ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও বেসরকারী ব্যাংকগুলো জমা নেয় না ;###;সচল পুরনো নোট না নিলে এমডিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশনা রয়েছে

ভোগান্তিতে গ্রাহক ॥ ব্যাংক, এটিএম বুথে ছেঁড়া, ফাটা ও জাল নোট

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

ভোগান্তিতে গ্রাহক ॥ ব্যাংক, এটিএম বুথে ছেঁড়া, ফাটা ও জাল নোট

রহিম শেখ ॥ আরিফুল ইসলাম পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক লেনদেন মেটাতে প্রতিদিনই তাকে যেতে হয় বিভিন্ন ব্যাংকে। ব্যবসার স্বার্থেই ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়মিত টাকা জমা রাখতে হয় তাকে। সম্প্রতি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু পুরোনো, ছেঁড়া-ফাটা নোট নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। রাজধানীর মিরপুর ও পল্লবী এলাকার একাধিক বেসরকারী ব্যাংকে এসব নোট নিয়ে গেলে একটি ব্যাংকও জমা রাখেনি। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, গ্রাহকের কাছ থেকে ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লা নোট গ্রহণের পাশাপাশি বিনিময় মূল্য প্রদান করতে বাধ্য বেসরকারী ব্যাংক। এমনকি এই সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর (এমডি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। অন্যদিকে এটিএম বুথ থেকে বের হওয়া ছেঁড়া-ফাটা ও পুরোনো নোট নিয়ে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা। কখনও কখনও এটিএম বুথ থেকে পাওয়া যাচ্ছে জাল নোটও। জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে ছেঁড়া, ফাটা, ফুটো ও ময়লা নোট হাতে চলে আসলেও ব্যাংকের মাধ্যমে তা বদল করে নিতে পারছেন না তারা। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নোট বদল করে নিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে’ আসা এমন অভিযোগের সংখ্যাও কম নয়। সম্প্রতি এমন একটি অভিযোগ করেন রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রীতা নাহার। তিনি তার লিখিত অভিযোগে বলেন, কিছুদিন আগে পল্লবী এলাকার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে দেখেন অনেকগুলো ভাল নোটের মধ্যে একটি ৫শ’ টাকার ময়লাযুক্ত ছেঁড়া-ফাটা নোট। পরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে এমন অভিযোগ জানালে ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই নোট জমা দেয়ার দুই মাস পর নতুন নোট পাবেন। পরে অন্য ব্যাংকে গিয়েও এই নোট তিনি বদলাতে পারেননি। শুধু ঈদ উৎসব ছাড়া অন্য যে কোন সময়েই এটিএম বুথে পুরোনো নোট বেশি মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই এটিএম বুথ থেকে বের হচ্ছে ছেঁড়া, ফাটা, ফুটো ও ময়লা নোট। ব্যাংকে গিয়ে বদলাতে না পেরে এসব নোট নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়ছেন গ্রাহকরা। এমনই একজন গ্রাহক ফার্মগেট এলাকার ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গত শনিবার (১৬-১১-১৯) রাতে ফার্মগেটের প্রাইম ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে দেখি একটি ছেঁড়া ও দুইটি ফুটো নোট বেরিয়ে আসে। তাৎক্ষণিক বুথে থাকা গার্ডকে জানালে সে জানায় ব্যাংকে গিয়ে অভিযোগ করতে। পরদিন রবিবার প্রাইম ব্যাংকের কাওরান বাজার শাখায় অভিযোগ জানালেও তারা টাকা ফেরত দেয়নি। এরপর গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ছেঁড়া নোটের নতুন নোট দেয়া হয়।’ তিনি জানান, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে দালালদের কারণে সাধারণ মানুষের ছেঁড়া নোট পরিবর্তন করতে অনেক সময় লেগে যায়।’ বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ছেঁড়া নোট বিনিময়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা রয়েছে। গ্রাহকের ছেঁড়া টাকা মেশিনের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়। এক্ষেত্রে ছেঁড়া টাকার পরিমাণ ৫১ শতাংশ হলে গ্রাহক পাবে ৫০ শতাংশ, ৫১ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ হলে পাবে ৭৫ শতাংশ এবং ৭৬ শতাংশ থেকে ৯১ শতাংশ হলেও ৭৫ শতাংশ পাবে। এক্ষেত্রে গ্রাহক সরাসরি ব্যাংকে জমা দিয়ে নতুন টাকা নিতে পারবেন কিন্তু যদি ৯১ শতাংশ এক খ-ের হয় পুরো টাকাই পাওয়া যাবে। ৯১ শতাংশ ৩ খ- হলে সরাসরি টাকা বিনিময় করতে পারবেন না। যেভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন টাকা সরবরাহ করা হয় ঠিক সেভাবেই পুরাতন ছেঁড়া, ফাটা, পোড়া, পোকায় খাওয়া ও জাল নোট বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায়। এরপর এ টাকাগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েন ভল্টে রাখা হয়। সেখান থেকে বিডি শাখা টাকাগুলো পরীক্ষা করে ও ভ্যালু হিসাব রাখে। সেখান থেকে আবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কমিটিতে পাঠানো হয় এবং পরীক্ষা করা হয়- এ টাকার সঙ্গে কোন ভাল টাকা আছে কিনা। তার পর চুল্লীতে পোড়ানো হয়। জানা গেছে, সব ব্যাংকের শাখাগুলোকে জনসাধারণের কাছ থেকে ছেঁড়া, ফেটে যাওয়া ও ময়লা নোট গ্রহণ করতে প্রতিবছরই বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওইসব নির্দেশনায় একইসঙ্গে কোন ব্যাংক কী পরিমাণ ছেঁড়া, ফাটা ও ময়লা নোটের বিনিময়ে নতুন নোট সরবরাহ করেছে তার মাসিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাঠাতে বলা হয়। এজন্য ব্যাংকের প্রত্যেকটি শাখায় একটি বিশেষ ডেস্ক স্থাপন করে নোটের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়েও নির্দেশনা দেয়া হয়। আরও বলা হয়, ব্যাংকের সব শাখায় জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় এমন স্থানে ‘ছেঁড়া, ফাটা ও ময়লা নোট গ্রহণ করা হয়’ মর্মে নোটিস দিতে হবে। নির্দেশনায় বলা হয়, ময়লা অবিকৃত নোট জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার বিনিময় মূল্য দিতে বাধ্য থাকবে ব্যাংক। ছেঁড়া নোট যদি মূল নোটের ৯০ শতাংশের বেশি হয় সেক্ষেত্রেও কাউন্টার থেকে বিনিময় মূল্য দিতে হবে। এছাড়া কোন ব্যক্তি জাল নোট বা একাধিক নোটের বিচ্ছিন্ন অংশ যোগ করে উপস্থাপন করলে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। এতে আরও বলা হয়, গ্রাহকের কাছ থেকে ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লা নোট গ্রহণের পাশাপাশি বিনিময় মূল্য প্রদান না করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, সব ব্যাংকের শাখাগুলোকে জনসাধারণের কাছ থেকে ছেঁড়া, ফেটে যাওয়া ও ময়লা নোট গ্রহণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। কোন ব্যাংক যদি নোট বদল করে দিতে অনীহা প্রকাশ করে ওই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এমনকি প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সবগুলো শাখাতেও নোট বদল করে নিতে পারছেন গ্রাহকরা। এদিকে এটিএম বুথ থেকেও বের হচ্ছে ছেঁড়া-ফাটা ও পুরোনো নোট। যা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা। কখনও কখনও এটিএম বুথ থেকে পাওয়া যাচ্ছে জাল নোটও। সম্প্রতি এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন বেসরকারী চাকরিজীবী এম আর রহমান। জরুরী প্রয়োজনে যান রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে। পকেটে নগদ টাকা নেই। গাড়ি ভাড়া দেবেন বলে ইউসিবির ভিসা কার্ড দিয়ে ব্যাংক এশিয়ার এলিফ্যান্ট রোডের বুথ থেকে টাকা তুলতে যান। কিন্তু টাকা তুলেই বিপাকে পড়েন রহমান। কারণ বুথ থেকে যে ৫০০ টাকার নোট বের হয়েছে তা ছেঁড়া। নোটের কোনার একটা অংশ নেই। উপায় না