ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:১৩, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বাংলাদেশ

মিথুন আশরাফ, কলকাতা থেকে ॥ ইডেন গার্ডেন্সের ভিআইপি গেটের সামনে জটলা বেঁধে আছে। আর সেই জটলা থেকে সুর ভেসে বেড়াচ্ছে, ‘দিবারাত্রির টেস্ট রাঙাল গোলাপি বল, খেলা শেষ হবে কয়দিনে বল?’। জিতবে কোন দল, তা তো সবারই জানা। দলটি ভারতই হবে। অঘটন না ঘটলে ভারতই জিতবে। কিন্তু কয়দিনে খেলা শেষ হবে। এর জবাব এখন মুশফিকুর রহিমই ভাল দিতে পারবেন। খেলা যে আজই শেষ হয়ে যেতে পারে, তার আলামতও মিলে গেছে। মুশফিকের অপরাজিত ৫৯ রানের ইনিংসে আশাও জাগছে। সেই আশা আসলে ম্যাচ বাঁচানো নয়, ইনিংস হার এড়ানো। ইশান্ত শর্মার গতি আর বাউন্স। বিরাট কোহলির কাব্যিক সেঞ্চুরির ইনিংস। এই দুইয়ে মিলে বাংলাদেশের এমনই করুণ দশা হয়েছে, ইনিংস হারের শঙ্কাতেই পড়ে গেছে বাংলাদেশ। এখন মুশফিকই বাঁচাতে পারেন। ৮৯ রানে পিছিয়ে থেকে আজ তৃতীয়দিনের খেলা শুরু করবেন মুশফিক। যদি ইনিংস আরও বড় করতে পারেন তাহলেই ইনিংস হার এড়ানো সম্ভব। মুশফিকের ব্যাটিং নৈপুণ্যে সেই আশা দেখাও হচ্ছে। প্রথমদিনই বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস গুটিয়ে গেছে। ১০৬ রানে খতম হয়েছে। দ্বিতীয়দিন কোহলির সেঞ্চুরিতে, ১৩৬ রানের ইনিংসে ভারত ৯ উইকেট হারিয়ে ৩৪৭ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। বাংলাদেশ থেকে ২৪১ রানে এগিয়ে থাকে ভারত। এরপর বাংলাদেশ আবার দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নেমে ৭০ বলে ১০ চারে অপরাজিত ৫৯ রান করা মুশফিকের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৫২ রান করে ৮৯ রানে পিছিয়ে রয়েছে। ইশান্ত ৪ উইকেট নেন। প্রথমবার ভারতের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলে বাংলাদেশ। সেই সিরিজে এমনই অবস্থা যা ভুলেই যেতে চাইবেন যে কেউ। ইন্দোর টেস্টে ইনিংস ও ১৩০ রানে হারে বাংলাদেশ। তখনই সিরিজে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে। ইডেন গার্ডেন্সে গোলাপি বলে দিবারাত্রির টেস্ট তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ক্রিকেটাররা থাকেন চিন্তায়। গোলাপি বলে আসলে কিভাবে খেলা হবে। ব্যাটসম্যান কিংবা বোলাররা কি করতে পারবেন। ভারত ব্যাটসম্যান-বোলাররা ঠিকই নিজেদের মেলে ধরতে পেরেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা শুধুই হতাশা ছড়িয়েছেন। মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যদি হাল না ধরতেন, তাহলে যে কী হতো! শুরু থেকেই ইশান্ত শর্মার বাউন্সে এমনই ভীত হয়ে পড়েন সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, মোহাম্মদ মিঠুন (৬), ইমরুল কায়েস (৫) ১৩ রানেই ৪ উইকেট পড়ে যায়। ইশান্তের বাউন্স একবার মিঠুনের মাথায় লাগে। মনে হয় আবারও ‘কনকাশনে’র সুযোগ নিতে হবে। আর তা হলে তো মহাবিপদ। বাংলাদেশ দলে এখন শুধু মুস্তাফিজুর রহমানই একাদশের বাইরে আছেন। লিটন কুমার দাস, নাঈম হাসান প্রথমদিনই মাথায় আঘাত পান। তাদের টেস্ট শেষ হয়ে যায়। ‘কনকাশনে’র সুযোগ নিয়ে লিটনের পরিবর্তে মিরাজ ও নাঈমের পরিবর্তে তাইজুল নামেন। যদি