ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মনিরুল ইসলাম

অস্কার শিন্ডলারের গাছটি

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ২২ নভেম্বর ২০১৯

অস্কার শিন্ডলারের গাছটি

পূর্ব প্রকাশের পর রাস্তার ওপারে একটা বার-কাম কফিশপে বসেছে ওরা। ইমানুয়েলের পূর্বপুরুষ পোলিশ ইহুদী, হলকাস্ট সম্পর্কিত কোন একটা বিষয়ে ওর গবেষণা। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আড্ডা যখন বেশ সাবলীল হয়ে ওঠে, পরাগ মূল প্রশ্নে আসে- - আচ্ছা ইমানুয়েল, পোল্যান্ডে আসার পর থেকেই একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরছে... (আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকায় ইমানুয়েল)... ২য় বিশ্বযুদ্ধে তো নাজিদের পরাজয় হল, তার পরও বেশির ভাগ ইহুদীকে ইউরোপ থেকে চলে যেতে হল কেন? ইমানুয়েলের মুখ দেখে মনে হল এই প্রশ্ন সে আশা করেনি। একটু ভেবে সে উত্তর দিতে থাকে... - এ বিষয়ে যা আসল সত্য সেটা ইহুদী হিসেবে আমি আমার পরিবার বা সম্প্রদায় থেকে পাইনি, অনেকটা বুঝেছি ইতিহাসের পাঠ থেকে, অনেকটা নিজের অনুভব থেকে... আমার মনে হয় হলকাস্ট যে সত্যটা ইহুদী দের সামনে তুলে ধরেছিল তা হচ্ছে... পোল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি কোনটাই তাদের দেশ নয়, হাজার বছর বসবাস করে হয়নি, আরও হাজার হাজার বছর থেকেও হবে না... হলকাস্ট, যুদ্ধের আবহে প্রকাশিত ঘৃণা নিষ্ঠুরতার একটি চরম পর্যায় কিন্তু ইউরোপে ইহুদীদের প্রতি ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতার বহমান ধারা কোন দিন থামেনি... পরাগ বলে ওঠে- - শিন্ডলার্স লিস্ট ছবিটা দেখে আমাদেরও তাই মনে হয়েছে... ইমানুয়েল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়, পরাগ ওকে ওই ছবির যুদ্ধ শেষের দৃশ্যে ইহুদীদের প্রশ্ন এবং রাশান সৈন্যের উত্তরের কথাটি বলে। বিষয়টি বুঝতে পেরে ইমানুয়েলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে- - তোমরা, লেখকেরা, অমাদের চেয়ে অনেক গভীরে দেখতে পাও।... স্পিলবার্গের ছবিটা আমি এত মনোযোগ দিয়ে দেখিনি ...এখন আমি বুঝতে পারছি... আমারও ধারণা যুদ্ধের পর যে প্রশ্নটি ইহুদীদের সবচে বেশি তাড়া করেছে তা হলো, তাদের আসল দেশ কোনটি ... (আবেগে কিছুটা আচ্ছন্ন হয় ইমানুয়েল, কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্বগোতক্তির মতো বলতে ধাকে) চিরকাল-ব্যাপী ২য় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকার এক হতাশাজনক অনুভবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ইউরোপীয় ইহুদীরা ......... পরিবেশ একটু ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে দেখে সমীর বলে ওঠে- - আমরা ইহুদীসহ সকল মানবগোষ্ঠীর ওপর আরোপিত বর্ণবাদী বা সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে... পরাগ যোগ করে- - আমরা ইহুদীদের উপর আরোপিত সকল বৈষম্যে ও নির্যাতনের অবসান চাই, কিন্তু আমরা সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, সে কারণে জিওনিজমেরও বিরুদ্ধে... চমকে ওঠার মত মাথা ওঠায় ইমানুয়েল, তার পর মুচকি হাসি হেসে পরাগের দিকে তাকায়- - ডিয়ার ফ্রেন্ডস, এ বিষয়টা তোমাদেরকে আমি বোঝাতে পারবো কিনা জানি না, ...