ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ ঋতুপর্ণ ঘোষের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন!

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১৪ নভেম্বর ২০১৯

  ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ ঋতুপর্ণ ঘোষের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন!

শুরুতে তাকে নিয়ে দু-কলম না লিখলে সেটা সমীচীন হবে না। আধুনিক বাংলা সিনেমার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ঋতুপর্ণ ঘোষের অসময়ে প্রস্থান- এক কথায়, ‘বাংলা সিনেমা অপরিমেয় ক্ষতির শিকার হয়েছে’। ব্যক্তিগতভাবে ঋতুপর্ণ সত্যজিৎ রায়ের অনুসারি হলেও ক্যামেরার পেছনে থেকে নিজস্ব কায়দায় গল্প বলতেন। প্রখর জ্ঞান ছাড়া এমন স্বকীয়তা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, সিনেমা নির্মাণে তার দীপ্তিময় চিন্তা ছিল। ছিল সার্থকতা! অফসোস, প্রকৃতি মানুষটাকে সময় দিল না। অকালে কেড়ে নিল তার শিল্পাশ্রিত জীবনটাকে। যে সময়ে গত হয়েছেন তখনও চোখে তার নতুন সিনেমার স্বপ্ন। লেখালেখির পাশাপাশি একটার ভেতর থেকে আর একটা ভাবনায় হারিয়ে যাওয়া, চরিত্রের ভেতর থেকে নতুন চরিত্র সৃষ্টি করা, এই যে নান্দনিক খেলা; এসবেই তার জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমান সময়ের টালিগঞ্জ চলচ্চিত্রপাড়ায় যারা নামকরা চিত্র পরিচালক বা অভিনেতা তাদের অনেকেই একটু শক্ত করে বললে, জাতে উঠেছেন এই মানুষটাকে ভর করে । শুনতে একটু তেতো লাগলেও বিষয়টা সত্য। তেমনি একজন চিত্র পরিচালক যিনি বর্তমান সময়ের উজ্জ্বল নির্মাতা হিসেবে যোগ্যতার সঙ্গে সুনাম অর্জন করেছেন। কৌশিক গাঙ্গুলি ব্যক্তিগত জীবেন অনেকবার অবলীলায় বলেছেন তার এই চলচ্চিত্র জীবনে ঋতুপর্ণের অবদান। বিগত সবই ছিল মৌখিক! তবে, সাম্প্রতিক সময়ে এই মৌখিকতা উতরে গুরুদক্ষিণা হিসেবে নির্মাণ করেছেন ঋতুপর্ণের অসমাপ্ত ভাবনা ‘অন্য নায়ক’ থেকে সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র। আগেই উল্লেখ করেছি ঋতুপর্ণ চিন্তার গভীরে থেকে আর একটা চিন্তার জন্ম দিতেন। বিশেষ করে যেসব চিন্তা তার হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করত। বাবা মারা গেছেন, ঋতুপর্ণ গেলেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। মরা বাড়িতে যখন জ্যেষ্ঠপুত্রের আগমন ঘটল তখন উপস্থিত সকলে বিয়োগব্যাথা ভুলে নামকরা চিত্র পরিচালকপকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ছোটভাই উলুখাগড়ার মতো দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখলেন-ব্যক্তিগত জীবনে এমন উপলব্ধি থেকে ‘অন্য নায়ক’ নামে একটি সিনেমার চিত্রনাট্য ভাবতে শুরু করেন। চিন্তা যখন গভীরে বাসাবাধে তখন চিত্রনাট্যের কিছু অংশ লিখতে শুরু করেন । হঠাৎ কোন পূর্বাভাস ছাড়া ঋতু কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। ব্যক্তিগত সাহচর্যের খাতিরে এই গল্পের আংশিক কৌশিক জেনেছিলেন। নিজের জীবনে যখন এমন ঘটনা পুনশ্চ ঘটে তখন কৌশিকের ভেতর ঋতুর ফেলে যাওয়া চিন্তার রশ্মি জ্বলে ওঠে। খোঁজ নেন ঋতুপর্ণের ছোটভাই ইন্দ্রনীল ঘোষের কাছে, কোন অসম্পূর্ণ দলিল! খুঁজে পাওয়া গেছে কয়েকটা দৃশ্যের অসমাপ্ত অংশ। যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে এবং চিন্তার স্বাধীনতা দিয়ে কোন রকম স্বত্ব ছাড়াই ইন্দ্রনীল অনুমতি দেন ঋতুপর্ণের অসম্পূর্ণ চিন্তা সম্পূর্ণ করার... এবার গুরুদক্ষিণার পালা। কৌশিক নির্মাণ করেন ‘অন্য নায়ক’ থেকে ‘ জ্যেষ্ঠপুত্র’। অভিনয় শিল্পী হিসেবে নিয়েছেন সেই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে, যে কিনা নিজেকে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা ঋতুপর্ণের কাছ থেকে শিখেছেন। সঙ্গে বর্তমান সময়ের অভিনয় শিল্পের বিদ্যুত রশ্মি ঋত্বিক চক্রবর্ত্তি। এদের সঙ্গে অনেক নামকরা শিল্পী আছেন যাদের আলাদা আলাদা বিশ্লেষণে গেলে লেখার দৈর্ঘ্য ঠিক রাখা যাবে না। এবার আসি কৌশিক গাঙ্গুলির জ্যেষ্ঠপুত্রের কাথায়। মূলত এই সিনেমা দেখে আবেগ তাড়িত ব্যথা অনুভূত হয়। গল্পের প্লটটা আগে থেকেই জানতাম। যখন জ্যেষ্ঠপুত্র দেখছিলাম তখন কেবল ঋুুতপর্ণকে খুঁজছিলাম। কোথায় ঋতুর ছায়া। সত্যি বলতে, ছায়া আমি পাইনি যা পেয়েছি তা কৌশিকে আলো। কেবল একটা জায়গায় সাদৃশ্য! চরিত্রগুলো সিগারেটের আগুন দিয়ে অহর্নিশ নিজেদের পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা। চলচ্চিত্র মুক্তির আগে প্রমোশনাল এক সাক্ষাতকারে প্রসেনজিৎ বলেছিলেন, এটা কৌশিকের অন্যতম একটা ভাল কাজ। কথা সত্যি। যখন পুরো সিনেমায় বড়ভাই ছোটভাইয়ের পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক, চিরাচরিত বাঙালীর সজীব আবেগ। এসবের সঙ্গে অভিনয় শক্তি দিয়ে বধ করা দুই পাকা খেলোয়াড়ের কৌশলী জাদু- কৌশিক দারুণ বুদ্ধিদীপ্তের পরিচয় দিয়ে আবারও ঋতুপর্ণকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। সত্যি, গল্পের গভীরতা থেকে চরিত্রের গভীরতা অনেক সময় সিনেমার থেকেও বড় করে দেয়। জ্যেষ্ঠপুত্র আসলে তেমনি সিনেমা আর প্রসেনজিৎ এবং ঋত্বিক সেটা করে দেখিয়েছেন। দিন শেষে কৌশিক নিজেকে যোগ্য শিষ্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং নিজের নামের দিপশিখা জে¦লেছেন।
×