ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিনা দোষে খাটল ৪ মাস জেল ॥ পিবিআইর তদন্তে রহস্য উন্মোচন

হতভাগ্য চাষী সরোয়ার ঢাকায় না এসেও গুলশান থানায় আসামি

প্রকাশিত: ১১:১০, ২২ নভেম্বর ২০১৯

হতভাগ্য চাষী সরোয়ার ঢাকায় না এসেও গুলশান থানায় আসামি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জীবনে কোন দিন ঢাকায় না এসেও রাজধানীর গুলশান মডেল থানার একটি ছিনতাই মামলার আসামি হয়েছেন সরোয়ার শেখ নামের এক হতভাগ্য চাষী। ছিনতাইকালে হাতেনাতে ধরা পড়ার পর মিলু মৃধা নামে এক অপরাধী নিজেকে সরোয়ার শেখ বলে পরিচয় দেয়। নিজেকে আড়াল করতে নিজের নাম ঠিকানার জায়গায় খালাত ভাই সারোয়ার শেখের নাম-ঠিকানা দেয় মিলু মৃধা। সেই থেকে পুলিশ ও আদালতের কাছে মিলু মৃধাই হয়ে যায় সরোয়ার শেখ। পরে মিলু মৃধা জামিনে বেরিয়েই আত্মগোপনে চলে যায়। আর পুলিশ সরোয়ার শেখকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে। আদালত সরোয়ার শেখকে দশ বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দেয়, সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। চার মাস জেল খেটে সম্প্রতি সরোয়ার শেখ জামিন পান। সরোয়ার শেখ জামিনে বের হওয়ার পর এ নিয়ে মিলুর সঙ্গে সরোয়ারের তুমুল মারামারি হয়। এ সংক্রান্ত মামলা তদন্তে গিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পিবিআই। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইর ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনার সূত্রপাত ৯ বছর আগে। ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল ছিনতাইকালে হাতেনাতে মিলু মৃধা নামে একজন গুলশান থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তখন মিলুর বয়স ছিল ৩৪ বছর। ছিনতাইয়ের ঘটনায় গুলশান মডেল থানায় সে দিনই ২৫ নম্বর মামলা দায়ের হয়। পুুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর মিলু নিজেকে সরোয়ার শেখ বলে পরিচয় দেয়। দায়েরকৃত মামলায় নিজের নাম ঠিকানা না দিয়ে খালাত ভাই সমবয়সী সরোয়ার শেখের নাম ঠিকানা দেয়। নাম বদলের কারণে মিলু মৃধা পুলিশ ও আদালতের কাছে হয়ে যায় সরোয়ার শেখ। পরে মিলু মৃধা জামিনে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে গেলে ওই মামলায় সরোয়ার শেখের ১০ বছরের কারাদ- দেয় আদালত, সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে। এসবের কিছুই জানত না সরোয়ার শেখ। অথচ তিনি গ্রামে কৃষি কাজ করতেন। গুলশান থানা পুলিশ আসামি সরোয়ার শেখ সম্পর্কে জানতে তার ঠিকানা মোতাবেক যাচাইবাছাই নোটিস পাঠায়। নোটিস মোতাবেক আসামির নাম সরোয়ার শেখ। সে সময় তার বয়স ছিল ৩৪ বছর। বাবার নাম ছাত্তার শেখ। বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী থানার গোপালপুর গ্রামে। সবই হুবহু মিল আছে। মধুখালী থানা পুলিশ ওয়ারেন্ট নিয়ে সরোয়ার শেখের বাড়ি গেলে পুলিশ দেখে রীতিমতো হতবাক সরোয়ারসহ বাড়ির সবাই, এমনকি পাড়াপ্রতিবেশীরাও। গত বছরের ১৫ অক্টোবর পুলিশ সরোয়ার শেখকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসে। ওদিনই তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। চার মাস জেল খেটে হাইকোর্ট থেকে এ বছরের ২ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান সরোয়ার শেখ। জামিনে বেরিয়ে সরোয়ার শেখ ১৫ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার দিকে মিলু মৃধার বাড়িতে যান। সেখানে মিলু মৃধা বাবা ভাইদের সঙ্গে এ ঘটনা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে মিলু মৃধা ও ভাইরা মিলে সরোয়ার শেখকে মারধর করে। পরে তাকে বিষয়টি মিটমাট করতে ঢাকার বাসায় যেতে বলে। ঢাকার ঠিকানা মোতাবেক সরোয়ার শেখ ৩০ জুন বাসায় যান। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে ঢাকার বাসার মিলু মৃধার সঙ্গে তাকে মামলার আসামি করে ফাঁসিয়ে দেয়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। আলোচনার এক পর্যায়ে মিলু মৃধা ও বাড়ির লোকজন সরোয়ার শেখকে বেধড়ক মারপিট করে। এরপর তাকে গুলশান নেপাল দূতাবাসের সামনে ফেলে রেখে যায়। এ ঘটনায় সরোয়ার শেখ মিলু, এক ভাই দেলোয়ার প্রকাশ দেলু ও তার তাদের বাবাকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণের পরিদর্শক নাসির উদ্দিন জানান, তদন্তে জানা গেছে মিলু মৃধার বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পলারম গ্রামে। এ মামলার তদন্তে কোন দোষ প্রমাণিত না হওয়ায় মিলু মৃধার বাবাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে গুলশান থানায় দায়ের ওই ছিনতাই মামলার বিষয় সম্পর্কেও খোঁজখবর নেয়া হয়। মামলার নথিপত্রে হাতেনাতে আটক ছিনতাইকারীদের ছবির ছিল। ছবি দেখেই মিলু মৃধাকে শনাক্ত করা হয়। পরে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের এনআইডি নম্বর দিয়েও তাকে সুনিশ্চিত করা হয়। সরোয়ার শেখের এনআইডি নম্বর দিয়েও তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় সরোয়ার শেখ মূলত অপরাধী নন। এছাড়া ফরিদপুরের মধুখালী থানার ৩নং নাওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল হাছান সরোয়ার শেখ সম্পর্কে একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। এতে বলা হয়, সরোয়ার শেখ একজন কৃষক। কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেন। সরোয়ার শেখকে গুলশান থানার ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এ ধরনের পরিকল্পিত অপরাধ কমিয়ে আনার বিষয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, কোন ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে বা অনুসন্ধানে ইস্যুকৃত ইনকোয়ারি স্লিপের সঙ্গে যদি থাকে তাহলে ওই ব্যক্তির ছবি যুক্ত করা জরুরী। পাশাপাশি পুরো নাম ঠিকানা বা নামের প্রকৃত বানানও মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন। ইনকোয়ারি স্লিপের সঙ্গে ছবি যুক্ত করা হলে হয়ত সরোয়ার শেখের মতো নিরাপদ লোককে আর চার মাস জেল খাটতে হতো না। আর আদালতেরও সরোয়ার শেখকে দশ বছরের সাজা ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার প্রয়োজন হতো না। তাতে আদালত ও তদন্ত সংস্থা এবং নিরাপদ লোককে ঝামেলা পোহাতে হতো না। এজন্য ইনকোয়ারি স্লিপের ফরম্যাটে বাদী বা আসামিদের তথ্যাদি যাচাইবাছাইর জন্য ছবি সংযুক্তি সুযোগ রাখা জরুরী।
×