ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী চিকিৎসক ডাঃ জোহরা কাজী

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২২ নভেম্বর ২০১৯

উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী চিকিৎসক ডাঃ জোহরা কাজী

আজ অধ্যাপক ডাঃ জোহরা বেগম কাজীর ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে প্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রামে। ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনের পুরো সময়টাতে মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’- এ মানবতাবাদী পিতা ডাঃ কাজী আব্দুস সাত্তারের কর্মস্থলে তাঁর শৈশব-কৈশোর কাটে। ডাঃ কাজী আবদুস সাত্তার ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী একজন আধুনিক মানুষ। মা আঞ্জুমান নিসা ছিলেন খুব সাদাসিধে কর্মিষ্ঠ এক নারী। তিনি রায়পুর পৌরসভার প্রথম মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। ডাঃ জোহরা বেগম কাজীর মেধা-মননে ধীরে ধীরে রূপ পেতে থাকে ভবিষ্যতের আধুনিক চিন্তা-চেতনাসমৃদ্ধ কর্মিষ্ঠ এক চিকিৎসাবিজ্ঞানী। রাজনানগাঁওয়ের রানি সূর্যমুখী প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের টোল ‘পুত্রিশালায়’ ডাঃ জোহরায় হাতেখড়ি হয়। পড়ালেখায় ছিলেন খুব তুখোড়। ক্লাসে সব সময় প্রথম হতেন। ১৯২৯ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে কলেজের পড়া শেষ করেন। দিল্লীর লেডি হার্ডিং মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন থেকে প্রথম বাঙালী মুসলিম ছাত্রী হিসেবে ১৯৩৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমবিবিএস পাস করেন। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের মহাত্মা গান্ধীর প্রত্যক্ষ ¯েœহচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠেন জোহরা বেগম কাজীর চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে কর্মজীবনের সূত্রপাত হয় গান্ধী সেবাশ্রমে। ’৪৭ পরবর্তী সময়কাল মানবকল্যাণমূলক সমাজ গঠন-প্রক্রিয়ার একটা উল্লেখযোগ্য সময়। এই কালপর্বটিকে বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান শাস্ত্রের গঠনপর্ব বললে অত্যুক্তি হবে না। ভবিষ্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপরেখা নির্মাণের সেই অসাধারণ কাল পর্বে চিকিৎসাশাস্ত্রে বাঙালী নারী চিকিৎসকদের অগ্রপথিক মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক যেসব নারীর নাম সর্বাগ্রে সবার মানসপটে ভেসে ওঠে, তাদের মধ্যে জোহরা বেগম কাজী একজন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করেই স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগটি গড়ে তোলেন। গর্ভবতী মায়েরা যাতে হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন, সে জন্য ঢাকা মেডিকেল; কলেজ হাসপাতলে তিনিই প্রথম নারীদের পৃথকভাবে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে তিনি গাইনোকলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন। পশ্চাৎপদ নারী সমাজের জাগরণে বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেন জোহরা বেগম কাজী। আজ ডাঃ কাজী প্রদর্শিত আদর্শের পথে অগ্রসর হয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসংখ্য নারী তাঁদের অসাধারণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। জীবনের প্রাথমিক কালপর্ব থেকে শুরু করে সময়ের ধারাপাত কর্মমুখর জীবনে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর পতœী কস্তারাবা অশেষ ¯েœহধন্য জোহরা কাজী পরবর্তী কালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কবি নজরুল ইসলাম, কমরেড মুজাফফর আহমদ, ডাঃ কাজীর অগ্রজ অধ্যাপক কাজী আশরাফ মাহমুদ, অনুজা ডা. শিরিন কাজী, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী কগ্রেসের অন্যতম কর্মী ডাঃ সুশীলা নায়ার প্রমুখ মানবতাবাদী সংগ্রামী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় প্রমাণ করে যে তিনি শুধু একজন চিকিৎসকই ছিলেন না, মাতৃভূমি মাতৃভাষার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধে সেই আগুনঝরা দিনগুলোর সক্রিয় আন্দোলনকারীদের একজন হিসেবেই নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। একজন ইতিহাস সচেতনে স্মৃতি-স্মারক হিসেবে রক্ষা করেছিলেন। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিনির্মাণে এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল। বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অসংখ্য পদকে ভূষিত করে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য রোকেয়া পদক, বিএমএ স্বর্ণপদক, ২০০৮ সালে সরকার জোহরা কাজীর আজীবন সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক একুশে পদক (মরণোত্তর, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৮) প্রদান সম্মানিত করে। ২০০৭ সালের ৭ নবেম্বর ৯৫ বছর বয়সে এই মহাপ্রাণ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
×