ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বছরে পাচার ৫৫ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

 বছরে পাচার ৫৫ হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে তিন বছর মেয়াদী জাতীয় কৌশলপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। নতুন এই কৌশলপত্র বাস্তবায়নে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করবে সরকার। টাকা পাচার, সন্ত্রাস ও জঙ্গী অর্থায়ন দেশের একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালো টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না, অন্যদিকে বাড়ছে পাচার। আবার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিস্তারে জঙ্গীরা কৌশলে দেশ-বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, নতুন এই কৌশলপত্র বাস্তবায়ন হলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করে এ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি। সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও টাকা পাচার নিয়ন্ত্রণে (২০১৯-২১) তিন বছর মেয়াদী এই কৌশলপত্র ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামীকাল ১৭ নবেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে এ সংক্রান্ত একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। ওই অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও বিভাগগুলোকে এই কৌশলপত্র বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হবে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ৫৭ দেশের সঙ্গে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। এছাড়া সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে ৪১ ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। জঙ্গী অর্থায়ন ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যক্রমের ওপর। এদিকে, জাতীয় এই কৌশলপত্র তৈরি করায় সরকারের কর্মকান্ডে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানদন্ড নির্ধারণকারী সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিং (এপিজি)। অবশ্য নানা ধরনের জটিলতার মুখে অর্থ পাচার, সন্ত্রাস ও জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে ’১২ সালে প্রণীত আইনটি পুরোপুরি দেশে কার্যকর হতে পারছে না। এতে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন কমছে না, বরং অর্থ পাচার বাড়ছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনটি অধিকতর কার্যকর করতে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরাও। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, দুই পন্থায় অর্থ পাচার হচ্ছে। এক. ব্যাংক ব্যবস্থা, দুই. আমদানি-রফতানির আড়ালে। এর বাইরে বড় আকারে অর্থ পাচার হওয়ার তেমন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এখন তা বন্ধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বন্দরগুলোয় স্ক্যানার মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওভারপ্রাইসিং আর আন্ডারপ্রাইসিং প্রতিরোধে পিএসআইর আদলে এনবিআরে একটি সেল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দেশ থেকে টাকা পাচার অনেক কমে আসবে। তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত আইনগুলো অনেক আগে করা। তবে তখন মানিলন্ডারিং ও টেরোরিস্ট ফিন্যান্সিং বিষয়ে কিছু ছিল না। সুতরাং আইনগুলোর সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি-রফতানির মাধ্যমে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার মধ্য দিয়ে অর্থ পাচার রোধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত করতে জামায়াত-শিবিরসহ মৌলবাদী দলগুলো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিস্তারে অর্থায়ন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইতিপূর্বে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক রিপোর্টে সারাদেশে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত ৫৬১ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা এখনও নেয়া হয়নি। ব্যাংক, বীমা, মিডিয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে জামায়াত-শিবিরসহ জঙ্গী গোষ্ঠী। বিএনপি-জামায়াত জোটের মৌলবাদী রাজনীতি বিশেষ করে হুজি, হরকাতুল জিহাদ, হেফাজতে ইসলামের উত্থান ঘটায়। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। সন্ত্রাস ও জঙ্গী অর্থায়নে এরা কাজ করছে। তাই এসব অর্থের উৎস ও কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন করা প্রয়োজন। টাকা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে ইতিপূর্বে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন পাস হয়। লক্ষ্য ছিল, দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ। এছাড়া সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ও জাল নোট তৈরির মতো অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের সক্ষম করবে এমনটি মনে করা হয়েছিল। ওই আইনে মানিলন্ডারিং সম্পর্কিত অপরাধগুলোর সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২৮ কর্মকান্ডকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অবৈধ অস্ত্রের বাণিজ্য, সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, পাইরেসি, উড়োজাহাজ ছিনতাই, অবৈধ মাদক বিক্রি, মানব পাচার, সংগঠিত অপরাধ, জিম্মি করা, কপিরাইট লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও ঘুষ, জাল করা, খুন ও শারীরিক ক্ষতি ও যৌন অপব্যবহার, ভয় দেখানো, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, চোরাচালান ও পরিবেশগত অপরাধসমূহ উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। এদিকে, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সাম্প্রতিক এক বৈঠকে দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের এজেন্সির রিপোর্টের ভিত্তিতে মানি লন্ডারিং নিয়ে ১০টি মামলা হয়েছে। আরও একশ’ লেনদেন নজরদারির আওতায় রয়েছে। তদন্ত চলছে ১৯টির। এ পর্যন্ত ৩৩টি মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় সাজা হয়েছে।
×