ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এ্যাঞ্জেলা গোমেজ ॥ নারীর আলোর দিশারী

প্রকাশিত: ১৩:১৮, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

এ্যাঞ্জেলা গোমেজ ॥ নারীর আলোর দিশারী

আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে যখনই নারী নিজের মতো করে চলতে চেয়েছে তখনই তার সামনে এক গাদা প্রতিবন্ধকতা এসে হাজির হয়েছে। কারণ প্রকৃতিগত কারণ বলি আর আচরণগত কারণ বলি পুরুষ যুগে যুগে নারীকে দমিয়ে রাখতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর অন্যদিকে আমাদের সমাজ প্রথাবিরুদ্ধ চলতে চাওয়াটকে কোনভাবেই সমর্থন করে না। আর সেখানে নারী হলে তো কথাই নেই। সমাজ তার পায়ে জিঞ্জির পরাতে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু এত কিছুর পরেও আমাদের সমাজে অসংখ্য মহীয়সী নারী আছেন যারা প্রচলিত প্রথাকে কিছুতেই মেনে নেননি। প্রথার বাইরে এসে নিজের মতো চলার চেষ্টা করেছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন পদে পদে বাধা। এই বাধার প্রচীর পেরিয়েই বহু নারী পথ চলছেন; নিজে আলোর পথে হাঁটছেন অন্যদের হাঁটার প্রেরণা যোগাচ্ছেন। গৃহকোণ আর ঘর সংসারের সাধারণ জীবনের গ-ি পেরিয়ে আমাদের এই বাংলাদেশেরই অসংখ্য নারী নিজেদের কাজের মাধ্যমে দেশে বিদেশে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। তেমনি একজন নারী এ্যাঞ্জেলা গোমেজ। যিনি জীবনের প্রতিটি পদে পদে বাধার প্রচীর ডিঙিয়েছেন। বাধার প্রাচীর ডিঙাতে ডিঙাতেই দেশে বিদেশে আমাদের গর্ব করার মত একজন এ্যাঞ্জেলা গোমেজ হয়ে উঠেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উন্নয়ন সংগঠক এ্যাঞ্জেলা গোমেজ-এর জন্ম ১৯৫২ সালের ১৬ জুলাই গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নাগরি ইউনিয়নের মাল্লা গ্রামে। ৯ ভাই বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। বাবা আগস্টিন গোমেজ এবং মা ইসাবেলা গোমেজ। শৈশবের একটি বড় অংশ কেটেছে মাল্লা গ্রামেই। প্রথম স্কুলের শুরু হয় বাড়ি থেকে ১ কিলোমিটার দূরের মঠবাড়ি মিশন স্কুলে। সেখানে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর নানান ঘটনাক্রমে পড়ালেখা করেছেন নাগরী মিশনের ‘পাঞ্জুরা বোর্ডিং স্কুলে’, কুষ্টিয়ার ভবেরপাড়া মিশন স্কুলে, যশোরের সেক্রেট হার্ট মিশন স্কুলে এবং যশোর শহরের সেবাসংঘ স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাশ করেন।তারপর জীবনে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় পড়াশোনায় ছেদ পড়ে।জীবনের এই দুর্ঘটনাগুলো তাঁকে কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারেনি।আবারও নতুন উদ্যমে পড়াশোনা শুরু করেন।যশোর মহিলা কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৭৪ সালে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এ্যাঞ্জেলা গোমেজের আজকের এই খ্যাতিমান জীবনটি শুরুর দিকে মোটেই মসৃণ ছিল না। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আজ তিনি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে গাজীপুরের কালীগঞ্জের মঠবাড়ি মিশন স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে এ্যাঞ্জেলা তাঁর কমর্জীবন শুরু করেন। তারপর অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ হবার পর যশোর সেক্রেট হার্ট মিশন স্কুলে খ-কালীন শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৫ সাল পর্র্যন্ত তিনি এ স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় এ্যাঞ্জেলা ছুটির দিনে অন্যান্য সিস্টারদের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নারীদের দুঃখ-কষ্ট জানবার চেষ্টা করেন। কাছ থেকে তাদের মানবেতর জীবনযাপন দেখেছেন। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা নারীদের এ বঞ্চনা তার মনে তীব্রভাবে রেখাপাত করে। ভাবতে থাকেন নারীদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। এই ভাবনা থেকেই এ্যাঞ্জেলা সিদ্ধান্ত নেন, নারী উন্নয়নে কাজ করবেন।১৯৭৫ সালের দিকে চাকরি ছেড়ে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ নেন।তারপর তিনি নিজে সাইকেল চালিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন।প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীদের স্বাবলম্বি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।