ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রজন্মের আদর্শের বাতিঘর- জীবন্ত কিংবদন্তি

প্রকাশিত: ১২:০৬, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

প্রজন্মের আদর্শের বাতিঘর- জীবন্ত কিংবদন্তি

সমুদ্র হক ॥ প্রজন্মের আদর্শের বাতিঘর তিনি। টিনের ছাপড়ার নিচে ইটের ওপর সিমেন্টে প্রলেপ। বৃষ্টির দিনে ঘরের ভেতরে বালতি রাখতে হয়। ছাদে ওঠার জন্য বাঁশের মই। তিনি ও পরিবারের সদস্যরা এখন চৌকির ওপর ঘুমায়। যেগুলো কোন রকমে খাটের মতো করা হয়েছে। আসবাবপত্র বলতে হাতেগোনা কয়েকটি চেয়ার ও টেবিল। কিছু অর্ধভাঙ্গা। অতিথিদের বসবার ছোট্ট ঘরে পুরনো আমলের একটি হাতল বেঞ্চ। দুটি আলমারি। তারও কয়েক খোপের কাঁচ ভাঙ্গা। ভেতরে কিছু ওষুধ। স্তূপ হয়ে আছে খবররে কাগজ। ইটের গাঁথুনির পলেস্তারা খসে পড়ছে। বগুড়া শহরতলির নারুলী এলাকায় চারদিকে যখন বহুতল ভবন তখন এমন বাড়ি দেখে ও ভেতরে গিয়ে মনেই হবে না বর্ষীয়ান এই নেতা বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডাঃ মকবুল হোসেন। বয়স ৮৫ উত্তীর্ণ। বয়স তাকে কাবু করতে পারেনি। এই বয়সেও তারুণ্য ধরে রেখেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দলীয় সমাবেশে তিনি যোগদান করেন। অফিসিয়াল কাজ ছাড়া গাড়ি ব্যবহার করেন না। তাকে দেখা যায় হেঁটে গিয়ে দোকান থেকে ওষুধ কিনতে। আশপাশের লোকজন শ্রদ্ধায় ন্যুয়ে পড়ে। যারা তাকে চেনে না তারাও পরিচয় জেনে বিস্মিত হন। তার অন্যতম একটি কারণ হলোÑ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার নামে যখন দুর্নীতির খবরাখবর বের হচ্ছে তার পাশে তিনি একেবারেই উল্টো চিত্র। প্রচার বিমুখ মানুষ তিনি। কেউ তাকে নিয়ে কিছু লেখেনি। উত্তর জনপদের জীবন্ত কিংবদন্তি ডাঃ মকবুল হোসেনের রাজনীতিতে হাতে খড়ি কিশোর বেলায়। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারিতে সক্রিয়। ১৯৫২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বগুড়ায় সাংগঠনিক সফরে এলে তিনি সঙ্গে ছিলেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এসেছিলেন তৎকালীন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান খান, রংপুরের মতিউর রহমান, ছাত্রলীগের সভাপতি কামরুজ্জামান। ওই দিন বগুড়ায় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলে তিনি সদস্য নির্বাচিত হন। তখন তিনি বগুড়া ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুলের শিক্ষার্থী। শিক্ষাজীবন শেষে লাহিড়ীপাড়া নিজ গ্রামে চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। ৫৪ সালে চারআনা (২৫ পয়সা) দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হন। হেঁটে হেঁটে গ্রামে গিয়ে সদস্য সংগ্রহ করেন। চার আনায় অনেকে সদস্য হন। সদস্য বইয়ের মুড়িসহ সংগ্রহের অর্থ তৎকালীন সভাপতি মোশারফ হোসেন ম-লের হাতে তুলে দেন। সেই থেকে আজ অবধি তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে বড় ভূমিকা রাখেন। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বগুড়ায় জনসভার প্রচার করতে তিনি দলের অন্য সদস্য নিয়ে টমটম গাড়িতে মুখে টিনের চোঙ্গা ফুঁকে প্রচার করেন। দলের নেতাকর্মীরা চাঁদা তুলে টমটমের ভাড়া পরিশোধ করে। ১৯৬২ সালে তিনি শহরের চেলোপাড়ায় এসে প্রথমে একটি ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেন। ওই বছর তিনি সাবগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর সদরে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। কমিটিতে তিনি সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। সত্তরের দশকে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক হন। এরপর ৫টি কাউন্সিলে তিনি সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের মৃত্যুর পর ডাঃ মকবুল হোসেন সভাপতির হাল ধরেন। সেই থেকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সব লোভ লালসার উর্ধে উঠে বগুড়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তার সততা ও দেশ প্রেমের পুরস্কার দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে বগুড়া জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ দেন। পরে শেখ হাসিনা তাকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেন। সেই থেকে তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত উন্নয়ন কাজের অগ্রগতিসহ জেলা পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করছেন তিনি। বিশ্ব অনেকের বিরাগভাজনও হয়েছেন। কারণ সরজমিনে না গিয়ে না দেখে তিনি কোন প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেন না। নিজে গিয়ে সেই সমস্যা দেখে ও বুঝে প্রয়োজন অনুযায়ী জেলা পরিষদ থেকে বরাদ্দ দেন। তারপর তিনি দেখেন ঠিকমতো কাজ হচ্ছে কি না। উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি দলীয় কর্মকা-েও তিনি সমানভাবে অংশ নিচ্ছেন। সততার কারণে বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে হয়। যেমন আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ে যে সম্মেলন হচ্ছে সেখানে কখনও ব্যানারে প্রধান অতিথির স্থানে তার নাম লিখার পরও মুছে ফেলা হয়। কখনও সভাপতি না করে উদ্বোধক করা হয়। এ জন্য তিনি ব্যথিত হন। এই বিষয়ে তিনি বলেন ‘যারা এই কাজ করছে তারা কি জানে জোর করে পদ পাওয়া গেলেও মানুষের ভালবাসা পাওয়া যায় না।’ সোমবার সকালে তার বাড়িতে গেলে দেখা যায় ছোট্ট এক ঝুপড়ি মতো ঘরে তিনি পত্রিকা পড়ছেন। লোকজন তেমন নেই। বললেন তার জীবনের কথা। রাজনীতির কথা। এ সময় তার সামনে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু। জেলা আওয়ামী লীগে সততা ও আদর্শের উদাহারণে একজন বর্ষীয়ান (মকবুল হোসেন), আরেকজন তার পদাঙ্ক অনুসরণের তরুণ (রাগেবুল আহসান রিপু)। মকবুল হোসেন বলেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সুষম উন্নয়নে বিশ্বাসী বলেই বগুড়া উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে নেই। প্রয়াত নেতা মমতাজ উদ্দিনের কথা স্মরণ করে বলেন, বগুড়ায় মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই....’ গান বাজলে তিনি শিহরিত হন। তিনি জেলা পরিষদের মাধ্যমে উন্নয়নে স্বাক্ষর রাখতে চান। শহরতলির নারুলীতে সাড়ে তিন শতাংশ ভূমির ওপর একটি বাড়ি করেছেন। বাড়ি দেখলে মনে হবে না একজন নেতার বাড়ি। এখন আর রোগী দেখেন না। স্ত্রী, ১ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে সংসার। প্রধানমন্ত্রী তাকে মূল্যায়ন করেছেন তা তিনি কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করেন। বললেন, যতদিন বেঁচে আছেন কাজ করে যাবেন। এত বছর বয়সেও তিনি জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেয়ার মতো সাহস রাখেন। সততার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখে বর্তমানের তরুণ তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বললেন এটাই তার বড় প্রাপ্তি। সৃষ্টিকর্তা যতদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন ততদিনে কোন কালিমা যেন স্পর্শ না করে।
×