অন্য জাতিকে দমন করার উদ্দেশ্য নিয়ে জিওনিজমের জন্ম হয়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঠিকানাবিহীন এবং নির্যাতিত একটি জনগোষ্ঠীর হতাশা আর অসহায়ত্ব থেকে জিওনিজমের জন্ম। জিওনিজম এক সময় ইহুদীদের আশা প্রত্যাশার অবলম্বনে পরিণত হয়। (কিছুক্ষণ চুপ থেকে)... এত দিন ইহুদিদের ‘নিজ ভূমিতে’ ফেরার ব্যাপারটা কেবল ধর্মগ্রন্থ ও প্রার্থনার মধ্যে ছিল, জিওনিজম তাকে মাটিতে নামিয়ে আনে... বর্তমান সময়ের একটি বাস্তব বিষয়ে পরিণত করে... - যদি কিছু মনে না কর তোমাকে একটা প্রশ্ন করি... (ইমানুয়েলের দিকে তাকিয়ে সমীর জানতে চায়, ইমানুয়েলও ওর দিকে তাকায়)... তুমি কি জিওনিস্ট? - বাহ্যিকভাবে আমি জিওনিস্ট এ্যাক্টিভিস্ট নই, তবে...আমি ঠিক নিশ্চিত নই, এখনও যখন জাতিগত বৈষম্য আর ঘৃণার শিকার হয়ে আমি যখন অসহায় বোধ করি... সত্যি বলতে কি... আমি হয়তো তখন জিওনিজমের উপরই আশ্রয় করতে চাই... অনেক ক্ষণ থেকে একটা প্রশ্ন করতে সোহেল মনে মনে ইংরেজীটা গুছিয়ে নিচ্ছিল- ‘জিওনিস্টরা কি অন্য জাতিকে দমন করছে না?’ কিন্তু প্রশ্নটা করার আগেই ইমানুয়েল উঠে দাঁড়ায়- - সরি ফ্রেন্ডস, আমাকে এখন উঠতে হচ্ছে, একটা খুব সুন্দর সন্ধ্যা কাটালাম তোমাদের সঙ্গে, গুডবাই...। আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ক্যাফে থেকে হন হন করে বেরিয়ে যায় ইমানুয়েল সালোভ। (৭) ২০১৪ সালের ১০ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকালে হঠাৎ অরিন্দমের ফোন পায় সমীর। প্রায় তিন সপ্তাহ হলো ইউরোপ থেকে ফিরে এসেছে ওরা, এর মধ্যে আর দেখা হয়নি। পোল্যান্ডের স্মৃতিও ফিকে হয়ে এসেছে কিছুটা। - দাদা বাসায় আছেন? শুনলাম আজকে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হইছেন? - এই খবরও পেয়ে গেছ... - ইনফরমার আছে না... অরিন্দমের বন্ধু প্রতীক সমীরের সহকর্মী। - কোথায় তুমি, আসবা নাকি, আমি বাসায়... - কাছাকাছি আছি, আসতেছি, আমার ক্যামেরার ছবিগুলো দিতে পারবো... কোন কাজ না থাকলে অরিন্দম নিজে উদ্যোগী হয়ে কখনও আসে না। আজকেও নিশ্চয় কোন কাজেই আসছে। শুধু ছবি দেওয়াই সে কাজ বলে মনে হচ্ছে না সমীরের। বাসায় ঢুকে অরিন্দম ল্যাপটপ বের করে। - পেন ড্রাইভে অনতে ভুলে গেছি, অসুবিধা নাই ল্যাপটপ থেকে দিয়ে দেব। - ভাল হইছে আগে ছবিগুলো দেখি ল্যপটপ অন করতে দিয়ে অরিন্দম ফ্রেশ হতে যায়, অরিন্দমের ডেস্কটপে পোলিশ শিল্পীর সেই ভাস্কর্যের ছবি, ছবিটাতে চোখ আটকে যায় সমীরের - আতঙ্কে ধাবমান মানুষের সারীর পেছনে প্রতীকী হেলমেট, বেয়োনেট...পোলিশ শিল্পীর এই অসাধারণ শিল্পকর্মের সার্বজনীনতা টের পায় সমীর... ৭১ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসের বৃষ্টি ভেজা সেই দিনটি ভেসে ওঠে চোখের সামনে...মাস খানেক আগে ঢাকা থেকে গ্রামে চলে এসেছে ওরা...এখানেও বেশ কিছুদিন থেকেই আতঙ্কে ছিল সবাই, মিলিটারি আসছে কিছু একটা হবে, কিন্তু সেদিন চাচকৈড় বাজারে চারজন হিন্দুকে মিলিটরিরা গুলি করে মারার পর দ্রুত অতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গুরুদাসপুরের হিন্দু পাড়ায়... ঘোর বৃষ্টির মধ্যে নন্দগুজা নদীর প্রবল ¯্রােত উপেক্ষা করে শত শত লোক পার হচ্ছে, তার পর জল, কাঁদা, বৃষ্টি উপেক্ষা করে গ্রামের পর গ্রাম পারি দিয়ে পশ্চিমে সীমান্তমুখী যাত্রা... ওদের