মিঠুনেরও টেস্ট শেষ হয় তাহলে মুস্তাফিজ ছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। আর তাই ইমার্জিং এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলা বাংলাদেশ দলের নাজমুল হোসেন শান্তকে কলকাতায় আনা হয়। কোন ব্যাটসম্যানের সমস্যা হলেই শান্ত নামবেন। যখন শান্তকে নিয়ে আলোচনা হতে থাকে তখনই মাহমুদুল্লাহ মাঠ থেকে বের হন। হ্যামস্ট্রিংয়ে তার টান পড়ে। মুশফিকের সঙ্গে কি সুন্দর ব্যাটিং করতে থাকেন। ১৩ রানেই ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর মুশফিকের সঙ্গে এগিয়ে চলতে থাকেন মাহমুদুল্লাহ। দলকে ৮২ রানে নিয়েও যান। নিজেও ৩৯ রান করে ফেলেন। কিন্তু হ্যামস্ট্রিংয়ের টানে স্বেচ্ছায় অবসর নিতে হয়। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম টেস্টে ভারতের বিরুদ্ধে যে দ্বিতীয় ইনিংসে ৯১ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ, সে রকমই না আবার হয়; সেই আতঙ্কও তৈরি হয়। কিন্তু মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ দলকে এই রানের কাছাকাছি নিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ শতরানের স্কোরও করে। যখন দলের ১০৮ রান হয় তখন রবীচন্দ্রন অশ্বিনের বলে আবার মেহেদী হাসান মিরাজ স্লিপে ক্যাচ আউট হওয়া থেকেও বাঁচেন। ‘নতুন জীবন’ পেয়ে সাবধান হয়ে যান মিরাজ। এমনকি মোহাম্মদ শামির বলে ছক্কাও হাঁকান। অবশ্য শামির সেই বলটিতে গা বাঁচাতে গিয়ে থার্ড ম্যান দিয়ে ছক্কা মারেন। তাতে সবাই অবাক হয়ে যান। মিরাজের ছক্কা মারাতে অবাক হলেও এমন কঠিন পরিস্থিতিতে মুশফিক যে হাফ সেঞ্চুরি করেন তা প্রশংসার দাবিদার হয়ে ওঠে। প্রশংসাও পান মুশফিক। তখন মাহমুদুল্লাহর মাঠ থেকে বের হয়ে যাওয়া নিয়ে সবার ভেতরই আফসোস দেখা যায়। মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ জুটি ৬৯ রানের হয়। যদি মাহমুদুল্লাহ থাকতেন তাহলে তিনি আগেই হাফ সেঞ্চুরি করতেন। এমন যখন সবার মুখে আলোচনা, তখন ইশান্তের বলে আউট হয়ে যান মিরাজ (১৫)। তাতেও আফসোস থাকে। মুশফিকের সঙ্গে মিরাজও যে ৫০ রানের জুটি গড়ে ফেলেন। উইকেট আঁকড়ে থাকলে হয়তো দিনটিও শেষ করতে পারতেন। মুশফিকের ভাগ্য ভাল। একের পর এক ‘রিভিউ’ নিয়ে বেঁচেছেন। দিনের শেষভাগে অশ্বিনের বলে এলবিডব্লিউ হওয়া থেকে ‘রিভিউ’ নিয়েও বাঁচেন। বাংলাদেশ দেড় শ’ রানও করে ফেলে। তাইজুল ইসলামকে নিয়েও সুন্দর পথ চলতে থাকেন মুশফিক। দেড় শ’ রানও হয়ে যায়। দিনটি শেষ হওয়ার শেষ বলে গিয়ে তাইজুল (১১) আউট হয়ে যান। তাতে করে ৬ উইকেটের পতন ঘটে যায়। এখন যদি বাংলাদেশ ৮৯ রান করতে পারে তাহলে ইনিংস হার এড়ানো সম্ভব। আর যদি মাহমুদুল্লাহ আজ ব্যাট হাতে নেমে একইভাবে ব্যাটিং করতে পারেন তাহলে তো কথাই নেই। তা নাহলে ইন্দোর টেস্টের পর আবারও ইনিংস হার হবে। প্রথমদিন সাবলীল খেলেন কোহলি। দ্বিতীয়দিন আরও বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন। প্রথমদিন ভারত ৩ উইকেট হারিয়ে ১৭৪ রান করে দিন শেষ করে। ৬৮ রানে এগিয়ে থেকেছে। বিরাট কোহলি ৫৯ রানে ও অজিঙ্কা রাহানে ২৩ রানে অপরাজিত ছিলেন। দ্বিতীয়দিন দুইজন ব্যাট হাতে নেমে খেলতেই থাকেন। একটা সময় এমনই