পেয়ে এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে গাড়িভাড়া পরিশোধ করেন তিনি। বেসরকারী ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এক গ্রাহককেও বুথ থেকে টাকা তুলে বিপাকে পড়তে হয়। গত ১৭ অক্টোবর ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলে ওই ব্যাংকেরই একটি শাখায় জমা দিতে যান নজরুল ইসলাম। ওই শাখা দুটি নোট জাল হিসেবে শনাক্ত করে। পরে পাঞ্চ করে ফুটো করে দেয়া হয় নোট দুটি। নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যখন বলি যে, আপনাদের বুথ থেকেই মাত্র টাকা তুলেছি। তখন অফিসার বলেন, বুথগুলো ম্যানেজমেন্ট করে থার্ড পার্টি। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।’ এভাবে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা। তাৎক্ষণিক কোন প্রতিকারও মিলছে না। ভোগান্তিতে পড়া রহমান বলেন, গত ৬ অক্টোবর ইউসিবির ভিসা কার্ড দিয়ে ব্যাংক এশিয়ার এলিফ্যান্ট রোডের বুথ থেকে টাকা তুললে ছেঁড়া নোট বের হয়। নোটের কোনার ছোট একটা অংশ ছিল না। সেখানে আলাদা কাগজের আলাদা টুকরা লাগানো ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিলে তারা বলে, ‘আপনার উচিত ছিল বুথের ক্যামেরার সামনে নোটটা ধরে রাখা। যেহেতু করেননি তাহলে নিকটস্থ ব্রাঞ্চে যান, তারা নোটের অবস্থা দেখে বলতে পারবেন এবং বদলে দিতে পারেন। কিন্তু পাশে কোন শাখা না পাওয়ায় আমি বদলাতে পারিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ত্রুটিপূর্ণ নোট বুথের ক্যামেরার সামনে ধরা, সংশ্লিষ্টদের জানানো- এত ঝামেলা না করে সেবা উন্নত করলেই পারে। কারণ তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলা। সবাই তা-ই করে। এ কারণে ব্যাংকের উচিত বুথে জাল, ছেঁড়া ও ত্রুটিপূর্ণ নোট না রাখা। তাহলে গ্রাহক এ ধরনের সমস্যায় পড়বে না।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনের তাগিদে এটিএম বুথে লেনদেন বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে ভোগান্তিও। কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়া, বুথে জাল ও ছেঁড়া নোট, সবসময় পর্যাপ্ত টাকা না থাকাসহ নানা জটিলতা রয়েছে এটিএম বুথগুলোতে। যেহেতু গ্রাহক তাৎক্ষণিকভাবে লেনদেন করেন তা-ই সেবার মান নিশ্চিত করতে তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন। বুথ-সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোকে ইতোমধ্যে সতর্ক করা হয়েছে। অবহেলা বা প্রতারণার অভিযোগের প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা ও কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ নিয়মিত পরিদর্শন করি। এখন পর্যন্ত বেশকয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের জাল ও ছেঁড়া নোট না দেয়াসহ সেবার মান বাড়াতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটিএম সেবার মান বাড়াতে কঠোর হয়েছে। যদি কোন ব্যাংকের এটিএম সেবা নিয়ে অবহেলা বা প্রতারণার অভিযোগ আসে এবং তা প্রমাণ হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা ও কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটিএম সেবার মান বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো চেষ্টা করছে। আশা করি, আগামীতে এটিএম সেবার মান আরও উন্নত হবে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এটিএম বুথের সেবা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। যেহেতু এ সেবার আওতা বেড়েছে, কিছু সমস্যাও হচ্ছে। তবে কিছু ব্যাংক তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এ সেবা দিচ্ছে। তাদের ভুলের কারণে অনেক সময় সমস্যা তৈরি হয়। আমরা এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করছি। ‘আশা করছি, গ্রাহক আগামীতে আরও ভাল সেবা পাবে’।
×