তাড়া করছে মিলিটারি, বন্দুক, বেয়োনেট- মৃত্যুর আতঙ্ক ... অরিন্দমের কথায় বাস্তবে ফেরে সমীর- - দাদা, আমি কিন্তু আসলে ছবি দিতে আপনার কাছে আসি নাই.... - তা আমি জানি, কোন বিশেষ কাজ না থাকলে তো তোমার টিকি দেখা যায় না... - খবর শুনছেন তো? - কি খবর ? - তিন চারদিন ধরে ইসরাইল গাজায় আক্রমণ করছে... ছোট বাচ্চাসহ বহু প্যালেস্টাইনিকে মেরে ফেলছে... - শুনছি, দেখলামও খবরে, এগুলা তো নতুন না... ১৯৬০ এর দশক থিকা ওরা বহুবার এরকম করছে... - যে ইহুদীরা এতদিন বর্ণবাদের শিকার হলো, তারা বর্ণবাদী অক্রমণকে ঘৃণা করবে না?... চাকমা ছেলেটার সরলতা দেখে মুগ্ধ হয় সমীর- ওর পিঠে হাত রাখে- - ডিয়ার ব্রাদার, পৃথিবীর ইতিহাস কি কয় জান? (অরিন্দম সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়)... বর্ণবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার ভিক্টিম যারা হয় তাগো বেশিরভাগই বর্ণবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী না হইয়া অরো বেশি বর্ণবাদী বা সাম্প্রদায়িক হয়। আর ক্ষমতা পাইলে তো কথাই নাই, নিজেরাই অত্যাচারে নাইমা যায়।...আমাগো দেশ থিকা সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের শিকার হইয়া যারা ইন্ডিয়ায় যায়, তারা সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে না মুসলমানগো ঘৃণা করে... অনেকরে দেখছি ওই দেশে গিয়া বেশি সাম্প্রদায়িক হইতে... - দাদা, ইসরাইলের ইহুদীদের মধ্যে কি সত্যিকারের বর্ণবাদ-বিরোধী কোন লোক নাই, যারা এই বর্ণবাদী হামলার প্রতিবাদ করতে পারে... - এমন কারও কথা আমি শুনি নাই... - তাহলে শিন্ডলার যে গাছটি লাগালো... সেই গাছটার কি অবস্থা... সিনেমার শেষ দিকে যে বলল গাছটা বেড়ে উঠতেছে... - ওই সম্প্রীতি বৃক্ষ (সমীর হেসে ওঠে), হ্যাঁ ওইটা যদি বর্ণবাদ-বিরোধী গাছ হয়, আর ইসরাইলে যদি বর্ণবাদ-বিরোধী কেউ না থাকে...তাহলে প্রতীকী অর্থে বলতে হয় গাছটির প্রাণ তো... আর নাই। সেদিন অরিন্দম চলে যাবার পরও বিষয়টা কয়েক দিন ঘুরপাক খাচ্ছিল সমীরের মনে। বিশেষ করে এ ব্যাপারে অরিন্দমের সিরিয়াসনেস ওকেও স্পর্শ করেছে। সোমবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে অরিন্দমের ফোন আসে, গলায় কিছুটা উত্তেজনা - - দাদা বাসায় আছেন- - হ্যাঁ বাসায়ই, ডিনারের প্রস্তুতি নিতেছি, কি ব্যাপার এনিথিং সিরিয়াস... - না না...তাড়াতাড়ি টিভিটা খুলে বিবিসিতে দেন... বিবিসির নিউজে গাজায় আক্রমণের খবরের পর ছোট একটা ক্লিপ দেখাচ্ছে- জেরুসালেমে ইহুদীরা, গাজায় আক্রমণ এবং বর্ণবাদী রাজনীতির বিরোধিতা করতে রাস্তায় নেমে প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করছে...সংখ্যায় এরা খুব বেশি না কিন্তু তাও ঘটনাটা চমকে ওঠার মতই... - অরিন্দম লাইনে আছ? - হ্যাঁ দাদা, দেখছেন, ইসরাইলে ইহুদীরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইছে...দাদা... - হ্যাঁ, বল.. - দাদা, শিন্ডলারের গাছটা মরে নাই... সমীর টের পায় অরিন্দমের গলার স্বরে যে আবেগ তা বর্ণবাদ-বিরোধী বৈষম্যহীন সমাজের জন্য আকাক্সক্ষার আবেগ। মানুষের বন্ধন মুক্তির আকাক্সক্ষার প্রবল বাতাসে জেরুসালেমের ইয়াদ ভাসেম চত্বরে অস্কার শিন্ডলারের লাগানো গাছটির পাতাগুলো ওদের চোখের সামনে দুলতে থাকে। (শেষ)
×