ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

তাজমহলের নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

তাজমহলের নেপথ্যে

মুঘল সম্রাট শাহ্জাহানের অমর কীর্তি তাজমহল। বিশ্বসভ্যতায়ও এর ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্য আজও অত্যাশ্চর্য এবং অতুলনীয় এর নির্মাণ শৈলী। ফরাসী পরিব্রাজক এবং চিকিৎসক বার্নিয়ার তার ভ্রমণ কাহিনীতে উল্লেখ করতে দ্বিধা করেননি, পাথরের স্তূপাকার পাহাড়সম মিসরের পিরামিডের চাইতে এই অম্লান স্থাপত্য ঐশ্বর্য তাজমহল অনেক বেশি দর্শনীয় এবং চমকপ্রদ। অনেক ইতিহাসনির্ভর তথ্য-উপাত্ত। সমকালীন ঐতিহাসিকদের অভিমতকেও সমধিক গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এই স্থাপত্যসৌধ তাজমহল সম্পর্কে বর্ণনা উল্লেখ করতে চাই। ‘শাহ্জাহান’ কবিতায় কবির অনুভব- হীরা মুক্তা মাণিক্যের ঘটা/ যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাত ইন্দ্রধনুচ্ছটা/ যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক/ শুধু থাক/ এক বিন্দু নয়নের জল/ কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/ এই তাজমহল। হীরা, মুক্তা মাণিক্যখচিত এই তাজমহল আজও কালের সাক্ষী হয়ে ভালবাসার শৌর্যে সপ্তদশ শতাব্দীর অবিনশ্বর স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শনে ঐতিহাসিক সম্পদকে কাল থেকে কালান্তরে পৌঁছে দিচ্ছে। প্রিয়তমা পতœী মমতাজ মহলের সমাধিস্থলে নির্মিত এমন অপূর্ব শৈল্পিকশৈলী স¤্রাটের শোকাভিভূত মর্মবেদনার অনবদ্য রূপশৌর্য, যা শৈল্পিক বৈভবের অভাবনীয় সম্ভার ছাড়াও মুঘল সাম্রাজ্যের স্থাপত্য নির্মাণের এক অনুপম সম্পদ। যার আর্থ-সামাজিক এবং ঐতিহাসিক মূল্যমান স্থাপত্যকলার অভিনব সংযোজন। যা শাহ্জাহানের অন্তরনিঃসৃত বেদনার এক বিষাদঘন প্রাসাদ। সত্যিই তাজমহলের সামনে দাঁড়ালেই স্ত্রী মমতাজ নয়, সামনে হাজির হন মুঘল অধিপতি স¤্রাট শাহ্জাহান। এখন অবধি তাজমহল দেখতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা কয়েক কোটি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল এবং সারা বিশ্বের অসংখ্য পর্যটক প্রতি বছরই তাজমহলের সৌন্দর্য অবলোকনে এই অমর ঐশ্বর্যের সামনে হাজির হয়। এই অসাধারণ শিল্প নির্মাণে যে পরিমাণ অর্থ এবং সময় ব্যয় করা হয়েছে, তাও বিশ্বের বিস্ময়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাজমহল দর্শনে তার অভিব্যক্তিতে অভিভূত। বলেছেন- আগ্রায় এসে তাজমহল দেখে অনুভব করলাম বিশ্বের তাজ যেন আমার সম্মুখে হাজির। তাজের একটি মিনারে উঠে সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে মনে হলো পশ্চিম দিকে রক্তিম রবি আকাক্সক্ষা রাঙিয়ে দিয়ে অস্তায়মানের সন্ধিক্ষণে। নীল যমুনার অপার জলরাশির তীরে শুভ্র তাজ তার সমস্ত সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্য নিয়ে পূর্ণচন্দ্র থেকে পৃথিবীতে আলো বিকিরণ করছে। মহর্ষির বর্ণনায় এতটুকু খাদ নেই, যা দেখেছেন অত্যন্ত সুললিত ভাষায় তার বর্ণনা দিতে কসুর করেননি। আসলে সূর্য ডোবার সময় তাজমহলের অপার রূপময়তা লাল আলোর আভায় যথার্থ রাঙিয়ে ওঠে। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৫-৩০-এ অস্তমিত রবির শেষ কিরণে তাজমহলকে দেখে সমস্ত বৈভব নিয়ে উপভোগ করার। শুধুই কি রূপ সম্পদ। চোখে ভাসছে মুঘল সা¤্রাজ্যের শাসনামলের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাপরম্পরা। এত বড় অবিভক্ত ভারতের অধিপতিরা কিভাবে রাজ্য পরিচালনার মাঝেও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের দিকে নজর দিতেন! তাজমহল দেখার আগে রাজস্থানের জয়পুরে রাজা মানসিংহ ও জয়সিংহের মহল দেখে আসার অভিজ্ঞতাও ছিল ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞের এক অভাবনীয় নির্মাণ সৌধ। দর্শনীয় তো বটেই, এর আর্থ-সামাজিক ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। তৎকালীন ভারত ঈশ্বরদের সৌন্দর্য অনুভব, রাজকোষে জমাকৃত অর্থের বিনিয়োগ শ্রমিকদেয় শ্রমসাধনার নির্মিত মহলগুলো অনন্য নিদর্শন হয়ে সৌন্দর্য বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ইতিহাসে বিধৃত আছে, এই জয়পুরের জয়সিংহই আগ্রায় তাজমহল নির্মাণের জন্য শাহ্জাহানকে তার নিজস্ব জায়গা উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স¤্রাট বলে কথা। গ্রহণের চাইতেও দিতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। তাই বিনিময়ে শাহ্জাহান অন্য ভূমি জয়সিংহকে দেন বলে লোকমুখে এখনও প্রচলিত। প্রায়ই ২২ বছর ধরে ২০ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল আগ্রার এই তাজমহল। স¤্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের সমাধিস্থলে নির্মিত এই অপার সৌন্দর্যের সমাহার তৎকালীন স্থাপত্য নিদর্শনেরও এক অবিস্মরণীয় চিত্র। তবে তাজমহলের নির্মাণ কৌশল প্রচলিত স্থাপত্য সৌন্দর্যের আদলে তৈরি করা হয়নি। দেশ-বিদেশের অনেক বিজ্ঞ ও খ্যাত স্থাপত্যশিল্পীর নির্মাণ কৌশলের বহু নির্দেশনা থেকে এই অনন্য রূপশৌর্যটি প্রস্তুত করা হয়। কথিত আছে, ১৬৩০ সালে বাদশা শাহ্জাহান তার রাজমহল থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে দাক্ষিপাত্যের এক শহর বুরহানপুরে যান। কোন বাদশাই একা কখনও সফরে বের হন না। হাতি, ঘোড়া সমন্বয়ে অনেক লোক-লস্কর, সৈন্য-সামন্ত থাকে রাজার ভ্রমণসঙ্গী। সেখানে প্রিয়তমা মহিষীও ভারত-বাদশাকে সঙ্গ দিতে কসুর করতেন না। এই সফরে শাহ্জাহানের প্রিয় স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম, যিনি মমতাজ মহল নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন, তিনিও শাহেন শাহের সঙ্গী হন। যে বুরহানপুরে শাহজাদা খুররম এবং বেগম মমতাজ তাদের যৌথ জীবনের অনেকটা সময় পার করেন এই অঞ্চলের সুবেদার থাকাকালীন। তেমন স্মৃতিও তাদের অভিভূত করে। রাজা-বাদশাদের অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদ, যুদ্ধ অভিযান সে