ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিহতদের জানাজা, দাফন ॥ পুরাতন আইনে মামলা, তদন্ত কমিটির কাজ শুরু

মুন্সীগঞ্জের নাগেরহাট গ্রামে কান্নার রোল, বুকফাটা আর্তনাদ

প্রকাশিত: ১১:১২, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

মুন্সীগঞ্জের নাগেরহাট গ্রামে কান্নার রোল, বুকফাটা আর্তনাদ

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ মুন্সীগঞ্জে দুর্ঘটনায় নিহত ৯ জনের স্বজনরা আহাজারি করছেন। এদিকে এ ঘটনায় পুরাতন আইনে মামলা হয়েছে। তবে এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। লৌহজং উপজেলার পদ্মা তীরের কনকসার নাগেরহাট গ্রাম যেন এখন শোকে কাতর। স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ আর গ্রামবাসীর শোক চলছেই। রাতভর ছিল কান্নার রোল, বর রুবেল ব্যাপারীর বাড়ি ঘিরে হাজারো মানুষের ভিড় আর বুক ফাটা আর্তনাদ ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। দূর থেকেই এই কান্নার রোল শোনা যাচ্ছিল। চারদিকে আহাজারি আর আহাজারি। শনিবারও এই কান্না থামছে না। সারি সারি লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় এই কান্না যেন আরও বেড়ে যায়। কে জানত বর যাত্রাই হবে শেষ যাত্রা। এমনভাবেই এত মানুষের জীবন কেড়ে নিল যন্ত্র দানব, তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না স্বজন কিংবা গ্রামবাসী। মুহূর্তের মধ্যে এ কি হয়ে গেল। সব কিছুই উলট-পালট। আনন্দ বিষাদে পরিণত হলো। গ্রামটির মধ্যবয়সী মিজানুর রহমান বলেন, শোক যে কত বেশি ভারি হতে পারে তা আমরা গ্রামবাসীরাই বুঝতে পারতাছি। এক পরিবার তছনছ হয়ে গেল। আর প্রতিবেশী আর দুই মুরব্বির মৃত্যু পুরো গ্রামকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এদিকে এ দুর্ঘটনায় নিহত ৯ জনের মধ্যে আট জনের একই সঙ্গে জানাজা হয়েছে। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে লৌহজং উপজেলার কনকসার বটতলা গ্রামের বাহ্মনগাঁও উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এই আট জনের জানাজা হয়। পরে হলদিয়া গ্রামের সাতঘড়িয়া কবরস্থানে সাত জনের দাফন সম্পন্ন করা হয়। রুবেলের ভাই সাহেলের শ্যালিকা রেণু আক্তারের জানাজা একত্রে হলেও দাফন করা হয় পার্শ্ববর্তী তাদের কাহেতারা গ্রামের সামাজিক কবরস্থানে। এছাড়া চালক বিল্লাল হোসেনকে পৃথক জানাজার পর তার গ্রামের বাড়ি সিরাজদিখানে দাফন করা হয়। জানাজায় শত শত লোক অংশগ্রহণ করেন। জানাজায় ইমামতি করেন লৌহজং টেউটিয়া ইউনিয়ন মসজিদের পেশ ইমাম। এ সময় সেখানে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সকলেই ছিল শোকাতুর। জানাজার কিছু পূর্বে নিহতদের বাড়িতে উপস্থিত হন মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। তিনি শোকাহত পরিবারকে সান্ত¦না দেন। এদিকে এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। কমিটির চেয়ারম্যান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দীপক কুমার রায় জানান, শুক্রবার রাতেই তিনি কমিটির পত্র পেয়েছেন। বাকি ছয় সদস্যের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে খোঁজখবর করা হচ্ছে। তবে রবিবার তদন্ত কমিটি সরেজমিন ঘটনা পরিদর্শনসহ খুঁটিনাটি বিষয় উদঘাটনে কাজ করবে। সঠিক কারণ উদঘাটনে সব প্রচেষ্টা তারা চালাবেন বলেন জানান। প্রকৃতপক্ষে এ দুর্ঘটনার জন্য কে বা কারা দায়ী তা চিহ্নিত করা হবে। তবে এখনই তিনি এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি নন। একই সঙ্গে তিনি নতুন আইন নিয়ে কথা বলেন দীপক কুমার রায় বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে সকলের জন্যই ভাল। সড়কে সুশৃঙ্খলা ফিরে আসবে। দুর্ঘটনা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। জেলা প্রশাসন গঠিত এই কমিটি আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এদিকে বর রুবেল ব্যাপারী এই শোক যেন সহ্য করতে পারছিলেন না। নির্বাক এই মুদি দোকানি রুবেল। ফ্যাল ফ্যাল করে কাঁদছেন। এমন শোক আমি কেমনে সইবো। স্বামী, সন্তান, নাতি-নাতনিদের হারিয়ে রুবেলের মা যেন দিশেহারা। এই মায়ের আর্তনাদে উপস্থিত কেউই অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলেন না। আয়শা বেগম আহাজারি করছিলেন-আমিতো সইতে পারছি না। মুন্সীগঞ্জের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রাজিবুল ইসলাম বলেন, নতুন ট্রাফিক আইন প্রয়োগ ছাড়া দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এতে শুধু যাত্রী নয় চালকরাও নিহত হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গাড়ির মালিকরা। সকলের স্বার্থে দেশ ও জাতির কথা বিবেচনা করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন আইনকে গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। মুন্সীগঞ্জ ক্যাবের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম মন্টু বলেন, মুন্সীগঞ্জের মর্মান্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনার পরে সব মহলে আলোচনা হচ্ছে সকলের স্বার্থেই নতুন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন জরুরী। শ্রীনগর থানার ওসি হেদায়েতুল ইসলাম ভূইয়া শনিবার