ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইমন মাহমুদ

নতুন বিষয়, নতুন সম্ভাবনা ॥ পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিক্স

প্রকাশিত: ১২:২৯, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

নতুন বিষয়, নতুন সম্ভাবনা ॥ পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিক্স

সুস্থতা সবারই কাম্য। জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ছোট্ট জীবনে আমরা সবাই সুস্থভাবে বাঁচার চেষ্টা করি। আমরা চাই নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের প্রতিটি সদস্যই যেন সুস্থ থাকে। কিন্তু তারপরেও দেখা যায় জ্বর, ঠা-া, সর্দি-কাশির মতো ছোটখাটো রোগগুলো যেন পিছুই ছাড়তে চায় না। মাঝে মাঝে জটিল রোগেও ভুগতে হয়। এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য ছুটতে হয় ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তারের চেম্বারে গেলে কিছু ওষুধপত্র খাওয়ার পরামর্শ পাই। কেমন হতো যদি আমরা রোগ হওয়ার আগে থেকেই রোগ প্রতিরোধের উপায় সম্বন্ধে জানতে পারতাম? কিংবা সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত তা জানতে পারতাম? তাহলে হয়তো অনেকাংশেই রোগব্যাধি মুক্ত থাকতে পারতাম এবং ঘন ঘন ডাক্তারের চেম্বারে অথবা ফার্মেসির দোকানে ছোটা লাগতো না। রোগ প্রতিরোধ, মানব স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং দীর্ঘায়িত সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ। পাবলিক হেলথ বিষয়টি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে অপরিচিত মনে হলেও ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে বিষয়টি বহুল জনপ্রিয় বিষয়। ডঐঙ, টঘঋচঅ, টঘউচ, ঝধাব ঃযব ঈযরষফৎবহ এর মতো বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত অনেকাংশেই পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। পাবলিক হেল্থ বা জনস্বাস্থ্য এমন একটি বিজ্ঞান যা ব্যক্তি, সম্প্রদায়, সংস্থা ও সমাজে বিরাজমান আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ, মানব স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং দীর্ঘায়িত সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। পাবলিক হেলথের প্রধান ভিত্তি হলো একটি জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য এবং এর সঙ্গে জড়িত যে সকল ঝুঁকি বিরাজমান তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা। সাম্প্রতিক বিশ্বে অন্যতম পরিচিতি পাওয়া বিষয় হচ্ছে ‘পাবলিক হেলথ’। জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথ বিষয়টি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় জড়িত বিভিন্ন খাতের সমন্বিত কার্যক্রম। স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া এই বিভাগের অন্যতম প্রধান কাজ। বিষয়টি আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে অনেকটা অপরিচিত হলেও ইতোমধ্যে পাবলিক হেলথ বিষয়টি বিশ্ব দরবারে সুনাম কুড়িয়েছে। যার উপর ভিত্তি করেই ২০১১ সালে বাংলাদেশের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিক্স’ নামে একটি বিভাগ চালু করা হয় এবং আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট (অনার্স) প্রোগ্রাম শুরু করা হয়। তবে বাংলাদেশে এ বিষয়ে পড়ালেখার হাতেখড়ি ১৯৭৮ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ এ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিনে (নিপসম)। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপিএই ডিগ্রী দেয়া হতো। শুধু ডাক্তার ও সরকারী কর্মকর্তারা এই ডিগ্রী নেয়ার সুযোগ পেতেন। এরপর ২০০৬ সালের পর থেকে দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারী ইউনিভার্সিটিতে পাবলিক হেলথ বিষয়ক মাস্টার্স প্রোগ্রাম শুরু করা হয় এবং সেখানে এমপিএইচ (গচঐ) ডিগ্রী প্রদান করা হয়। কী পড়ানো হয়? এই বিভাগটি মূলত প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যাকে আলাদাভাবে চিন্তা না করে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করে সবার জন্য। পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার শিক্ষার বিষয়বস্তু হচ্ছে-মানুষের রোগ নিয়ে গবেষণা করা, প্রতিরোধ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার পথ আবিষ্কার করা। মূলত মানবদেহ, বায়োকেমিস্ট্রি, নৃবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি, ডেমোগ্রাফি, এপিডেমিওলজি, বায়োস্ট্যাটিস্টিকস, প্রজনন, মাতৃমঙ্গল শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা গবেষণা পদ্ধতি, পেশাগত স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, হসপিটাল ব্যবস্থাপনা, রিসার্চ মেথোডলজি ইত্যাদি বিষয়গুলো পাবলিক হেলথ বিভাগে গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়। গোটা জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি গ্রহণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করাই পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্টদের কাজ। তাছাড়া এই শিক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবং বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন- বার্ড ফ্লু, জিকা, কলেরা, বসন্ত, মহামারী মোকাবেলায় পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ও নেতৃত্ব তৈরি করা। কেন? ইংরেজীতে একটি প্রবাদ রয়েছে,‘চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব’ অর্থাৎ প্রতিকারে চেয়ে প্রতিরোধ ভালো। ডাক্তাররা রোগ প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারেন কিন্তু মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য যা যথেষ্ট নয়। এ এর জন্য দরকার পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। একজন পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্টের মূল কাজ হচ্ছে; রোগ প্রতিরোধের জন্য স্বার্থক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রোগ প্রতিাকারের সঙ্গে সঙ্গে তাই পাবলিক হেলথ রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনগণের অভ্যাসগত পরিবর্তনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ভবিষ্যত কি? সম্প্রতি পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়টদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তাদের চাকরির সুযোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাবলিক হেলথ কেয়ার বিষয়ক নানামুখী গবেষণা ও শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম রোগের আবির্ভাব ঘটছে। এজন্য ডঐঙ, টঘঋচঅ, টঘউচ ছাড়াও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা পাবলিক হেলথ নিয়ে গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এখানে বহু লোকের কর্মসংস্থান ও সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে গবেষণার সুযোগ। সরকারী ক্ষেত্রে এডমিনিস্ট্রেটিভ, পাবলিক হেলথ, কমিউনিটি মেডিসিন ইত্যাদি সেক্টরে কাজের সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও, দেশী-বিদেশী অনেক বেসরকারী সংস্থা যেমন- আইসিডিডিআরবি, সেভ দ্য চিলড্রেন, এফএইচআই-৩৬০, আইডিআরসি, সিআইপিআরবিতে কর্মসংস্থান হচ্ছে এই বিষয়ে ডিগ্রীধারী শিক্ষার্থীদের। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফেলোশীপ পাচ্ছে পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্টের ছাত্ররা। জাবির ‘পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিক্স’ হেলথ সেকশনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের,’ বললেন পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার। তিনি আরও জানান বর্তমানে বিভাগটিতে ৮ জন শিক্ষক শিক্ষকতা করছেন এবং ৬টি ব্যাচের সর্বমোট ২১২ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। ইতোমধ্যে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন ২টি ব্যাচের ৭০ জন শিক্ষার্থী। পড়াশোনার জন্য কেন বেছে নিলেন পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিক্স এমন প্রশ্নের জবাবে বিভাগটির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী মাকসুদুর রহমান মারুফ বলেন , ‘আসলে আমার ইচ্ছা ছিল কমিউনিটিভিত্তিক গবেষণাধর্মী কোন বিষয়ে পড়ার। ‘পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিক্স’ বিভাগের নামের সঙ্গেই কমিউনিটি শব্দটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বিশাল একটি কমিউনিটি এবং উন্নতমানের গবেষণার জন্য বিভাগের পাশাপাশি রয়েছে ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, যা গবেষণার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।’
×