ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হত্যাকান্ডে ভাশুর ও জা জড়িত ॥ স্থানীয় সন্ত্রাসী মারুফকে দিয়ে খুন করায়

রিক্সাচালকের দেয়া তথ্যে সগিরা মোর্শেদ হত্যা রহস্যোদ্ঘাটন

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

  রিক্সাচালকের দেয়া তথ্যে সগিরা মোর্শেদ হত্যা রহস্যোদ্ঘাটন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রত্যক্ষদর্শী এক রিক্সাচালকের দেয়া তথ্যে ত্রিশ বছর পর ঢাকার সিদ্বেশ্বরীর সগিরা মোর্শেদ হত্যার রহস্যোদ্ঘাটন করেছে পিবিআই। হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করে পাঠায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে চার আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। উপরতলা থেকে ময়লা ফেলার সূত্র ধরে ঘটে এই রোমহর্ষক হত্যাকান্ড। হত্যাকান্ডের সঙ্গে ভাশুর জড়িত। মূলত তার পরিকল্পনাতে ঘটনাটি ঘটে। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে সগিরা মোর্শেদ সালাম (৩৪) তার ভিকারুননিসায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া তার মেয়ে সারাহাত সালমাকে (৮) আনতে বের হন। স্কুলের সামনে পৌঁছামাত্রই অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা তার হাতে থাকা বালা টেনে খুলে নেয়ার চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় সগিরার স্বামী আব্দুস ছালাম চৌধুরী বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। ১৯৯০ সালে ডিবি পরিদর্শক আব্দুল জলিল শেখ ছিনতাইকারী মিন্টুর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দেন। বিচার চলাকালে নানাভাবে সাক্ষীদের জবানবন্দীতে আসে মারুফ রেজার নাম। মামলাটি ২৬ তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করেন। সর্বশেষ গত ১১ জুলাই সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ক্রিমিনাল মিস কেস খারিজ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেয়। গত ১০ নবেম্বর মামলার সন্দেহভাজন আসামি আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে (৫৯) রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক ১২ নবেম্বর ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে (৬৪) ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যে ১৩ নবেম্বর মারুফ রেজাকে (৫৯) বেইলি রোড তার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আটক সবাই আদালতে সগিরা হত্যায় নিজেদের সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। পিবিআই প্রধান বলছেন, সগিরা মোর্শেদ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আসামি ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন (৬৪)। আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান (৫৯) ও মারুফ রেজা পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যায় অংশ নেয়। মামলার বাদী সগিরার স্বামী আব্দুস ছালাম চৌধুরী। তার দুই বড় ভাই সামছুল আলম চৌধুরী, মেজো ভাই ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী। সগিরা ও আব্দুস ছালাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনার সময় গড়ে ওঠা সম্পর্কের সূত্র ধরে ’৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। ’৮০ সালে সগিরা ও তার স্বামী শিক্ষকতার জন্য সপরিবারে ইরাক চলে যান। ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণে ’৮৪ সালে তারা আবার দেশে ফেরেন। বসবাস শুরু করেন পৈত্রিক বাড়ি রাজারবাগ পেট্রোল পাম্পের কাছে দোতলা বাড়িতে। তাদের তিন মেয়ে সারাহাত সালমা চৌধুরী (৮), সামিয়া সারোয়াত চৌধুরী (৫) ও সিফাত আবিয়া চৌধুরী (২)। আর সগিরার ভাশুর ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী বারডেম হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে কর্মরত। তিনি ’৮০ সালে সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে বিয়ে করেন। ওই বছরের ২২ জুন এই দম্পতি লিবিয়া চলে যান। আবার ’৮৫ সালে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ দেশে ফেরেন। বসবাস শুরু করেন ৯৫৫ আউটার সার্কুলার রোডের রাজারবাগের ওই বাড়িতে। যে বাড়িতে সগিরারা দোতলায় বসবাস করতেন। বাবা-মা ছাড়াও আরেক ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে নিচতলায় একত্রে কিছুদিন বাস করেন। এরপর দোতলায় আব্দুস ছালাম চৌধুরীর বাসার একটি রুমে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী ও তার পরিবার। এক বাসায় থাকায় ডাঃ হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী শাহিনের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে সগিরার প্রায়ই ঝামেলা হতে থাকে। মাস ছয়েক পরে ’৮৬ সালের এপ্রিলে তৃতীয় তলার কাজ শেষ হলে ডাঃ হাসান আলী তিন তলায় ওঠেন। তিনতলা থেকে প্রায়ই ময়লা ফেলা হতো। এই নিয়ে জা শাহিনের সঙ্গে সগিরার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একপর্যায়ে তা চরম আকার ধারণ করে। ডাঃ হাসান আলীর স্ত্রী শাহিন সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা নেয়। এতে সায় দেন তার স্বামী ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী। ডাঃ হাসান আলীর রোগী ছিলেন তৎকালীন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার নামকরা সন্ত্রাসী মারুফ রেজা। রেজা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে। ডাঃ হাসান চৌধুরী সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফ রেজাকে ২৫ হাজার টাকা দেয়। ডাঃ হাসান চৌধুরীর শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজোয়ানকে মারুফ রেজার সহযোগী হিসেবে কাজ করতে বলেন চিকিৎসক। রেজওয়ান ডাঃ হাসান আলী চৌধুরীর বাসায় যাতায়াতের সুবাদে সগিরাকে ভালমতোই চিনত। ঘটনার দিন ডাঃ হাসান চৌধুরী তার শ্যালক রেজওয়ানকে দুপুর দুটোর দিকে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলে। অপর আসামি মারুফ রেজা মোটরসাইকেলযোগে মৌচাক মার্কেটের সামনে এলে ডাঃ হাসান চৌধুরী শ্যালককে মারুফ রেজার সঙ্গে গিয়ে সগিরাকে দেখিয়ে দিতে বলে। রেজওয়ান ও মারুফ রেজার মোটরসাইকেলে করে সিদ্ধেশ^রী কালীমন্দিরের গলিতে যায়। তারা সগিরাকে রিক্সাযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে যেতে দেখে পিছু নেয়। স্কুলের সামনে সন্ত্রাসী মারুফ রেজা মোটরসাইকেল দিয়ে সগিরার রিক্সা আটকায়। সগিরার হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। হাতে থাকা সোনার বালা খুলে নেয়ার চেষ্টা করে। সগিরা রেজওয়ানকে চিনে ধমক দেন। তাকে ধমক দেয়ায় মারুফ রেজা ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে কোমর থেকে রিভলবার বের করে সগিরাকে গুলি করে। প্রথম গুলিটি সগিরার হাতে লাগে। এরপর সে সগিরাকে আরও একটি গুলি করে। গুলিটি বাঁ বুকে বিঁধলে তিনি মারা যান। পরে আরও দুটি ফাঁকা গুলি করে মোটরসাইকেলযোগে তারা পালিয়ে যায়। আসামিরা মামলা তুলে নিতে সগিরার পরিবারকে হুমকি দিতে থাকে। পিবিআই প্রধান বলেন, হত্যাকা-ের এক প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল রিক্সাচালক, যে রিক্সায় ছিল সগিরা মোর্শেদ। তাকে খুঁজে বের করে পিবিআই। তার নাম ছালাম মোল্লা। বর্তমানে বয়স ৫৬ বছর। খুনের ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ২৬। এ সপ্তাহেই রিক্সাচালক সগিরা খুনের বিষয়ে আদালতে জবানবন্দী দেন।
×