ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মিল্টন বিশ্বাস

পরিবহন নৈরাজ্যের অবসান কবে?

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

পরিবহন নৈরাজ্যের অবসান কবে?

২০ নবেম্বর (২০১৯) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকের পর দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিকরা। নতুন সড়ক পরিবহন আইনের ১৬টি ধারার মধ্যে ৯টি ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে ২০ নবেম্বর থেকে আকস্মিক ধর্মঘটের ডাক দেয় ট্রাক ও পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও দুদিন ধরে বিভিন্ন রুটে বাস চলাচল বন্ধ রাখে চালকরা। ফলে রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিঘিœত হয়। উল্লেখ্য, ১ নবেম্বর থেকে কার্যকর নতুন সড়ক আইনের বিধিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবসম্মত এবং দেশের পরিবহন সেক্টরে একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য। যেমন, গাড়ি চালানোর জন্য সঠিক লাইসেন্স ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার গাড়ির ফিটনেস, কাগজপত্র হালনাগাদ সময় মতো করতে না পারলে জরিমানার বিধান আছে। তবে নতুন আইনের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এখন পর্যন্ত পার্কিংয়ের জায়গা নির্ধারণ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইওয়েতে চালকদের জন্য বিশ্রামের জায়গা করে দিতে। সেগুলো করা সম্ভব হয়নি। আইন নিয়ে ভীত না হয়ে মেনে চলার শিক্ষা দরকারÑ তারও ঘাটতি আছে ড্রাইভারদের। তবু আমরা নিরাপদ সড়কের ব্যবস্থাপনার দিকে চেয়ে আছি আশা নিয়ে। ॥ দুই ॥ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে ছিলাম। মাসব্যাপী হনলুলু ও মাওয়ি থাকার কারণে সেখানকার সড়ক পথের শৃঙ্খলা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরের অসহনীয় যানজট সেখানে নেই। নেই কোন নিয়ম ভাঙ্গার আয়োজন। কিন্তু পাবলিক পরিবহন হিসেবে এসি বাসের গুরুত্ব সেখানে দেখতে পাবেন আপনি। বড় বড় বাস বিভিন্ন রুটে সময় মেপে চলছে। ৪ ডলার দিয়ে একটি টিকেট নিয়ে সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সকল রুটের বাসে আপনি আরোহন করতে পারবেন নিশ্চিন্তে। কেবল মাওয়ি দ্বীপের সরকারী পরিবহনের হিসাব মতে, বাসে বছরে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ আরোহী হন। নিরাপদ সড়ক বলতে যা বোঝায়, তার সব ব্যবস্থাই সেখানে লক্ষ্য করা যায়। পথচারী পারাপার, হাঁটার পথ, সাইকেল চালানোর আলাদা লেন সবই আছে। আরও আছে শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণমুক্ত সড়ক পরিবেশের নিশ্চয়তা। একই চিত্র আছে জার্মানির বিভিন্ন শহরে। হাইডেলবার্গে সাইকেলনির্ভর ইউরোপীয়দের দেখে আপনার ভালই লাগবে। বড় বড় রেলস্টেশনের বাইরে কয়েক হাজার সাইকেল সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। দূরের যাত্রীরা সাইকেল রেখে গন্তব্যে চলে যাচ্ছে, আবার ফিরে এসে সাইকেল নিয়ে বাসায় পৌঁছাচ্ছে। আবার যদি ঘনবসতিপূর্ণ কলকাতা শহরের দিকে নজর দেন, তাহলে দেখতে পাবেন সেখানেও নিরাপদ সড়ক গড়ে উঠেছে। যানজট কমেছে, পথচারীরা ফুটপাথ ব্যতীত চলাচল বন্ধ করেছে। ভোরের আলো ফোটার আগে ট্যাক্সিগুলো চলাচলের সময় সিগন্যাল বাতি ঠিকই অনুসরণ করে চলে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গেলে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যের সড়কগুলোও দেখার মতো, যা আপনাকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর সিটির বাইরের বিশাল বিশাল মহাসড়কের কথা মনে করিয়ে দেবে। নিরাপদ সড়কের জন্য এই মহাসড়কের যেমন গুরুত্ব রয়েছে; তেমনি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আইন-কানুন কঠোরভাবে মেনে চলার রীতি অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। তাছাড়া কেবল সড়ক পথ নয়, একটি উন্নত শহরের জন্য বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা জরুরী। বিশেষত থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া খালটির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। একইসঙ্গে সেখানে জলযান এবং উড়াল রেলের সংযোগগুলো জনগণকে স্বস্তি দিয়েছে। তথ্যসূত্র মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুুষের জন্য ১ হাজার ১৩৩টি যানবাহন রয়েছে। চীনে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৮ হাজার যানবাহন। ভারতে প্রায় ১৩ হাজার, পাকিস্তানে ৫ হাজার। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি দু’জনে ১টি করে যানবাহন রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ যাত্রী এবং ৮০ শতাংশ পণ্য মহাসড়ক পথে পরিবহন করা হয়। সব মিলে জাতীয় নিরাপদ সড়কের কথা বলতে গেলে দৃৃষ্টান্ত দিয়ে আরও অনেক কথা বলা যায়। বিশেষত দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দিয়েও আমরা সড়ক পথের বাস্তবতা নির্ণয় করতে পারি। সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বলে দেয় বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার চিত্র শোচনীয়। এদেশ সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বের মধ্যে ১৩তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৭ সালে এদেশ ছিল দুর্ঘটনার দিক থেকে এশিয়ার মধ্যে ৭তম স্থানে। গবেষকরা ২০১৭ সালের হিসাব উল্লেখ করে লিখেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশ বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে যানবাহনের অত্যধিক গতি, চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও সড়কের কাঠামোগত দুর্বলতা। