ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জগৎজ্যোতি দাস ॥ ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ

প্রকাশিত: ০৮:২২, ১৮ নভেম্বর ২০১৯

  জগৎজ্যোতি দাস ॥ ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ

॥ এক ॥ মাত্র ১৬ নবেম্বর পার করলাম। ৮ ডিসেম্বর মুজিববর্ষের ক্ষণ গণনা, ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস পালন করার পর বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৯তম জন্মদিন ১৬ ডিসেম্বর আমাদের সামনে। বরাবরের মতোই বাঙালী তার এই বিজয়ের দিনটিকে অনন্য সাধারণ করে তোলার সকল আয়োজন সম্পন্ন করবে। এর মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করব। বিজয় অর্জন করার মাত্র দুদিন আগে আলবদর, রাজাকাররা আমাদের দেশের মেধাবীদেরকে যেভাবে হত্যা করেছিল তা আমরা এমনভাবে পালন করব যাতে মনে হবে যে; এরই মাঝে আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছি। তবে বিজয় অর্জনের এত বছর পরেও আমরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমরা সকল শহীদকে সেই সম্মান দিতে পেরেছি যা আমাদের দেয়া উচিত ছিল। শহীদদের তালিকায় বুদ্ধিজীবীরাই থাকুক বা মুক্তিযোদ্ধারাই থাকুক কিংবা অতিসাধারণ মানুষ যারা গণহত্যার শিকার হয়েছিল তারাই থাকুক; তাদের প্রতি কি আমরা সেই সম্মান দিতে পারছি যা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। দুঃখজনকভাবে এটিও সত্য যে- আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদের এই শহীদদেরকে চেনে কিনা, জানে কিনা আমরা জানি না। এমনকি আমরা তাদেরকে সেই শহীদদের কথা সঠিকভাবে বলেছি কিনা, সেটাও জানি না। মাত্র দু’বছর আগে, ৯ নবেম্বর ’১৭ আমার প্রিয় মানুষদের একজন বাসদ নেতা আফম মাহবুবুল হক চলে গেলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এই মানুষটিকে দেশে আনা হলো না। আমার জানা মতে তাকে মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্রও দেয়া হয়নি। মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষক এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কানাডার মাটিতে শুয়ে থাকতে হলো। এর ফলে তার সহযোদ্ধারা বা দেশের মানুষ, এমনকি তার কবরও জিয়ারত করতে পারল না। আমি তাকে সেই ’৬৮ সাল থেকে দেখে এটা নিশ্চিত জানি যে, এই দেশের কোন সুযোগ- সুবিধা তিনি কোনদিন কোন আকারে গ্রহণ করেননি। দেশ তাকে কোন প্রতিদান না দিক অন্তত সম্মানটা তো তার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সেটি আমরা দিতে পারিনি। ’৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহম্মদ আলী জিন্নাহ হলে প্রবেশ করার পর থেকে যতদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন ততদিনই একেবারে বড় ভাই বা অভিভাবকের মতো মাথার উপরে ছিলেন। সেই মানুষটি অপঘাতে প্রাণ হারালেন। তার বিচারও হলো না। সেই কষ্টটা এখনও সামলাতে পারছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মাহবুব ভাইয়ের কাছে এত ঋণী যে, এই অপারগতার দায় থেকে নিজেকে কোনভাবেই মুক্ত করতে পারছি না। আমার নিজের কষ্ট লাগে যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় দেশ ভরে যায় আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ খবর রাখে না। এটি নিশ্চিত যে, কোন মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও ভাতার জন্য যুদ্ধ করেনি। কিন্তু রাষ্ট্রের দায় হচ্ছে তাকে স্বীকৃতি প্রদান করা। অথচ রাষ্ট্র আমার মতো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে স্বীকৃতিই দেয়নি। আরও অনেক দায় থেকে এখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না। এক বছর আগে ’১৬ সালের ১৬ নবেম্বর চলে গেলো মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু শেখ আব্দুল কাইযূম। ওর জন্যও কিছুই করতে পারিনি। যতবার ওর মেয়ে ফারজানার সঙ্গে ওর ছবি দেখি ততবারই মনে হয়- আমরা বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের জন্য এমন কিছু করতে পারিনি যা আমাদের করা উচিত। মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু আফতাব আহমদকে গুলি করে হত্যা করা হলো। তারও কোন বিচার হয়নি। এদের কারও কারও সঙ্গে আমি রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মত পোষণ করি। আফতাব তো এক সময়ে আমাদের ভাবনার বিপরীত রাজনীতি করেছে। মাহবুব ভাই বিপরীত রাজনীতি করেননি-তবে তার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না। কোনভাবেই কোন মুক্তিযোদ্ধার অপঘাতে মৃত্যু আমি বিচারহীনভাবে পার করাটা সমর্থন করি না। আমার নিজের কাছে এটিকে একটি দায় বলে মনে হয়। আরও একটি দায় নিজের কাঁধে আছে। একাত্তর সালের ১৬ নবেম্বর শহীদ হন জগৎজ্যোতি দাস। হাওর অঞ্চলের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসের নাম জাতীয় স্তরের মানুষজন জানেন বলে আমার মনে হয় না। ১৬ নবেম্বর তো দূরের কথা; অন্য কোন দিনও তার নাম কাউকে উচ্চারণ করতে শুনি না। জগৎজ্যোতি যে লড়াইতে শহীদ হন, হাওরে তার মতো বড় যুদ্ধও আর হয়নি। তিনি যেভাবে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন তাতে আমরা তাকে কেন যে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিইনি, তাও আমি জানি না। ইতিহাস আমাদেরকে সেজন্য ক্ষমা করবে না। উল্লেখিত সকল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়েই আমি কিছু কথা লিখতে পারি। সময় পেলেই ওদেরকে নিয়ে আমি লিখবও। আপাতত জগৎজ্যোতির ইতিহাসটা পড়ুন। মাহবুব ভাই, আফতাব আর কাইযূমের সঙ্গে আমার যতটা গাঢ় সম্পর্ক ছিল, জগৎজ্যোতির সঙ্গে তেমনটা ছিল না। তিনি আমার চাইতে এক শ্রেণী উপরে একই স্কুলে পড়তেন। আমার চাচাত ভাই আব্দুল হান্নান ও দুই ভাগিনা-আবিদ ও হেলিম তার সহপাঠী ছিল। আবিদ আজ আর নেই। তবে সে জগৎজ্যোতির গ্রামের বাড়ি জলসুখাতেই লজিং থাকত। ওরা একসঙ্গে স্কুলে আসত। শুকনো মওসুমে একসঙ্গে হেঁটে আসত তারা। বর্ষায় আসত এক নৌকায়। দারুণ বন্ধুত্ব ছিল ওদের। ওরা ’৬০ সাল থেকে ’৬৫ সাল অবধি পাঁচ বছর একসঙ্গে পড়েছেন। আমরা তাদেরকে ’৬১ থেকে ’৬৫ এই চার বছর দেখেছি। আমরা স্কুল ছাড়ার আগের বছর তারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্কুল ছাড়েন। তবে এরপর আমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ ছিল না। অন্যদিকে আমার সঙ্গে জগৎজ্যোতির সম্পর্কটা স্কুলেই সীমিত থাকেনি। বরং আরও গাঢ় হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধের জন্য। তিনি একাত্তর সালে যে যুদ্ধে শহীদ হন আমি সেই এলাকারই বাসিন্দা। আরও একটি বড় বিষয় হচ্ছে: আমি বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে জগৎজ্যোতির খুনী ও পলাতক রাজাকারদেরকে আমার গ্রামের বাড়িতে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলাম, যাদেরকে শাল্লার মুক্তিযোদ্ধারা পরে হত্যা করে। আমি সেই ইতিহাসটি লিখব। জগৎজ্যোতি আমার গ্রামে বা তার পাশের গ্রাম কল্যাণপুরে সাধারণ মানুষের ভরসার কেন্দ্র হিসেবে আসা-যাওয়া করতেন। আমাদের গ্রামের বাজার কৃষ্ণপুর ছিল তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পের মতো। যদিও আমি তখন ভারতে তবু পরে জেনেছি যে শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামটিকে তাদের নানা কাজে ব্যবহার করত। আমাদের বাজারটি তাদের রসদ যোগাত। আমার চাচাত ভাই ডাঃ নিয়াজ মুহম্মদ তাদের সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন আর বাবা আব্দুল জব্বার তালুকদার তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। হাসান মুর্শেদ নামক একজন জগৎজ্যোতির ওপর একটি বই লিখেছেন; যার অংশবিশেষ একটি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে হাসান মুর্শেদের কাছ থেকে জগৎজ্যোতির যুদ্ধের ইতিহাসটি নিচ্ছি। আসুন একটু যুদ্ধের শুরুর বিবরণটি পাঠ করি- ‘সেদিন জগৎজ্যোতির দলটা ছিল ৪২ জনের। খালিয়াজুড়ির কল্যাণপুর (আমার পাশের গ্রাম) থেকে কয়েকটা নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটার মূল অপারেশন ছিল আজমিরীগঞ্জ পেরিয়ে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুত সঞ্চালন লাইন উড়িয়ে দেয়া। যাবার পথে মুক্তিযোদ্ধা সুবল দাসের দলকে সাহায্য করার জন্য ঘুঙ্গিয়ারগাঁও, শাল্লায় পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে জ্যোতির দল। সেখান থেকে ভোরে রওনা হয়ে সকাল নয়টায় ইউনিয়ন অফিসের সামনে হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে রাজাকারদের নৌকা। তেলাপোকাগুলো নিরীহ জেলেদের নৌকা আটকে লুটপাট করছে। এক জেলে ইলিয়াসকে চিনতে পেরে আকুল স্বরে অনুনয় করল- ও দাসবাবুর ভাই, আপনারা আমাদের বাঁচান।’ তৎক্ষণাৎ আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার মারা যায় সেখানেই। বাকিরা দুই নৌকায় ইঁদুরের বাচ্চার মতো পালাতে থাকে। জ্যোতি বাকিদের অপেক্ষা করতে বলে বারোজন সঙ্গে নিয়ে তাড়া করেন সেই পলায়নপর তেলাপোকাগুলোকে। অন্যরা তার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। জগৎজ্যোতি ধমক দিয়ে বলেছে, কয়টা রাজাকার ধরতে সবার আসার কি দরকার? নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে শুকনো বিল পেরিয়ে তেলাপোকাগুলো পালিয়ে যায় জলসুখার দিকে। জলসুখা জ্যোতির গ্রাম। নাড়িপোঁতা ঠিকানা। কিন্তু জ্যোতি তখন অপারেশনে। তাই কাছে এসেও ফিরে যান। যাবার সময় মর্টারের রেঞ্জের কাছাকাছি এক রাজাকারের বাড়িতে মর্টার শেলিং করে ওরা। ফেরার সময় হঠাৎই পাল্টে যায় সবকিছু। হঠাৎ চায়নিজ রাইফেলের গুলির আওয়াজ ভেসে আসে অনতিদূর থেকে। চায়নিজ রাইফেল পাকিস্তানীদের অস্ত্র; রাজাকারদের কাছে চায়নিজ রাইফেল থাকার কথা নয়। ওদের দৌড় বন্দুক পর্যন্তই। বিলের কাছে আসার পর ওরা দেখে, একদিকে আজমিরীগঞ্জ, অন্যদিকে শাল্লা ও মার্কুলির দিক থেকে গানবোটে পাকিস্তানী আর্মিরা এসে নদীরপারে পজিশন নিচ্ছে। ঠিক উল্টোদিকের বদলপুরেও গুলির আওয়াজ। রাজাকারগুলো ছিল আসলে ঘুঁটি। ওদের টোপ হিসেব কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে পাকিস্তানীদের ত্রাস দাস পার্টিকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তান আর্মি। সুপ্রশিক্ষিত-হিংস্র পাকি হায়েনাগুলো এতদিন রোম ওঠা নেড়ি কুকুরের মতো সকাল-বিকাল মার খেয়েছে দাস পার্টির দুর্ধর্ষ গেরিলাদের হাতে। আজ তারা আটঘাট বেঁধেই এসেছে। দুদিক থেকেই পাকিস্তান আর্মি পজিশন নেয় নদীরপার জুড়ে আর জ্যোতির দলের ১২ জন পজিশন নেয় নদী আর শুকনো বিলের মাঝে। দূরত্বটা এতই কাছে যে,পাকি জওয়ানদের পজিশন নেয়ার জন্য অফিসারদের দেয়া উর্দু কমান্ডও শুনতে পাচ্ছিলেন জগৎজ্যোতিরা। জ্যোতি আর তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ইলিয়াস সামনের কলামে; দুজনের হাতেই মেশিনগান আর দু’ইঞ্চি মর্টার- এর পরের সারিতে মতিউর, রশিদ, আইয়ুব আলী, বিনোদ বিহারী বৈষ্ণব, ধন মিয়া, কাজল, সুনীল, নীলু, কাইয়ূম ও আতাউর। বিপরীতে অগুনতি পাকিস্তানী সেনা। যুদ্ধ শুরু হলো সামনাসামনি। মাত্র ১২ যোদ্ধা নিয়ে নিতান্তই এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত। জগৎজ্যোতির কণ্ঠ চিরে হঠাৎ বেরোয় এক অদ্ভুত উৎসাহের কথা ‘চল, আজ শালাদের জ্যান্ত ধরব, একেবারে হাতেনাতে’। মৃত্যুভয়কে তুড়ি মেরে অকুতোভয় দুঃসাহসে