সময়ের স্বাভাবিক সংগ্রামী অভিযাত্রা ইতিহাসের অনবদ্য দলিল। স্মৃতিবিজড়িত এমন জায়গায় এসে দুজনেই আনন্দ আর আবেগে আপ্লুত হন। কিন্তু মমতাজ তখন ছিলেন সন্তানসম্ভবা। কয়েকদিনের ফারাকে মমতাজ প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির হলে প্রসূতির চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন হেকিম উজির খান। সে ঘটনা আজও লোকমুখে প্রচলিত। রাজা-বাদশারা যতই অন্তর্মহলে থাকুন না কেন, রানীদের জন্য আলাদা ভবনের নির্মাণ তেমন আড়াল-আবডালের মধ্যেও ভেতরের সাড়া জাগানো ঘটনা জনসম্মুখে আসতে বেশি সময় লাগত না। মমতাজের সেই সময়ের অন্তর ও প্রসব যন্ত্রণাও মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় রানীর পাশে ছিলেন বাঁদী সতিউন্নীসা ও পাৎসা। মায়ের প্রসব যন্ত্রণাকে তীব্রতর করে কন্যা সন্তানটি নাকি গর্ভেই কান্না শুরু করে দেয় ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে। মায়ের জঠরে কান্না নাকি জন্মদাত্রীর অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসারই লক্ষণ। মমতাজ আগেই ১২ সন্তানের জননী ছিলেন। শেষ এবং ১৩তম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে দুঃসময় নেমে আসে। অন্তিম সময় উপস্থিত হলে মমতাজ প্রিয়তম স্বামীর দর্শনে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। উনিশ শতকের ক্রান্তিলগ্নে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের মধ্যে বিস্ময়কর এই তাজমহলের ভিত্তি স্থাপনের কাহিনী বিধৃত থাকে। সর্বশেষ কন্যা সন্তান গৌহর আরার জন্মলগ্নে বেগমের অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসলে স্বামীকে স্বীয় শয্যার পাশে উপবিষ্ট করে শেষ মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার আকুতি জানান। এই মর্মে কর্নেল আরপি এন্ডারসন কর্তৃক হাতে লেখা একটি ফরাসী গ্রন্থে অসামান্য ঘটনাটি প্রকাশ পায়। শেষ প্রস্থানের আগে ভারতের রাজাধিরাজের প্রিয়তম জীবনসঙ্গী মমতাজ তার সমাধির ওপর একটি অনন্য সৌধ নির্মাণের আকুতি জানান। এছাড়া আরও একটি আর্জি ছিল বেগমেরÑ অন্য কোন রানীর গর্ভে সম্রাটের যেন আর কোন সন্তান না জন্মায়। তাহলে নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদে কেউই সুখ-শান্তির মুখ দর্শন করতে ব্যর্থ হবে। কথিত আছে, মমতাজের পরকালের যাত্রার অনতিবিলম্বে সম্রাট নিজের কক্ষে প্রবেশ করে সেই যে ঘরের অর্গল তুলে দিলেন পুরো আট দিন সেই রুদ্ধদ্বার আর খোলেননি। অনেক ইতিহাসবিদের বর্ণনায় আছে, ৮ দিন পর যখন নিজ থেকেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন যেন এক অন্য অপরিচিত শাহজাহান। কৃষ্ণ কেশরাশি শ্বেতশুভ্র সাদায় সম্রাটকে মাত্র আট দিনেই বয়োবৃদ্ধ করে দেয়। দীর্ঘাকৃতি সম্রাট যেন উচ্চতায়ও অনেকটা খাটো হয়ে গেছেন। প্রথম দেখাতে সবাই দৃষ্টিভ্রম মনে করলেও পরবর্তীতে সেটাই যে ধ্রুব সত্য তা প্রমাণ হতে সময় লাগেনি। ইতোমধ্যে মমতাজকে সমাধিস্থ করা হয় তাপ্তি