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করা হয়েছে। নতুন নতুন রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, ফ্লাইওভার ও ওভারপাস নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও মেরামত করা হচ্ছে। টেকসই, নিরাপদ ও মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো এবং সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজও চলছে। ॥ তিন ॥ ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুর দিনটিকে ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছিল ২৪ বছর ধরে। ওই দাবির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। মর্মান্তিক মৃত্যু ও তা থেকে মানুষকে উদ্ধারের জন্য দিবসটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তবে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে। তাদের আন্দোলন ও দাবি উপস্থাপন সত্ত্বেও নিরাপদ সড়ক এখনও প্রায় দুর্লভ হয়েই রয়েছে। অর্থাৎ পরিবহন খাতে দুষ্টচক্রের দৌরাত্ম্য এখনো বন্ধ হয়নি। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০১৭ সালে প্রতিপাদ্য ছিল ‘সাবধানে চালাবো গাড়ি, নিরাপদে ফিরব বাড়ি।’ দিবসটি পালিত হলেও ২০১৮ সালে স্কুলছাত্ররা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেনি। গত বছর (২০১৮) ‘সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে সচেতনতা বৃদ্ধি ও করণীয়’ প্রতিপাদ্যের আলোকে দিবসটি সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে পালিত হচ্ছে। কিন্তু নিরাপদ সড়কের বাস্তবতা এখনও সুদূর পরাহত। প্রতিদিনই সড়কের অব্যবস্থাপনায় হয়রানির শিকার হচ্ছি আমরা। যানজটে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, জীবনের আয়ুও হ্রাস পাচ্ছে। এজন্যই ২০১৯ সালের নতুন সড়ক আইন আশান্বিত করেছে আমাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ২১ অক্টোবর বলেছিলেন, ‘সম্মিলিত উদ্যোগে দেশে নিরাপদ সড়ক সম্ভব।’ অর্থাৎ সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা এবং পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহ সম্মিলিতভাবে কাজ করবে, এটাই তাঁর প্রত্যাশা। তাঁর মতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ পুনর্গঠনে যুদ্ধবিধ্বস্ত সড়ক অবকাঠামো স্বল্প সময়ের মধ্যে মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করে সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী মহাসড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ইউনাইটেড নেশান্স ডিকেড অব এ্যাকশান ফর রোড সেফটি ২০১১-২০২০ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর অনুসমর্থনকারী হিসেবে গোল -৩.৬ অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতকৃত এ্যাকশন প্লান বাস্তবায়নাধীন আছে। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে মৃত্যুর তৃতীয় কারণ হবে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। এজন্য জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’-এ বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার যে অঙ্গীকার রয়েছে, তার জন্য আমাদের করণীয় হতে হবে নি¤œরূপ। ॥ চার ॥ নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া দরকার। একটানা ৫/৬ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করতে হবে। ঢাকা শহরকে রিকশামুক্ত করা জরুরী। ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চালানো বন্ধ করতে আইনগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের পরিবর্তন আনতে হবে। মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল ও পথচারীদের জন্য আলাদা লেন থাকতে হবে। সড়কের বিকল্প পরিবহন হিসেবে রেল ও নৌযানের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। গাড়ির গতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। চলন্ত গাড়ির ড্রাইভার যেন মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের মাসিক বেতনের ব্যবস্থা থাকলে তারা অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকবে। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যত্রতত্র গাড়ি থামানোর কুঅভ্যাস বন্ধ করতে হবে। এজন্য দরকার ট্রাফিক পুলিশের কঠোর নজরদারি। সব গাড়ির বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। রেন্ট-এ কারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। গাড়ি ভাড়া করার সময় যাত্রীদের বীমা বাধ্যতামূলক হলে দায়বদ্ধতা বাড়বে উভয়পক্ষের। জনগণ, সরকার ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতায় নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবহনের নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে। লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×