ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের আসন্ন জাতীয় সম্মেলন প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

আওয়ামী লীগের আসন্ন জাতীয় সম্মেলন প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সেকালের মানুষ জঙ্গল সাফ করতে গেলে অনেক বুড়িয়ে যাওয়া গাছ কেটে ফেলত। কিন্তু বটগাছ যত পুরনো ও বুড়ো হোক সে গাছ কাটত না। বটগাছ প্রখর রোদে ছায়া দেয়, ঝড় বৃষ্টিতে মানুষকে আশ্রয় দেয়। আবার তার পাতা পূজায় লাগে। ভারতের কংগ্রেস দল, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ এই প্রাচীন ও বৃদ্ধ বটগাছের মতো। এদের দেহে গাছা-পরগাছা গজিয়েছে। দু’দেশের দু’টি দলের অবস্থাই বৃদ্ধ বটগাছের মতো। এদের সংস্কার প্রয়োজন, সংহার নয়। আগামী মাসে (ডিসেম্বরে) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে একুশতম জাতীয় সম্মেলনের তোড়জোড় চলছে সে উপলক্ষেই ওপরের কথাগুলো লিখলাম। নেহেরু জীবিত থাকতেই ভারতের কংগ্রেসে একটি বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছিল। কংগ্রেসের একজন নেতা কামরাজকে দিয়ে নেহেরু এই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করায় এর নাম হয়েছিল কামরাজ পরিকল্পনা। কামরাজ ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। কামরাজ পরিকল্পনার মূল কথা ছিল, দলের বৃদ্ধ, বিতর্কিত নেতা ও মন্ত্রীদের স্বেচ্ছায় সরে যেতে হবে এবং তরুণ নেতৃত্বকে জায়গা করে দিতে হবে। এই পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করে তেমন ফল পাওয়া যায়নি। কংগ্রেসে যে নতুন নেতারা এলেন তারা অধিকাংশই ছিলেন রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের ভাবমূর্তিতে ভাঙ্গন ধরে। নেহেরু তার একক ব্যক্তিত্ব দ্বারা দলকে খাড়া রেখেছিলেন বটে, কিন্তু তার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার প্রখর ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও দলের ঐক্য ধরে রাখা যায়নি। কংগ্রেসের বৃদ্ধ নেতারা জোট বেঁধে বিদ্রোহ করেন। তারা গঠন করেন আদি কংগ্রেস। ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেসের যে অংশটি থাকে তার নাম হয় ইন্দিরা কংগ্রেস। এই ইন্দিরা কংগ্রেস এখনও টিকে আছে। কিন্তু তার অবস্থা খুব ভাল নয়। পরিবারতন্ত্র (নেহেরু-গান্ধী ডায়নেস্টি) এখন কোন কাজ দিচ্ছে না। নেহেরুর অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতন্ত্রী আদর্শের ঘোর শত্রু হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি এখন ভারতের দ-মু-ের কর্তা। ভারতের কংগ্রেস ও বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক মিল থাকা সত্ত্বেও এখানেই বড় অমিল। নেহেরুর মৃত্যুর পর কংগ্রেস যেমন ভাগ হয়েছে, শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ তেমন ভাগ হয়নি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেই তার দলের বৃদ্ধ নেতারা যেমন আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান প্রমুখ দলত্যাগ করেন। তারাও পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠনের চেষ্টা করেছিলেন, সফল হননি। ফলে শেখ হাসিনাকে দলের বৃদ্ধ নেতাদের নিয়ে ইন্দিরার মতো কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। তাকে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল দলের মাঝবয়সী নেতাদের নিয়ে। কিন্তু এই মাঝবয়সী নেতাদেরও না আছে সাহস, না আছে ব্যক্তি-ক্যারিসমা। শেখ হাসিনা যখন খুশি এদের ব্যবহার করেছেন। আবার দূরে ঠেলে দিয়েছেন। যেমন এবারেও দিয়েছেন। হাসিনা-নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস এদের নেই এবং মুরোদও নেই। একবার এক এগারোর সামরিক কর্তাদের মাইনাস টু থিয়োরি সফল করার জন্য এদের কেউ কেউ সন্তর্পণে সক্রিয় হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তাদের ঠা-া করে দেন। এবারেও