যুদ্ধ করে যাওয়া ছোট্ট দলটায় তবুও ছোবল দিতে আপ্রাণ চেষ্টায় মাতে মৃত্যু। আইয়ুব আলীর মাথায় গুলি লাগে। তাকে দুজনের জিম্মায় দিয়ে পিছিয়ে বদলপুরের দিকে পাঠিয়ে দেন জ্যোতি। ভয়ঙ্কর একপেশে সে যুদ্ধে একটু পর আহত হন আরেক মুক্তিযোদ্ধা। মাথার ওপর চক্কর দিতে থাকে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ফগার, শিকারী হাউন্ডের মতো। ওদিকে বদলপুরে থাকা মূল দলের বাকি ৩০ জনকে আটকে রাখে পাকিস্তানীদের আরেকটি দল। কোন সাহায্য পৌঁছায় না জ্যোতির দলের কাছে। দলের মাথাটা বাগে পেয়েছে আজ পাকিস্তানীরা। কেটে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় তারা। ক্রমশ কঠিন হয়ে যাওয়া যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন, ‘দাদা, কি করব?’ নির্মোহ গলায় জ্যোতির শান্ত জবাব, ‘তোর যা খুশি কর।’ কমান্ডার যেন বুঝতে পেরেছিলেন এটাই তার শেষ যুদ্ধ। শেষ যুদ্ধ পরিচালনার ভার তাই প্রিয় সহযোদ্ধার কাঁধে দিয়ে জ্যোতি মন দেন নিখুঁত নিশানার দিকে। ফুরিয়ে আসতে থাকে গুলি। ইলিয়াস বিনোদ বিহারীসহ আরও দু-তিনজনকে পাঠান বদলপুর থেকে যেভাবেই হোক গুলিসহ রসদ আনার জন্য। বিকেল সাড়ে তিনটায় হুট করে গুলি লাগে ইলিয়াসের বুকের বাম পাশে। হাত দিয়ে দেখেন- কি আশ্চর্য, হৃৎপি- ভেদ না করেই গুলি বেরিয়ে গেছে যেন কিভাবে। মাথার গামছা খুলে বুকের ক্ষতস্থান বেঁধে দিতে দিতে জ্যোতি জিজ্ঞেস করেন, ‘বাঁচবি?’ বুকে বুলেটের ক্ষত নিয়ে আহত ইলিয়াস জবাব দেন, ‘মনে হয় বাঁচতে পারি।’ কমান্ডার নির্দেশ দেন, ‘তবে যুদ্ধ কর।’ ১২ জন থেকে যোদ্ধার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় পাঁচজনে। একটু পরে ¯্রফে ইলিয়াস আর জ্যোতি ছাড়া আর কারোর অস্ত্র থেকে গুলির শব্দ শোনা যায় না। এমনকি জ্যোতির এলএমজির গুলি সরবরাহকারীও নেই আর। মধ্য নবেম্বরের দীর্ঘ বিকেলের সেই ক্লান্ত সময়ে এক অসম্ভব যুদ্ধে লিপ্ত হন দুই যোদ্ধা। ইলিয়াস গুলি লোড করতে থাকেন, আর জ্যোতি ১০০ গজ দূরে সারিবদ্ধ পাকিস্তানীদের গুলি করতে থাকেন অকুতোভয় তীব্রতায়। নিখুঁত নিশানায়, একটার পর একটা। মাথার ওপর দিয়ে তীব্র গর্জন করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানীদের একটার পর একটা গুলি। তাতে বাধা দিতে মাঝে মাঝেই মর্টার থেকে শেলিং করছেন তারা। মনে ক্ষীণ আশা। সন্ধ্যা হয়ে গেলে হয়ত পাকিস্তানীদের ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। হায়! ওটুকু সময়ও দেয়নি। সেদিন সন্ধ্যা হবার ঠিক আগে জ্যোতির মাথা ভেদ করে যায় এক আচমকা পাকিস্তানী বুলেট। গলাকাটা মহিষের মতো ছটফট করে জ্যোতির শরীর। ইলিয়াস জড়িয়ে ধরেন তারে। ডাকেন, ‘দাদা, ও দাদা! জ্যোতি একবার মাথা তোলেন। মাথা পড়ে যায়। যাবার আগে মাতৃভাষায় ¯্রফে দুটো ক্লান্ত শব্দ উচ্চারিত হয় পাকিস্তানীদের সীমাহীন আতঙ্ক আর ভয়ের কারিগরের কণ্ঠ থেকে, ‘আমি যাইগ্যা’। সেদিন কাঁদতে পারেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের কাঁদার নিয়ম নেই যে। ইলিয়াস কাঁদেন ৪৩ বছর পর- ২০১৫ সালের ২০ জুন, স্বাধীন মাটিতে সেদিনের সেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, দাদার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে। চিৎকার করে কাঁদেন দাদার জন্য। তার কমান্ডারের জন্য এ কান্না বড় শোকার্ত, তীব্র আর্তনাদের। এ কান্না হৃদয়ের গহিন ভেতরের, বড় যন্ত্রণার। যুদ্ধের পরের কথাগুলো আরও পরে পাঠ করতে পারা যায়। জগৎজ্যোতির শহীদ হবার ছোট ইতিহাসটুকুর পরও আর বলার আছে। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য) ঢাকা ॥ ১৭ নবেম্বর ১৯ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কী-বোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক
×