সন্ধ্যায় জানিয়েছেন, এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৯ জন নিহত হয়েছে। তবে আরও দুজন গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পুরাতন আইনে মামলা মুন্সীগঞ্জের শুক্রবারের সড়ক দুর্ঘটনায় পুরাতন আইনেই মামলা দায়ের হয়েছে। শুক্রবার রাতেই মামলাটি হাসাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে এন্ট্রি দেখানো হয়েছে। এই মামলায় একজনকে আসামি করা হয়েছে। স্বাধীন পরিবহনের অজ্ঞাতনামা চালক মামলাটির আসামি। এই ফাঁড়ির সাব ইন্সপেক্টর দেলোয়ার হোসেন খান মামলাটির বাদী হয়েছেন। তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন ফাঁড়িটির আরেক সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) মোঃ শাহজাহান মিয়া। এসআই মোঃ শাহজাহান মিয়া জানান, উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পুরাতন আইনে মামলাটি রুজু করা হয়। তিনি আরও জানান, তদন্ত চলছে এবং আসামির নাম ঠিকানা উদঘাটনে চেষ্টা চলছে। জন্মদিন শেষ বিদায়ের দিন শনিবার ছিল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তাবাসসুমের জন্মদিন। সেই দিনেই চির নিদ্রায় শায়িত হলো নিষ্পাপ এই শিশু। ব্যাংকার বাবা নিজ হাতে সন্তানকে কবরে রাখলেন। জন্মদিন পরিণত হল শোকের দিনে। তাবাসসুমের বাবা মোঃ মনিউর ইসলাম বলেন, এ আমার কল্পনায়ও ছিল না। এভাবে আমার আদরের মেয়েটাকে হারাতে হবে, তা কোনদিন ভাবতেও পারিনি। শুধু আমার মা মনিই নয়, ঘাতক বাস কেড়ে নিয়েছে আমার জীবন সঙ্গীনী স্ত্রীকেও। ওদের হারিয়ে আজ আমি নিঃস্বই হয়ে গেলাম। শনিবার চাপা কান্নায় এমনই বলছিলেন বিয়ের বর যাত্রীর মাইক্রোবাস ও বাস মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত তাবাসসুম আক্তারের (৫) বাবা ও নিহত লিজা আক্তারের (২২) স্বামী ঢাকার কামরাঙ্গীরচর অগ্রণী ব্যাংক শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মোঃ মনিউর ইসলাম। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের কনসার গ্রামের নিহত আব্দুল রশিদ বেপারির পুত্র রুবেলের বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে মাতম। বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শত শত লোক উঠানের মাঝে দাঁড়িয়ে ঘিরে আছে। দক্ষিণের ভিটির ঘরের সামনে বসে আছে ওই বাড়ির জামাতা ও নিহত তাবাসসুমের বাবা ও লিজার স্বামী। তার পাশে শাশুড়ি আয়েশা বেগম আর নিজের মা মনোয়ারা বেগম। নিহত মেয়ে ও স্ত্রীর কথা স্মরণ করে কখনও কাঁদছেন তিনি। আবার কখনও মা ও শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে নিজেই নিজেকে সান্ত¦না দিচ্ছিলেন। বলছিলেন ওরা আমাদের ছেড়ে গেলে কি হবে, আমি আমার এই দুই মাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। তিনি বলেন, গত ২০-২৫ দিন আগে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আকাশ ভাসানি নভো থিয়েটারে গিয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে আকাশ ভরা চাঁদ দেখিয়ে অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা দেখিয়ে নিয়ে এসেছি। এবার ভাবছিলাম ওদের নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে যাব। আমি অনেকবার কক্সবাজার ঘুরেছি, ওরা কখনও যায় নাই। কিন্তু আমার সে স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে ওরা আমাকে একা ফেলে চলে গেল। সরকারের কাছে আমার দাবি এই ঘাতকদের যেন কঠিন বিচার করা হয়। নতুন সড়ক আইন যেন বাস্তবে রূপ দেয়া হয়। আমাদের এই হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের মতো যেন আর কারো পরিণতি এমন না হয়। এ সময় পাশের পশ্চিমের ভিটির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ফেল ফেল করে দাঁড়িয়ে ছিল বর রুবেল বেপারি। কেউ একজন তাকে সান্ত¦না দিচ্ছিলেন। কিন্তু রুবেলকে দেখা গেছে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। কোন কথা যেন তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। শুধু কি যেন একটা অজানা শঙ্কা তার মনের মধ্যে কাজ করছে। জাহাঙ্গীর আলম বেঁচে আছেন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত জাহাঙ্গীর আলম (৪০) বেঁচে আছেন। তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীর শ্রীনগর উপজেলার ছনবাড়ি গ্রামের নুম মোহাম্মদ বেপারীর ছেলে। তিনি এখন ঢাকার মোহাম্মদপুর আল মান্নান হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন। জাহাঙ্গীর আলমের ভাই আলমগীর হোসেন শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, আমার ভাই এখন লাইফ সাপোর্টে আছেন। চিকিৎসকরা এখনও কিছু বলতে পারছেন না। তিনি তার ভাইয়ের জন্য সকলের দোয়া কামনা করেন। বর রুবেলের খালতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম শ্রীনগর উপজেলার ছনবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। ছনবাড়ির বাজারে তার চালের ব্যবসা রয়েছে। তিন কন্যা সন্তানের জনক জাহাঙ্গীর আলমের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া প্রার্থনা করা হয়েছে। এদিকে অনেক গণমাধ্যমে জাহাঙ্গীর আলমকে মৃত বলা হয়েছে। এতে পরিবারের সদস্যরা কষ্ট পেয়েছেন। অনেক স্বজন বিভ্রান্ত হয়েছেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।
×