ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

ঘূর্ণিঝড়কে জৈবঢাল হিসেবে আটকে দেয় সুন্দরবন

প্রকাশিত: ০৯:০২, ২৩ নভেম্বর ২০১৯

 ঘূর্ণিঝড়কে জৈবঢাল হিসেবে আটকে দেয় সুন্দরবন

(গতকালের পর) পর্যটক বাড়লেও সুবিধা বাড়েনি সুন্দরবনের মনোমুঙ্কর দৃশ্য উপভোগ করতে দিন দিন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। পর্যটকবান্ধব প্রয়োজনীয় আধুনিক নৌযান রয়েছে মাত্র দুটি। নেই সুপেয় পানির কোন ব্যবস্থা। ইংরেজী জানা ও বন সম্পর্কে অভিজ্ঞ গাইডদেরও অভাব প্রকট। দর্শনীয় স্পটের সংখ্যা ও সেখানকার সুযোগ-সুবিধাগুলো বাড়েনি। এ প্রেক্ষাপটে ২০১০ সালে ১৩ কোটি ৬১ লাখ ৭৭৮ টাকা ব্যয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল, হাড়বাড়িয়া, চাঁদপাই ও শরণখোলা পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ নামে একটি প্রকল্প বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। একইভাবে পশ্চিম বিভাগেও দুটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। সিডর ও আইলায় সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠে নতুন রূপ নিয়েছে সুন্দরবন। তাই এখানে ব্যাপক ট্যুরিজম করলে বনের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। এ কারণে পর্যটকদের জন্য বনের নির্দিষ্ট কিছু স্পট নির্ধারিত করা হয়েছে। সিডর ও আইলার পরে দেশী-বিদেশী অর্থ সহায়তায় সুন্দরবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। সেই সঙ্গে বনের সংরক্ষণ ব্যবস্থা আরও গোছালোভাবে করা হচ্ছে। এ বিষয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। সুন্দরবনকে রক্ষায় সুপারিশ সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলে বাঁধের মতো। ঘূর্ণিঝড় প্রায় একশ কিলোমিটার প্রশস্ত এই বন পার হয়ে আসতে স্বাভাবিকভাবেই তীব্রতা হারিয়ে ফেলে। সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সহ্য করে ব্যাপক প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে এই জনপদকে রক্ষা করে। অথচ এই বনটিকে রক্ষায় গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো আমরা এটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। তাই এবারের ঘূর্ণিঝড়ের প্রবলতা কমার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ্যাক্টিভিস্টরা আবারও সুন্দরবন বাঁচানোর বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। এমনকি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানও সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবন রক্ষায় আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। সুন্দরবন নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা বলছেন, সুন্দরবন বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার অন্যতম শক্তি। অথচ তেলের ট্যাঙ্ক ডুবে জল দূষিত হওয়া, বিভিন্ন শিকারি ও বিধ্বংসী নানা শিল্প-উদ্যোগে বারবারই ধ্বংসের মুখে পড়েছে সুন্দরবন। সুন্দরবনের সন্নিকটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েও পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। এগুলো সুন্দরবনকে ধংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করে আসছেন। অথচ বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি কর্তৃক সুন্দরবনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যে’র তালিকায় অন্তর্ভূক্তির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সাউদার্ন সেভেন নামের ৪শ’ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল ভর্তি একটি তেলের ট্যাঙ্কার ডুবে সুন্দরবনে ভয়াবহ দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। এতে আন্ধারমানিক খালের দুই পাড়জুড়ে কালো কার্পেটের মতো ফার্নেস তেলের প্রলেপ লেগে যায়। গাছ আর লতাগুলোর অর্ধেক শরীর তেল মেখে যায়। শত শত শ্বাসমূলে তেল যেন আলকাতরার মতো লেপ্টে থাকে। ভয়াবহ ওই দূষণ থেকে সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য সরকার জাতিসংঘের সহায়তা পর্যন্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের আটটি দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত জাতিসংঘের ২৫ সদস্যের একটি দল টানা পাঁচ দিন সুন্দরবনে অবস্থান করে শ্যালা নদী ও পশুর নদের বিভিন্ন স্থানে তেল ছড়িয়ে পড়ার প্রভাব নিয়ে জরিপ চালায়। জরিপ শেষে যে পৌনে দুই লাখ লিটার তেল সুন্দরবনের নদীর পানিতে মিশে যায় এবং পাড়ে ও গাছে লেগে থাকে তা কিভাবে অপসারণ করা যায়, সেই পরামর্শ দিয়ে যায়। এ সময় তারা মন্তব্য করে যান, সিডর ও আইলার আঘাতে সুন্দরবন নিজে ক্ষতবিক্ষত হলেও মানুষকে বাঁচিয়েছে। অথচ মানুষের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। তবে সুন্দরবন আবারও ক্ষতি কাটিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তেলগ্যাস বিদ্যুত বন্দর খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা খান আসাদুজ্জামান মাসুম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সুন্দরবন আমাদের বাঁচায়, আমরা কি সুন্দরবন বাঁচাতে পারি না?’ উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন)-এর হাসান মেহেদী বলেন, ‘সুন্দরবন নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু বনের প্রতি আমাদের যে দায়-দায়িত্ব তা আমরা পালন করি না। সুন্দরবনের চারপাশে যে কলকারখানাগুলো গড়ে উঠছে তা বনের জন্য ক্ষতিকর। নদীর এপারে সুন্দরবন ওপারে শিল্পকারখানা। আমাদের প্রত্যেকের উচিত আগামীর দিনগুলোর কথা ভেবে সুন্দরবন বাঁচাতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা। বন কিভাবে আগলে রাখে, বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘একক কোনও গাছ নয়, সুন্দরবনের যে প্রশস্ততা সেখানে সম্মিলিতভাবে গাছগুলো প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আর এই প্রশস্ত পুরোটা পথ পাড়ি দিতে দিতে বাতাসের তীব্রতা কমে যায়।’ এই বন কিভাবে সুরক্ষা দেয় সে বিষয়ে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘সমুদ্রে যখন নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় তখন তার তীব্রতা বেশি থাকে। সেটি স্থলভাগে এলে নানা জায়গায় ধাক্কা খায়। সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলে প্রাকৃতিক বাঁধের মতো। বুলবুল বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূল দিয়ে ঢুকলে তীব্রতা অনেক বেশি থাকত। পশ্চিম বাংলার বকখালি দিয়ে প্রবেশ করায় এর তীব্রতা এমনিতেই কমে গেছে।’ এর আগেও সুন্দরবনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সিডর ও আইলার সময় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু সুন্দরবনের সরণখোলার ওপর দিয়ে গেছে সে সময়। সেবারও সুন্দরবন এলাকা পার হয়ে লোকালয়ে ঢোকার সময় তীব্রতা কমে গিয়েছিল। বন নিজের ক্ষতি করে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি আগলে রাখে।’ ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ কেটে যাওয়ার পর এ উপলব্ধিও করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। তিনি দুর্যোগ পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সুন্দরবন বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করছে। সুন্দরবনের প্রতি কেউ যেন অযত্ন-অবহেলা করতে না পারে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে উদ্যোগ নিতে বলব। সুন্দরবনকে রক্ষায় শিগগিরই ২২টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রণয়ন করা হবে। বনে যত্রতত্র গাছ কাটা ঠেকাতে ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বনের নিরাপত্তা বাড়ানো, সেইসঙ্গে বনায়নের জন্য বেশি বেশি গাছ লাগানোর সুপারিশও করবেন তারা। এছাড়া সবুজ উপকূল বেষ্টনী করার বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী রহমান বলেন, ‘সুন্দরবন শুধু এবার না এর আগেও অসংখ্য ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে আমাদের রক্ষা করেছে। আমাদেরও মনে হয়েছে এই দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলকে রক্ষায় আমাদের সুন্দরবনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।’ অধিকাংশ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সুদৃঢ় বর্ম হয়ে এ অঞ্চলকে রক্ষায় সুন্দরবনের অবদান অনস্বীকার্য। নিচ্ছিদ্র সুরক্ষা বেষ্টনী হয়ে ৬.১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাণ ও সম্পদ রক্ষা করে আসছে। শুধু দুর্যোগ থেকে রক্ষায় নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবেই নয়, সুন্দরবন এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম রক্ষাকবচ। তাই সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশকেই সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে হবে। (সমাপ্ত) লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×