নদীর পাড়ে প্রাচীরঘেরা মুঘলদের নিজেদের বাগানে। ঘর থেকে বের হয়ে পতœীর সমাধির পাশে গিয়ে নয়নের জলে ভেসে গেলেন তিনি। রাজা-বাদশার জাঁকজমক পোশাক পরিত্যাগ করে হাল্কা সাদা রঙকে পরিধানের যোগ্য মনে করেছিলেন। সেইভাবে অতি সাধারণ বেশে নিজেকে পতœীশোকে কাতর করে তোলেন। এক সময় সম্বিত ফিরে পেয়ে বেগমের অন্তিম বাসনায় মনোসংযোগ করলেন। অনিন্দ্যসুন্দর এক সমাধি সৌধ নির্মাণে দেশ-বিদেশের স্থপতিদের সম্মেলন করলেন। আগ্রায় এসে শুরু করলেন তার তোড়জোড়। সারা পৃথিবী থেকে নক্সাকর ও স্থপতিদের ভিড় জমতে থাকে। সমাধি মহলের কাঠামোর নক্সা পছন্দ করতেও সম্রাটকে অনেক ভাবতে হয়েছে। শুধু কোন একজনের একক কৃতিত্বে তাজমহলের এই অনন্য সৌধ নির্মিত হয়নি। যদিও ইতিহাসে ওস্তাদ ঈশা খাঁর নাম লিপিবদ্ধ আছে। বেশ কয়েকজনের নক্সার আদলকে সমন্বিত করে তাজমহলের গঠনশৈলীর মূল রূপরেখা নির্ণয় করা হয় বলে বহু তথ্যে বিধৃত আছে। তবে প্রধান স্থপতির ভূমিকায় ঈশা খাঁর নামই এখন অবধি লোকমুখে প্রচলিত। নয়নাভিরাম এই তাজমহলের নির্মাণশৈলিতে যেমন সারা পৃথিবীর বহু ঐতিহ্যের স্থাপনা দৃশ্যমান হয়, পাশাপাশি ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতির সরাসরি প্রভাবও এই সমাধি সৌধের অন্যতম শৌর্য। ২০ হাজার দক্ষ শ্রমিক যাদের অনেকেই তুর্কী, পারস্য, ইরানসহ আরও মধ্য এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী জায়গা থেকে এসে এই নির্মাণে অংশ নেয় বলে জানা যায়। এই অসাধারণ সৌন্দর্যম-িত সমাধিসৌধটি তৈরি করতে প্রায় ২২ বছর সময় লাগে। যার কারণে আগ্রার তাজমহলের চারপাশে নির্মাণ শ্রমিকদের একটি বৃহদাকার আবাসস্থলও গড়ে ওঠে। তাদের উত্তরসূরিরা এখনও আগ্রার বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে ভারতবর্ষে টিকে আছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় তাজমহলের পরিচর্যা, সংস্করণের জন্য এসব উত্তরাধিকারকে এখনও কাজে লাগানো হয়। ১৬৩২ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৬৫৩ পর্যন্ত এর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। নির্মাণ শুরুর আগে মমতাজমহলের শবদেহ আগ্রায় স্থানান্তর করা হয়। তার ওপরেই নির্মিত হয় এই অনবদ্য প্রেমের চমৎকার স্থাপনা। এর নির্মাণ সামগ্রীর মণি, মুক্তা, দামী পাথরও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা যেমন বাগদাদ, বসরা, ইয়েমেন, মিসর, তিব্বত, কান্দাহার প্রভৃতি ঐতিহ্যবাহী স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয় বলে নথিপত্রে উল্লেখ আছে। তাজমহলের সাদা মর্মর পাথরের শৈল্পিক গড়ন এই নয়নাভিরাম সমাধিস্থলকে মুঘল স্থাপনার অন্যান্য নিদর্শন থেকে আলাদা এবং ব্যতিক্রমী মাত্রা দিয়েছে। এর যথাযথ এবং সময়োপযোগী সংস্করণ পরিমার্জন ও শৈল্পিক সুষমার আধুনিক প্রলেপ সমৃদ্ধ সৌধটিকে এখনও তার নিজস্ব গঠনশৈলীর অবয়বে অক্ষয়, অবিনশ্বর এবং চিরস্থায়ী সৌন্দর্যের মর্যাদা দিয়ে যাচ্ছে। লেখক : সাংবাদিক
×