যেও গণহত্যা বন্ধে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়ে। সেইসঙ্গে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তারা বলেন, যে ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে সেটি পুনরুদ্ধারের জন্য এ ধরনের সম্মেলন প্রয়োজন। উপস্থিত সব বক্তাই একটি মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। সোমালি কুম বলেন, আমি বাংলাদেশের গণহত্যার ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছি। কম্বোডিয়ায়ও দুই মিলিয়ন লোক হত্যা করা হয়েছিল। গণহত্যার ইতিহাস রচনা নতুন প্রজন্মের শিক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঞ্জয় কে ভরদ্বাজ বলেন, গণহত্যার ইতিহাস জানতে এ ধরনের সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় গণহত্যা জাদুঘর স্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি। একইসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভিন্ন। আমেরিকা-চীনের বিরোধিতা সত্ত্বেও তারা স্বাধীনতা লাভ করেছিল। যেখানে পাকিস্তান আর্মি গণহত্যা চালিয়েছিল। আয়োজকরা জানান, ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের এটি তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ বছর পূর্তি ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়। এদিকে আন্তর্জাতিক এই সম্মেলন শেরেবাংলা একাডেমিতে বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর ৬ষ্ঠ বার্ষিক সম্মেলন হয়। এতে ইতিহাস সম্মিলনীর সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে এবং সেমিনার সম্পাদক তপন পালিতের সঞ্চালনায় বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোঃ মাহবুবর রহমান। বক্তব্য রাখেন ড. মনিরুজ্জামান শাহীন ও ড. চৌধুরী শহীদ কাদের। জেলা প্রতিনিধিদের মধ্য বক্তব্য রাখেন দিনাজপুরের মোজাম্মেল বিশ্বাস, কুমিল্লার হাসান ইমাম মজুমদার, রাজশাহীর কামরুজ্জামান, পাবনার ড. মোঃ হাবিবুললাহ, বরিশালের ড. এস এম কাইয়ুমউদ্দিন আহমদ, খুলনার অমল গাইন প্রমুখ। কর্ম অধিবেশনে জাতীয় অধ্যাপক সালাউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পুরস্কার দেয়া হয় রেহানা পারভীন ও হোসনে আরা খানমকে। পরে অধ্যাপক মোঃ মাহবুবর রহমানকে সভাপতি এবং চৌধুরী শহীদ কাদেরকে সম্পাদন করে সম্মিলনীর নতুন কমিটি গঠিত হয়। সম্মিলনীর উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি মনোনীত হয়েছেন ড. মুনতাসীর মামুন। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, সবাইকে ইতিহাস চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে। অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইতিহাস চর্চা না করলে সত্যের অপলাপ ঘটবে। শুধু ইতিহাস চর্চা নয়, ইতিহাসের ভাল শিক্ষক হওয়াও জরুরী। মুজিব বর্ষ ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নতুনভাবে কাজ করার প্রত্যয় তিনি ব্যক্ত করেন। অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাস চর্চার যে ধারার সম্মিলনীর সৃষ্টি করেছে, তার সত্যিকারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। কর্ম অধিবেশনে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, পাবনা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল রাজশাহী নানা জেলা থেকে তিনশজন শিক্ষক সাংবাদিক গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক গবেষক ইতিহাসপ্রেমী শ্রেণী-পেশার মানুষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
×