তাঁর এই কাজ সমাজের মোল্লা মাতবররা ভালভাবে দেখেনি। তারা বারবার তাকে গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে; অনেক সময় বিচার সালিশের মুখোমুখিও করেছে। এজন্য তাঁকে অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছে। সমাজের নানা বঞ্চনা আর উপেক্ষার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে থাকেন। যতই বাধা আসে ততই যেন তাঁর কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। এ্যাঞ্জেলা গোমেজ ১৯৮১ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেন তাঁর স্বপ্নের উন্নয়ন সংগঠণ ‘বাঁচতে শেখা’র। গ্রামের শত শত নারীকে তাঁর কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যেতে থাকেন। নারী শিক্ষা, মানবাধিকার, হস্তশিল্প, নির্যাতিত নারী ও শিশুর আইন সহায়তাসহ নারীর উন্নয়নের জন্য এ্যাঞ্জেলা ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। হাজা-মজা পুকুরে মাছ চাষ, কৃষি কাজ করে তিনি গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটান। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামীণ প্রান্তিক নারীদের বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছেন এ্যাঞ্জেলা গোমেজের উন্নয়ন সংগঠন ‘বাঁচতে শেখা’। দক্ষিণের জেলা যশোর শহরে স্থাপিত প্রধান কার্যালয়ের মাধ্যমে সমগ্র খুলনা বিভাগের জেলাসমূহ, বরিশাল বিভাগের ভোলা, ঢাকা বিভাগের গাজীপুর ও ময়মনসিংহে চল্লিশের অধিক শাখা কার্যালয়ের মাধ্যমে ‘বাঁচতে শেখা’র কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজারের অধিক কর্মী ওই অঞ্চলগুলোর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ‘বাঁচতে শেখায়’। লাখ লাখ উপকারভোগী তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণ করে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। এখানেই ‘বাঁচতে শেখা’র স্বার্থকতা। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ্যাঞ্জেলা গোমেজ ব্যক্তিগতভাবে বহু আশ্রয়হীন অনাথেরও শেষ আশ্রয়স্থল। অনেক শিশুকে নিজের কাছে আশ্রয় দিয়ে সন্তান ¯েœহে লালন পালন করে বড় করে তুলেছেন। এ্যাঞ্জেলা গোমেজ বেশ কিছু গ্রন্থও রচনা করেছেন। নারী জাগরণের স্লোগান লিখেছেন। নারী অধিকার-ক্ষমতায়নের পোস্টার তৈরি করেছেন। কবিতা ও গান লিখেছেন। এই সমস্ত নানান কর্মজজ্ঞের স্বীকৃতিস্বরূপ এ্যাঞ্জেলা গোমেজ ১৯৯৯ সালে এশিয়ার নোবেল খ্যাত রমন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার লাভ করেন। ঐ বছরই বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত হন। ২০১৪ সালে ভারতের উড়িষ্যার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কিট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লিটারেসি ডি-লিট’ ডিগ্রীসহ বিভিন্ন সময়ে দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা এবং স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে এ্যাঞ্জেলা গোমেজ সংসার করেননি। ‘বাঁচতে শেখা’ সংগঠনই এখন এ্যাঞ্জেলা গোমেজের পরিবার, সংসার। ‘বাঁচতে শেখা’র কর্মী, উপকার ভোগীরাই তাঁর পরিবারের সদস্য। এদের নিয়েই এ্যাঞ্জেলার এতগুলো বছর পার হয়েছে। বাকি জীবন ‘বাঁচতে শেখা’ পরিবারের সঙ্গেই তিনি সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় কাটাতে চান। এ্যাঞ্জেলা গোমেজ-এর পুরো জীবনটি যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে এক কথায় বলতে হবে এ এক অদম্য জীবন। প্রথমে পড়াশোনা করতে গিয়ে ছেদ পড়েছে। সেখানেই তার জীবনটি থেমে যেতে পারত। কিন্তু না সেখানে তিনি থেমে থাকেননি। কাজ করতে গিয়ে কর্মজীবনের প্রতি পদক্ষেপে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। সেখানেও তিনি হতাশ হয়ে থেমে যাননি। বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে এগিয়েছেন। বাধা মাড়িয়ে এগিয়েছেন বলেই আজ তিনি আর দশটা জীবন থেকে আলাদা জীবনের অধিকরী এবং দেশে বিদেশে সগৌরবে তাঁর নামটি উচ্চারিত হয়। যে কোন নারীর জন্যই এ্যাঞ্জেলা গোমেজ-এর জীবনটি এক দারুণ প্রেরণার উৎস হতে পারে। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে এই মানুষটির অবদান অসামান্য। আমরা তাঁর সুস্বাস্থ ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
×