ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শেখ আব্দুল আওয়াল

লড়াকু আত্মবিশ্বাসী ‘নাজমা’

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ২২ নভেম্বর ২০১৯

লড়াকু আত্মবিশ্বাসী ‘নাজমা’

বাঙালী নারীরা ধৈর্য, সাহস, পরিশ্রম ও শক্তির প্রতীক। তাই তো প্রতিটি সফলতার গল্পের থাকেন একজন নারী জীবনযুদ্ধে স্রোতের প্রতিকূলে চলার কঠিনতম লড়াই করার নামেই জয়তু, জয়ী, জয়িতা। একজন নারীর অনুপ্রেরণামূলক সাফল্য গাথা আরও অনেক নারীকেই অনুপ্রাণিত করে। হাজারো নারীর মনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে উঁকি দেয়া স্বপ্নগুলো পাখা মেলবে আকাশে- তৈরি হবে লাখো জয়িতা। লাখো জয়িতাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, এক সুন্দর সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যতের দিকে। একজন সংগ্রামী অপ্রতিরুদ্ধ নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা- মহিলা অধিদফতরের মধ্যে ‘জয়িতারা বাংলাদেশের বাতিঘর’ সত্যিই তাই! একেকজন জয়িতার সফলতার গল্পগুলো আলাদা হলেও তাদের অপ্রতিরুদ্ধ, সংগ্রাম, অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর হার না মানা সাহসিকতার মূল সুর যেন একই সুতায় গাঁথা। তেমনি একজন জয়িতা গফরগাঁওয়ের নাজমা। গ্রামীণ কুসংস্কার আর প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা গফরগাঁও অফিস থেকে পার্লার, সেলাই মেশিন, বাটিকসহ কয়েকটি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে গফরগাঁওয়ের জয়িতা পুরস্কার পেলেন পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাজমা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩য় শ্রেণীর সরকারী কর্মচারী মোঃ শহীদুল্লাহর ২ মেয়ের মধ্যে নাজমা বড় মেয়ে। যৌথ পরিবারে সংসারে চলা দুরূহ ব্যাপার। তবুও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেশায় অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে পথ চলতে থাকে। নাজমা বলেন, আমি যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়ি স্কুলে বেতনের টাকা দিতে পারিনি। সাহায্য চাওয়া বা নেয়ার মতো কেউ ছিল না। ভাল ছাত্রী হওয়ার সুবাদে শিক্ষকরা আমার লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। কখনও খেয়ে কখনও না খেয়ে আবার কখনও ভাতের ফ্যানের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে দিত মা। এসব দিনে হয়ত আমার ভবিষ্যত জীবনের একেকটা অস্ত্র যা কাজে লাগিয়ে জীবনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। একটি গানের প্রতিষ্ঠানে ঝঙ্কার শিল্পী গোষ্ঠীর ভাল শিল্পী হয়ে কাজ করেছি। আমার গানের শিক্ষক প্রদ্বীপ প-িত স্যার ও সুসেন স্যার আমাকে ছোট বেলা থেকেই অভাবের সংসার বলে উৎসাহ দিতেন। ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থার দর্জির কাজ শুরু করি। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই টাকার অভাবে দর্জির কাজও বন্ধ হয়ে যায়। যতটুকু ধারণা নিয়ে ছিলাম দর্জির কাজ করে উপবৃত্তির টাকা পেয়ে কাপড় কিনে হাতে সুই-সুতার সেলাই করে এলাকায় বিক্রি করতাম। তখনও অভাবের কারণে একটি সেলাই মেশিন কেনার সাধ্য ছিল না। অল্প বয়সে জীবনে নেমে এলো অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার বাবা আমাকে বিয়ে দিলেন অভিভাবকহীন এক ছেলের কাছে। স্বামীর সংসারে ৬ জনের ঘানি টেনে এসএসসি পাস করলাম কলেজে ভর্তি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলাম। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। সংসারের অভাব-অনটন না মিটাতে পেরে মাঝে মধ্যে খাবার না যোগাড় করতে পেরে ভাতের ফ্যান খেয়ে উপবৃত্তির জমানো টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনলাম। আমি বউ হওয়াতে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার এসব কাজ ভাল চোখে নেয়নি। অভাবের সংসারে টানাটানিতে বাধ্য হয়ে ময়মনসিংহ শহরে পাড়ি জমালাম, এইচএসসি পাস করে অনার্সের ভর্তির পাশাপাশি সেলাই মেশিনে কাজ শুরু করলাম। নাজমা বলেন, করা ভাল ডিজাইন ও কাজ থেকে এলাকার মানুষের সারা পেলাম। ২য় কন্যা সন্তানের জন্ম ও সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে থাকি। যুব উন্নয়ন ময়মনসিংহ মহিলা বিষয়ক অধিদফতর ও ওয়ার্ল্ড ভিশন থেকে ব্লক, বাটিক, ক্যাটারিং, ক্রিস্টাল, পুঁথি, পাথরের কাজের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। সংসারের অভাবও আস্তে আস্তে ঘোচাতে থাকে। মাঝে মধ্যে কথা শুনতে হতো শ্বশুরবাড়ি বা আশপাশের লোকদের। তবে আমার স্বামী এ ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছে। অনার্স শেষ করে চাকরির জন্য অনেক দৌড়ালাম। মামা, চাচা, টাকা কোনটাই না থাকায় ভাগ্যে চাকরি জুটল না। হঠাৎ একদিন গফরগাঁও মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা খালেদা আক্তারের পরামর্শে হাতের কাজের ওপর ভরসা করে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে শুরু করলাম। আমি তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের মা। আমার স্বামী আমার জীবনের সেরা অনুপ্রেরণা ও শ্রেষ্ঠ বন্ধু। নাজমা আক্তার আরও বলেন, খালেদা ম্যাডামের সহায়তায় বিউটিফিকেশন ট্রেডে ৩ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার অফিস থেকে ২০ হাজার টাকা লোন নিয়ে খালেদা ম্যাডামের পরামর্শে উনার সহায়তায় বিউটি পার্লার, ব্লক, বাটিক, ক্রিস্টাল পাথর দিয়ে ডিজাইন করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রচ- ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যবসায় করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ২০১৮ সালে অথনীতি স্বাবলম্বীকারী নারী হিসেবে জয়িতা পদক দেন গফরগাঁও উপজেলা প্রশাসন। বর্তমানে নিজ উদ্যোগে একটি বাটিক হাউস ট্রেনিং সেন্টার ও সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। যার পুরো নাম সারাবেলা বটিকস হাউস এ্যান্ড বিউটি পার্লার এন্ড ট্রেনিং সেন্টার। এই প্রতিষ্ঠান থেকে স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা, অসহায়, দরিদ্র পরিবারের প্রায় ২ শতাধিক নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করছি। তবে সরকারের কাছে আকুল আবেদন আমাকে সহায়তা করলে আমিও হতে পারি বড় উদ্যোক্তা। গফরগাঁও উপজেলাবিষয়ক কর্মকর্তা খালেদা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, নাজমা শিক্ষিত, সাহসী, বিনয়ী এবং প্ররিশ্রমী নারী। কঠোর অধ্যবসায় আজ তাকে সামান্য হলেও সফলতার মুখ দেখিয়েছে। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মাহবুবউর রহমান বলেন, গফরগাঁওয়ে এ রকম আত্মনির্ভরশীল নারী আছে আমার জানা ছিল না। নাজমা এখন অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করছে। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে স্বাবলম্বী হয়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি নিচ্ছে।
×