হাসিনা তাদের দূরে ঠেলে দেয়ার পর তারা নিশ্চুপ নীরবে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করছেন এবং হাসিনার জন্য প্রকাশ্যে কোন সমস্যা সৃষ্টি করছেন না। কিন্তু শেখ হাসিনার সমস্যা অন্যখানে। আওয়ামী লীগ দলটি কংগ্রেসের মতোই এতো বুড়ো বটগাছ হয়েছে যে, গাছটিতে আগাছা পরগাছা বেড়েছে বেশি। এই বটগাছটিকে সংস্কার করতে শুধু গাছা-আগাছা দূর করা নয়, অনেক ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। খবরে বলা হয়েছে, আসন্ন সম্মেলনে শেখ হাসিনা এই কাজটিই করতে চান। দলের জাতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে বড় পরিবর্তন আনা হবে। বর্তমান কমিটির অন্তত এক তৃতীয়াংশ নেতা বাদ পড়তে পারেন। নিষ্ক্রিয়, বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতাদের কমিটিতে স্থান দেয়া হবে। আওয়ামী লীগের এই নবতর পর্যায়ের শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই দেশে অভিনন্দিত হয়েছে। শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশে সব চাইতে ক্ষমতাধর রাজনীতিক। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে তো বটেই, তিনি নিজের যোগ্যতা ও নেতৃত্বগুণ দ্বারা দেশের অবিসম্বাদিত নেতা হয়েছেন। দলের ভেতরেও তার কথাই শেষ কথা। এ জন্যই এই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনায় অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। যে বন্দুক তিনি হাতে নিয়েছেন তা যেন ব্যাক ফায়ার না করে। গত সাধারণ নির্বাচনের আগে ঢাকার এক সভায় আমি দাবি করেছিলাম, নির্বাচনে পুরনো সংসদের দলীয় আশি ভাগ সদস্য যেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পায়। কিন্তু তারা সকলেই নমিনেশন পেয়েছেন এবং এমপি হয়েছেন। এই এমপিদের এক বিরাট অংশ (সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই) নব্য ব্যবসায়ী এবং তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বড় বড় অভিযোগ রয়েছে। এদের ক্ষমতা এলাকা বিশেষে মন্ত্রীর ক্ষমতার চাইতেও বেশি। এই অবস্থায় জাতীয় সংসদকে এড়িয়ে গিয়ে অধিকাংশ নতুন মুখ দ্বারা মন্ত্রিসভা গঠন এবং দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে নতুন সদস্য গ্রহণ দ্বারা কি দল ও দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে? আমি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষী। তাই সভয়ে ও সবিনয়ে এই প্রশ্নটা তুলছি। দল যদি শক্তিশালী না হয়, দলের মন্ত্রিসভায় যদি বেশিরভাগ অনভিজ্ঞ মন্ত্রী থাকে, তাহলে আমলাতন্ত্রের শক্তি বৃদ্ধি পায়। এই আমলাচক্রের একটা বড় দুর্নীতিবাজ অংশ মুখে ক্ষমতাসীন সরকারকে আনুগত্য দেখায়, গোপনে তক্কে তক্কে থাকে কখন সরকারকে ছোবল মারবে। ইন্দিরা গান্ধী এই ভুলটি করেছিলেন। অধিকাংশ প্রবীণ নেতাকে তাড়িয়ে ইন্দিরা-কংগ্রেস গঠনের পরও তিনি কংগ্রেসে নতুন রক্ত সঞ্চালনের নামে ‘জো হুজুর’ সদস্য বেশি বেশি করেছিলেন। দলকে উপেক্ষা করে প্রভাবশালী আমলাদের দ্বারা বেশি পরিবেস্টিত ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন ডিপি ধর থেকে শুরু করে কয়েকজন প্রভাবশালী আমলা। তাদের যুদ্ধকালীন পরামর্শ ছিল সঠিক। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের সময় এই আমলা পরামর্শদাতাদের অনেকের মধ্যে আধিপত্যবাদী মনোভাব দেখা দেয়। তারা যে বাংলাদেশ-নীতি অনুসরণ করেন তা দেশটিতে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দাদের ষড়যন্ত্র সফল করার কাজে সহায়ক হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হন, এমনকি নিজেও নির্বাচনে এক অখ্যাত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। তিনি যখন এই বিপর্যয়ে কাতর হয়ে ভারতের বয়োবৃদ্ধ জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে কাঁদছিলেন, তখন জয়প্রকাশ নারায়ণ তাকে বলেছিলেন, তুমি আমলাদের পরামর্শ দ্বারা চালিত হয়ে এবং রাজনীতিকদের পরামর্শ না শুনে ভয়ানক ভুল করেছ। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান শুদ্ধি অভিযানে আমি আনন্দিত। কিন্তু মনে বড় ভয়। শেখ হাসিনাকে পরামর্শদানের উপদেষ্টা পরিষদ বেশিরভাগ সাবেক আমলা ও টেকনোক্র্যাট দ্বারা ভর্তি। এই সদস্যদের কারও কারও চরিত্র ‘ফুলের মতো পবিত্র’, এরা মন্ত্রিসভার চাইতেও ক্ষমতাশালী। ডাঃ দীপু মনি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন গওহর রিজভি প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র সংক্রান্ত উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তখন মন্ত্রী না উপদেষ্টা বেশি ক্ষমতাশালী, তা বোঝা যেত না। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘এতদিন যারা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাদেরও রাখা হবে না নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে।’ তাতে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় না হয়। দেশের রাজনীতি থেকে অর্থনীতি সব কিছু এখন ব্যবসায়ীদের কবলে। টাকা ও বাহুবল যাদের বেশি তারাই এখন ক্ষমতার সর্বত্র। জাতীয় সংসদে কত পার্সেন্ট সদস্য নব্য ব্যবসায়ী তার হিসাব নিলেই দেখা যাবে, আমাদের জাতীয় সংসদও নব্য ব্যবসায়ীদের দ্বারা অধিকৃত। সবগুলো রাজনৈতিক দল দখল করেছে অথবা প্রভাবিত করে রেখেছে নব্য ব্যবসায়ীরা। এদের কবল থেকে দেশের রাজনীতিকে মুক্ত করা একটি বিপ্লবের ব্যাপার। এই বিপ্লব এখন ঘটানো যাবে না। এই নব্য ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে ছাঁটাই-বাছাই করে শেখ হাসিনাকে তুলনামূলক সৎ ব্যবসায়ী, যারা বিত্তশালী এবং রাজনীতিতে আসতে চান বা এসেছেন তাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। দেশে ধোয়া তুলসীপাতার মতো রাজনীতিক এখন তরুণ সমাজেও পাওয়া যাবে না। জিয়া-এরশাদ-খালেদা গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে দূষিত করে গেছেন। এই দূষণ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের নীতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু তা পারা কি এখন সম্ভব? আমার কথা, শুদ্ধি অভিযান, যা সম্প্রতি শুরু করা হয়েছে, তা সফল করতে হলে মালয়েশিয়ার মাহাথিরের মতো আমলাতন্ত্রের ঘাঁটিতে একই সঙ্গে হানা দিতে হবে। রাজনীতিকরা চুনোপুঁটি। দুর্নীতির আসল ঘাঁটি আমলাতন্ত্রের ভেতরে। এখানে হাত দিতে না পারলে শুদ্ধি অভিযান সফল করা কষ্টকর হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা রাজনীতিকদের হাতে নেই। প্রকৃত ক্ষমতা আমলাতন্ত্র এবং দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের হাতে। এদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা দরকার। তাহলে দলও দুর্নীতিমুক্ত হবে। নইলে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন মুখ এলেও দেখা যাবে এই তারুণ্যও কীটদুষ্ট। কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের পর জাতীয় নীতিনির্ধারণে তাদের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে যাতে মন্ত্রী বা এমপিরা কেন্দ্রীয় কমিটির মাথায় ছড়ি ঘোরাতে না পারে। সরকার ও দলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটি শুধু পুনর্গঠন নয়, তার হাতে সরকারকে নিয়ন্ত্রণের অংশীদারিত্ব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন দেশের একজন একক ব্যক্তিত্ব। এই একক ব্যক্তিত্বের হাতে এখন সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত আছে। এর প্রধান বেনিফিসিয়ারি আমলারা। শেখ হাসিনার কাছে আমার অনুরোধ, তিনি যেমন আছেন তেমনি থাকুন, কিন্তু দলটির সংস্কার এবং তার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে এনে তিনি আমলাতন্ত্রকে নয়, দেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করুন। (লন্ডন ১২ নবেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৯)
×