অবস্থা হয় এই দুইজনই রানের পাহাড়ে চাপা দেবেন বাংলাদেশকে। এরপর ইনিংস ঘোষণা করবেন। তারপর বাংলাদেশকে যত দ্রুত অলআউট করা যায়। কিন্তু যখনই ভারত ২৩৬ রানে যায়, তখনই ‘কনকাশন’ সুবিধায় নাঈম হাসানের পরিবর্তে বোলিং করার সুযোগ পাওয়া তাইজুল ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হন। ৫১ রান করা রাহানেকে আউট করে দেন। চতুর্থ উইকেটে কোহলি-রাহানের জুটি ৯৯ রান পর্যন্ত যায়। শতরানের জুটি হয়নি। তবে ততক্ষণেই বাংলাদেশের বারোটা বেজে যাওয়ার কাজ হয়ে যায়। ১৩০ রানে যে এগিয়ে যায় ভারত। যে ব্যাটিং প্রথম ইনিংসে করেছে বাংলাদেশ, তাতে এই রানই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য যথেষ্ট। এমনও বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা তাই করতে পারবেন না, তাও আলোচনা হয়। কিন্তু কোহলি কী আর ছাড়বেন? তিনি তখন ৮৯ রানে থাকেন। ক্যারিয়ারের ২৭তম টেস্ট সেঞ্চুরি করার সুযোগ। উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো দিবারাত্রির টেস্ট হচ্ছে। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে উপমহাদেশে সেঞ্চুরি করার সুযোগ। তা কি আর হাতছাড়া করবেন কোহলি। করেনওনি। ‘গোলাপি বলে’র টেস্ট প্রথমবার খেলতে নেমেই সেঞ্চুরি হাঁকান। ১৫৯ বলে সেঞ্চুরি করেন তিনি। তার এই সেঞ্চুরিতে বড় সংগ্রহের পথে এগিয়ে যেতে থাকে ভারত। সেঞ্চুরি করার পর যেন আরও মারমুখী হয়ে ওঠেন কোহলি। আবু জায়েদ রাহীর এক ওভারে চারটি বাউন্ডারিও হাঁকান কোহলি। ইডেন টেস্ট দেখতে আসা দর্শকরাও উৎসবে মাতেন। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যান। কোহলি যেন উৎসবের রং আরও ছড়িয়ে দেন। সবার মুখে একটি কথাই থাকে। ঐতিহাসিক টেস্ট। এমন টেস্টে কোহলির মতো ব্যাটসম্যানেরই সেঞ্চুরি করা উচিত। তা না হলে আসলে আসল মেজাজ পাওয়া যায় না। কোহলি সেঞ্চুরি করে দেখালেন। রবীন্দ্র জাদেজাকে নিয়ে এগিয়েও যেতে থাকেন। জাদেজা একদিকে উইকেটে টিকে থাকেন। আরেকদিকে কোহলি রান তুলতে থাকেন। দলের যখন ২৮৯ রান হয় তখন জাদেজাকে (১২) আউট করে দেন রাহী। ৫৩ রানের জুটিও ভেঙ্গে যায়। এরপর কোহলিও আর খুব বেশিদূর যেতে পারেননি। দল ৩০০ রান করে। যখন ৩০৮ রান হয় তখন কোহলিকে আউট করে দেন এবাদত হোসেন। তবে এই আউটের সব কৃতিত্ব আসলে তাইজুল ইসলামের। তিনি শূন্যে লাফিয়ে স্কয়ার লেগে যে ক্যাচ ধরেন তাইজুল, তাতে সবাই অবাক হন। হতভাগ হন ১৯৪ বলে ১৮ চারে ১৩৬ রান করা কোহলি নিজেও। কোহলি আউটের পর অবশ্য ভারত খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেনি। টপাটপ উইকেট পড়তেও থাকে। ৩৩১ রানের মধ্যেই আরও ৩টি উইকেট পড়ে যায়। যখন ৩৪৭ রান হয় তখন ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। ২৪১ রানে ভারত এগিয়ে থাকায় এক ইনিংসই যে খেলতে হয়েছে তা বোঝা হয়ে যায়। তখন এক সেশনের বেশি থাকায় আলোচনার শুরু হয়ে যায়, দ্বিতীয়দিনই খেলা শেষ হয়ে যাবে না তো! প্রথম ইনিংসে যে বাংলাদেশ এক সেশনের কিছু বেশি সময় ব্যাটিং করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুশফিকের ব্যাটিং নৈপুণ্যে খেলা তৃতীয়দিনে নেয়া যায়। ইনিংস হার এড়ানোর আশাও জাগে।
×