ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল্লাহ আল মোহন

অস্থির সময়ের প্রতিবিম্ব

প্রকাশিত: ১৩:২৬, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

অস্থির সময়ের প্রতিবিম্ব

কথাশিল্পী মোহিত কামালের ‘চেনা বন্ধু অচেনা পথ’ উপন্যাসটি মূলত ফেসবুক, ই-মেইল ও মুঠোফোনের ব্যবহার-অপব্যবহার নিয়ে সমকালীন সমাজের অসুস্থতার সচিত্র কাহিনী হিসেবে ফুটে উঠেছে। বিভ্রান্ত যুবসমাজের পাতানো ফাঁদ ও বঁাঁকা পথের বিচিত্র রেখার দেখা মেলে উপন্যাসে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ভাবনা ও কথোপকথনে, শব্দ বিন্যাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, ক্রোধের প্রতিক্রিয়া ও আত্মশুদ্ধির মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিকতার এই অস্থির সময়ের সন্তান রুহিত, রুদমিলা আর রাহার ত্রিমাত্রিক প্রেম ও ডিজিটাল প্রতিহিংসার স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবিই ‘চেনা বন্ধু অচেনা পথ।’ পেশাগত কারণেই বিজ্ঞানের উন্নতির বাহনে চড়ে এগিয়ে চলা তরুণ প্রজন্মের ভুলের কারণে গড়ে ওঠা সামাজিক ক্ষত চিহ্নগুলো গভীরভাবে দেখার সুযোগ ঘটেছে লেখক মোহিত কামালের। প্রযুক্তির সুফল বাদ দিয়ে একশ্রেণীর অপরাধী ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলছে নারীদের, ব্ল্যাকমেইল করছে প্রতিনিয়ত। যৌনতার ফাঁদেও আটকে যাচ্ছে অসচেতন তরুণীরা। এ জালে জড়িয়ে পড়ছে তরুণেরাও। জৈবিক নেশায় ডুবে যাচ্ছে তারা। ফান বা মজা করতে গিয়েও ঘটছে নানা বিপর্যয় আর অঘটন। মোহিত কামাল তাঁর চরিত্রদের আমাদের বাস্তব সমাজ জীবন থেকেই হাজির করছেন কথাসাহিত্যে। তারই প্রমাণ মেলে তাঁর সৃষ্টিতে, রচনায়। প্রযুক্তির উৎকর্ষে নতুন ঢঙে সেজেছে বিশ্ব, এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। আবার এই প্রযুক্তির সহায়তায় বেড়ে গেছে নারী উৎপীড়ন, নারী নির্যাতন। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট- ফেসবুক। ফেসবুক, ই-মেইল, মুঠোফোনের ব্যবহার- অপব্যবহার নিয়ে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি। প্রাসঙ্গিক টানে উঠে এসেছে তরুণ প্রজন্মের মনস্তত্ত্ব, বন্ধুত্ব, শিক্ষাজীবন, পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র। ভুল করে কিংবা কৌতূহলের বশে টিনএজার ও তরুণ-তরুণীরা জড়িয়ে যাচ্ছে সাইবার ক্রাইম, সামাজিক অপরাধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের সঙ্গে। সর্বনাশ ঠেকাতে প্রয়োজন শক্ত পারিবারিক মায়ার বাঁধন, ব্যক্তিসচেতনতা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ। মূল্যবোধই ঠেকাতে পারে সন্তানের পতন, উজ্জ্বল করতে পারে শিক্ষাজীবন। দুই. ‘চেনা বন্ধু অচেনা পথ’ উপন্যাসের শুরুটাই বেশ নাটকীয় এবং দার্শনিকতা দিয়ে। ‘লালনকে বলেন সিরাজ সাঁই- ভাইটি, মনে রেখো, সব খোঁজাখুঁজির মধ্যে বড় হলো নিজেকে খোঁজা’ (পৃঃ ১১)। উপন্যাসের নায়ক রুহিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনের মানুষ উপন্যাস পড়তে গিয়ে এভাবেই দার্শনিক প্রশ্নে জর্জরিত হয়। যে সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’ থেকে ‘সে-ই বুদ্ধিমান যে নিজেকে সমালোচনা করতে পারে’ জীবন জিজ্ঞাসায় থেমে থাকে না। এ সময় দেখা মেলে উপন্যাসের নায়িকা চরিত্র রুদমিলার। যে রুহিতের ঘরে ঢুকে বলে, ‘মনের পরিচর্যা না করলে, মন ব্যবহার না করলে, পিসির বাইরের ময়লার মতো মনেও জমতে পারে ধুলাবালি, আবর্জনা’ (পৃঃ ১৩)। নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত রুহিত আচমকা রুদমিলাকে নিজের রুমে দেখতে পেয়ে আর নাগরিক থাকে না, মনে ভাসে তার আল মাহমুদের সোনালি কাবিনের সনেট। তারা নিজেদের ত্রুটি নিয়ে, প্রশংসা নিয়ে, নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে দারুণ প্রাণবন্ত বিতর্কে মেতে ওঠে। তর্কের মধ্য দিয়ে তারা পরস্পরকে আরও গভীরভাবে অনুভব করে, নতুন করে চেনে, ভেতরকার ভাবনাগুলোকে জানে এবং হয়ে ওঠে বস্তুবাদী, বাস্তববাদী। নায়িকা রুদমিলা প্রশংসা সমালোচনা নিয়ে আলাপনে বলে, ‘সত্যকে ধারণ করার ক্ষমতা থাকলে অহঙ্কারী হবে না। বাস্তববাদী হতে পারো। পজিটিভটা নাও। নেগেটিভটা নেবে কেন পজিটিভের ভেতর থেকে। সত্যি বলেছি আমি, আপনার ভেতর-জগত নোংরা। সমালোচনা করেছি। সমালোচনায় শুদ্ধ হবেন আপনি। আঘাতপ্রাপ্ত হবেন না। এটা হচ্ছে আমার কথার টার্গেট। আপনার কথার টার্গেট নেই। কাউকে প্রশংসা করলে শোধরানোর কিছু থাকে না। নষ্ট হওয়ার মতো বিষয় আশয় থাকে প্রশংসার মধ্যে’ (পৃ-১৭)। রুদমিলার বাবা নওশাদ জামিল মেয়ের চেয়ে বেশি ভাবেন ছেলে রুহানকে নিয়ে, ‘ইদানীং নতুন জগত তৈরি হচ্ছে তার-মুঠোফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকে ঘরে’ (পৃঃ ২৫)। ফলে কমে যেতে থাকে পরিবারের প্রতি বন্ধন। আলগা হয়ে যাচ্ছে রুহানদের মন থেকে মায়ার বাঁধন। প্রশ্ন জাগে ওয়েস্টার্ন কালচার কি ঢুকে যাচ্ছে আমাদের জীবনে? রুহিতের মা বাল্যবান্ধবী শবনম চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেন একজন পিতা নওশাদ জামিল, ‘জেনারেশন গ্যাপের কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হচ্ছে ঘরে ঘরে। মডার্ন মা-বাবারাও এ সংঘাতের বাইরে নয়। সবাই ভাবছে যার যার অবস্থানে সবাই রাইট। তলে তলে ক্ষয়ে যাচ্ছি, বদলে যাচ্ছি আমরা। বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে পুরো রাত জেগে যেন কথা বলতে না পারে সন্তানরা। রাত হচ্ছে ঘুমানোর সময়। সময়ের অপব্যবহার করলে জীবনেরই অপব্যবহার করা হবে। মেয়েদের ক্ষতি বেশি। ছেলেদের ক্যারিয়ার গড়ার পথে তৈরি হয়ে যাবে বাধা। সেই বাধা ডিঙানোর সামর্থ্য হারিয়ে যাবে আবেগের জোয়ারে’(পঃ ২৮)। তিন. আবার জীবন নিয়ে রুদমিলার প্রশ্নের জবাব দেয় রুহিত, ‘জীবনে চলার পথে ঠকা খেতেই হবে। কেউ ঠেকে শেখে, কেউ শেখে বড়দের পরামর্শ নিয়ে। বই পড়ে।’ ক্ষুদ্র মানুষ যে দিতে পারে না বিশাল কিছু। সে প্রসঙ্গও আসে। তাদের চ্যাটিংএ ফেসবুকে কমেন্ট আসে, ‘কালোত্তীর্ণ কথা মনের মানুষ। এ কথার ক্ষয় নেই, লয় নেই। মনের মানুষ হতে পারে ছেলের, হতে পারে মেয়ের। জেন্ডার বৈষম্যহীন শব্দটির বিকল্প আর কোন শব্দ নেই ডিকশনারিতে’ (পৃ-৪৩)। দ্বন্দ্ব জয় করার নামই সফলতা। তবে সফল হওয়া যে কঠিন বোঝে তারা। ছেলেবেলার বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলার কারণে ছেলের কাছে অপমানিত হওয়া বাবাকে সান্ত¡না দেয় রুদমিলা, ‘আমি জানি তোমার মধ্যে কোন মলিনতা নেই। মনের স্বচ্ছতা নিয়ে শিশুবেলার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলো তুমি। এটা তোমার দোষ না। এটা হচ্ছে ভাইয়ার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দোষ’ (পৃঃ ৬৪)। ছেলে রুহানের কাছ থেকে কষ্ট পেয়েও ভেঙ্গে পড়েন না বাবা নওশাদ জামিল, দৃঢ় প্রত্যয়ে, আত্মবিশ্বাসে জেগে ওঠেন। লেখক বর্ণনা করেছেন, ‘এই নওশাদ জামিল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে পড়েন না, জেগে ওঠেন নতুন উদ্যামে।’ এদিকে রুহিত অনলাইনে উচ্ছ্বাসী, স্মাট রাহাকে বুঝতে পারে না। সন্দেহ ও কৌতূহল জাগে তার মনে, ‘মনে হচ্ছে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে ওস্তাদ রাহা। ছেলেদের বাগে আনতে ইমোশন ব্যবহার করার চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর কিছু নেই। সেই অস্ত্র যথাযথ ব্যবহারে দক্ষ রাহার প্রতি নেতিবাচক ধারণার পাশাপাশি কৌতূহল আসে রুহিতের মনে’ (পৃঃ ৭০)। প্রেমজনিত মানসিক বিপর্যয়ের সময় রুহিতের মনে হয়, ‘বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে সবকিছু শেয়ার করা উচিত। নইলে নিজের মনের স্বাস্থ্য খারাপ হতে বাধ্য। আর সঙ্কট মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার নাম জীবন।.. নিজেকে বন্দি রাখার নাম মৃত্যু’ (পৃঃ ৭৮)। রাহা তার ও রুদমিলার দু’জনেই মনের মানুষ রুহিতকে নিজ বেডরুমে ঘুমের বড়ি খাইয়ে ব্লাকমেইল করে ছবি তুলে তা এডিট করে বান্ধবী তিতলির সাহায্যে ফেসবুকে সেসব আপত্তিকর ছবি রুদমিলার এ্যাকাউন্টে ট্যাগ করে দেয়। রাহাদের ষড়যন্ত্রে প্রাণবন্ত রুদমিলা মিথ্যাচারের সামাজিক কুৎসিত বোমায় যেন তার সকল আবেগ অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। কুৎসায় জর্জরিত হয়েও রুদমিলার চোখে কান্না নেই, চোখে ক্রোধ নেই তবে নির্বাক, বিমূঢ়, নিস্তব্ধ হয়ে ভাইয়া রুহানের হাত চেপে ধরে মানসিক শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে। সাহস দেয় সে নিজেকেই, ‘সাবধানে চলতে হয় তরুণীদের। বন্ধুত্ব করতে হয় বুঝেশুনে। খামখেয়ালিপনা মানায় না মেয়েদের। সমাজ এখনও মেয়েদের বাড়াবাড়ি আচরণ সুন্দর চোখে দেখে না। লুকোছাপা চলাফেরাকেও কুৎসিত চোখে দেখে কুৎসিত মানুষ। কীভাবে বদলাবে চারপাশের মানুষের পচা চোখ?’ (পৃঃ ৮১)। সামাজিক কুৎসিত বোমায় যেন উড়ে যায় রুদমিলার আবেগ-অনুভূতি। বিষ কুৎসা, মিথ্যা অপবাদে ভেঙ্গে না পড়ে রুদমিলা ভেতর থেকে জেগে ওঠে। তার মনে হয় চেনা মুখের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভয়ঙ্কর এক শত্রু- বন্ধু হিসেবে ছোবল দেয়, অচেনা পথে ওত পেতে গোপনে ছুরি চালায় বুকে। ছুরির জখম প্রতিহত করতে হবে। জয়ী হতে হবে তাকে। সাইবার ক্রাইম যুদ্ধে রুদমিলা সংযমী হয়ে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ রেখে, বুদ্ধি খাটিয়ে জয়ী হতে মনোবল দৃঢ় করে। থানা-পুলিশ-আইনের সহযোগিতায় তার জয়ও হয় অবশেষে। একসময় নিজের ফাঁদেই আটকা পড়ে রাহা। রাতুলের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের গোপন ভিডিওচিত্রের কথা জানতে পারে রাহা। যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার। এদিকে একসময় সাইবার ক্রিমিনাল রাতুলকে সঠিকভাবেই শনাক্ত করতে পারে রুদমিলার ভাই রুহান। রুদমিলা বাবার সঙ্গে নেটওয়ার্ল্ড নিয়ে আলোচনা করে। অনুধাবন করে, জীবন মানে যুদ্ধ। সে যুদ্ধে নিজে ঠিক থাকলে কেউ ক্ষতি পারে না। পুলিশ অফিসার জয়নাল আবেদিন যখন রাহাকে জেরা করে তখনই ফুটে ওঠে সাম্প্রতিক সাইবার ক্রাইমের ভয়ঙ্কও চিত্র ও এর প্রতিরোধক। যারা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয় তাদের নৈতিকতা, মূল্যবোধের পতন ঘটে। তখনই সামাজিক স্খলন রোধ করা দায় হয়। ‘পর্নো ছবি ঘুণপোকার মতো নিঃশেষ করে দিচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধ। বাবা-মা আরও বেশি সতর্ক না হলে ঠেকানো যাবে না সামাজিক পতনের দায়’ (পৃঃ ১৭৬)। চার. বান্ধবী স্নিগ্ধার জীবনদর্শন রুহিতের মনে দাগ কাটে। ‘ভার্চুয়াল ওয়াল্ডের ছেলেমেয়েদের আবেগ স্থায়ী হয় না, বদলায় বারে বারে। অসংখ্য জনের সঙ্গে আবেগের শেয়ার হয় বলে, সেই আবেগের বন্ধন টেকে না বেশি দিন। বন্ধন দৃঢ় করার জন্য প্রয়োজন বাস্তব জগতের রিয়েল ইমোশন, যা তৈরি হয় বাস্তবে কাছাকাছি থাকার মাধ্যমে’ (পৃঃ ১৮৮)। একসময় বুঝতে পারে রুহিত ভালবাসার কাছে সেক্স তুচ্ছ। রুদমিলাকে প্রকৃত ভালবাসার কারণে নিয়ন্ত্রণে আছে তার সেক্সুয়াল ইমপালসন। ‘গভীর দুঃখই আসল সম্পর্কের কষ্টিপাথর।’ মুখোশের আড়ালে মানুষকে সবসময় চেনা যায় না। আর নিজের মুখোশ নিজের চোখে ধরা পড়ে না। অন্যের মুখোশ নিয়ে ভাবে মানুষ, নিজেকে দেখতে পায় না। নিজের অপরাধও নজরে আসে না। আবার নিজেকে কেবল শুদ্ধ ভাবলে চলে না। ‘সমাজের চোখের বিষদৃষ্টি থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করতে হয় আমাদের। এক্ষেত্রে মেয়েদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হয়। বিপদে শক্ত হতে হয়। দিশেহারা হলে বিপর্যয় আসে জীবনে। আর সফল হতে হলে চারপাশের সব ঝামেলা তুচ্ছ করে বসতে হয় সাধনার টেবিলে’ (পৃঃ ১৯২)। বিকৃত চর্চারোধের জন্য আমাদের প্রথম প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা। জীবন মানেই সব সময় যন্ত্রণা নয়। জীবনে যন্ত্রণা থাকবে, সেই যন্ত্রণার চাপে স্বাভাবিক দিনযাপন ক্ষতিগ্রস্ত করা চলবে না। মানসিক যাতনায় ভেঙে না পড়ে, সব না হারিয়ে অদৃশ্য সম্পদ লেখাপড়ার প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া জরুরি। যা বিপথগামী হওয়া থেকেও আমাদের রক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত রুদমিলার অকপট সত্যের জয় হয়। মান অভিমান শেষে রুহিতের মা শবনম চৌধুরী রুদমিলাকে মেনে নেন। মানুষ হিসেবে রুদমিলার অসাধারণ চরিত্রের মূল্যায়ন করেন। কারণ রুদমিলা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও অন্যের প্রশংসা করতে জানে, অন্যের ভালর জন্য ব্যাকুল হয়। সব জটিলতার নিরসন হয় একসময়। নওশাদ জামিলও মেয়ে রুদমিলাকে নতুন করে জীবনের স্বপ্ন দেখান। দুঃসময়ে মেয়েকে বেশি সময় দেন। ‘টাইম ইজ দ্য মেইন হিলার’- সময়ই পারে মনের ক্ষত মুছে দিতে’ (পৃঃ ১৪)। পাঁচ. উপন্যাস পাঠশেষে মনে হয়, প্রেমের খেলা জমে ভাল যৌবনেই। ছোট ছোট বাক্যবিন্যাসের মাধ্যমে লেখক সময়ের যন্ত্রণাকে এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির ধারাকে অত্যন্ত সরলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ঢাকা শহরের যানজটকে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তসহ পাওয়া যায় ভয়াবহ পরিবেশ দূষণকেও। যার ব্যাখ্যা আমাদের জন্য ভয়ংকরই বটে। উপন্যাসে আমরা দেখি সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকেই। যেমন, নারী নির্যাতনের জঘন্যতম এবং নতুন কৌশল হলো ব্ল্যাকমেইলিং ভিডিও রেকর্ডিং ও সিডি প্রকাশ। নারীদের দৈহিক সম্পর্কের দৃশ্য গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করে বাজারে সিডি আকারে বিক্রি করা হয় যা নারীর জন্য চরম নির্যাতন। কেননা নারীরাই ব্ল্যাকমেইলিং এর শিকার হয় বেশি এবং দায়ভারও তাকেই বহন করতে হয়। জীবনে ইতিবাচক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কষ্টের ভেতর দিয়েই মানুষ খাঁটি হয়। তা না হলে কালো মেঘে ঢেকে যায় আলো। উপন্যাস শেষে এই উপদেশবাণী যথার্থ মনে হয় ‘মানুষের প্রথম বেস্ট ফ্রেন্ড মা-বাবা। দ্বিতীয় বেস্ট ফ্রেন্ড তার একাডেমিক ডিগ্রী।’ যুব সমাজের সামগ্রিক অধঃপতন ঠেকাতে প্রয়োজন শক্ত পারিবারিক মায়ার বাঁধন, ব্যক্তিসচেতনতা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ। মূল্যবোধ ও সচেতনতা তরুণ প্রজন্মের মনস্তত্ত্বে ঢেলে দিতে পারে বিপর্যয়রোধের শক্তি। চেনা বন্ধুরাও হয়ে যায় অচেনা-চেনা পথ থেকে অনেকে চলে যায় অচেনা পথে। অচেনা পথের চিত্র ভয়াবহ। একবার ওই সর্বনাশা পথে নেমে গেলে ফিরে আসা কঠিন। পাতানো ফাঁদ ও বাঁকা পথের চিত্র দেখা যাবে উপন্যাসে- শব্দবিন্যাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, ক্রোধের প্রতিক্রিয়া ও আত্মশুদ্ধির মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দেখতে পাবেন পাঠক। কুফল বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের সুফল গ্রহণ করে তরুণ প্রজন্মকে এগোতে হবে আলোর দিকে, গড়ে তুলতে হবে শিক্ষাজীবন, আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যত।
×