ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে

বুলবুলের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতি

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ১২ নভেম্বর ২০১৯

বুলবুলের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতি

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তা-বে দেশের উপকূলীয় এলাকায় লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট, বাড়িঘর ও গাছপালা বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝড়ের প্রভাব কেটে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো- বরিশাল ॥ জেলার ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। তলিয়ে গেছে ৪৩৫টি মাছের ঘের। এছাড়াও ১২০ কিলোমিটার সড়ক ও ২২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৬০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভেঙ্গে পড়েছে কয়েক হাজার গাছ। ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া গাছ চাপায় উজিরপুর উপজেলায় আশালতা মজুমদার (৬৫) নামের এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন। সোমবার বিকেলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র অবজারভার মোঃ আনিসুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় এলাকা অতিক্রমকালে বরিশালে সর্বোচ্চ বাতাসের গতিবেগ রেকর্ড করা হয় ঘণ্টায় ৮৭ কিলোমিটার। গত ৯ নবেম্বর দুপুর থেকে রবিবার বিকেল পর্যন্ত ২২২ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে নগরীর বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। পানিবন্দী হয়ে পরে নগরবাসী। ঘরবাড়ির মধ্যে পানি ঢুকে পড়ে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে জাতীয় গ্রিডে সমস্যা দেখা দেয়ায় রবিবার সকাল থেকে সোমবার পর্যন্ত জেলার কোথাও বিদ্যুত নেই। তবে সোমবার বিকেলে নগরীর কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হলেও এখনও জেলার দশটি উপজেলার কোথাও বিদ্যুত নেই। সোমবার বিকেলে গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান জানান, উপজেলায় চার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ১৫ হাজার গাছপালা, পাঁচ হাজার পুকুর, চার হাজার হেক্টর ফসলি জমি, পাঁচ শ’ হেক্টর জমির পানের বরজ, দুই শ’ হেক্টর জমির খেসারি ক্ষেত, ১৫০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত, ১৫ হেক্টর জমির কলাবাগান, একশ’ মুরগির খামার, ২০টি ডেইরি খামার, ৩৫টি ছাগলের খামার ও ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যশোর ॥ যশোর জেলার প্রায় ১ হাজার ২৮৫ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। গত রবিবার যশোরের বিভিন্ন উপজেলায় সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা এসব ক্ষতির তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে বলে জানা গেছে। আর কয়েকদিন পার আমন ধান কাটা হবে। এ সময় বুলবুলের প্রভাবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে মাটির সঙ্গে ধান শুয়ে পড়েছে। যশোর শার্শা উপজেলা পাঁচ ভূলাট গ্রামের আবদুস সাত্তার জানান, আমি ১০ বিঘা আমন ধানের চাষ করেছি। আমন ধান আর কয়েকদিন পর বাড়ি আসার কথা। কিন্তু বুলবুলের আঘাতে প্রায় ৭ বিঘা জমির ধান মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। বুলবুল আঘাত না হানলে আমরা প্রতি বিঘা থেকে প্রায় ২০ মণ ধান উৎপাদন হতো। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে প্রতি বিঘায় ৮ থেকে ১০ মণ ধান পাওয়া যাবে। তিনি আরও জানান, গত বৃহস্পতিবার ১ বিঘা জমিতে পটোলের লতি (চারা) রোপণ করেছি। কিন্তু গত তিনদিন বুলবুলের প্রভাবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে সব লতি নষ্ট হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় সরকার যদি আমাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে আগামীতে চাষ করতে আরও সহজ হবে। মনিরামপুর উপজেলার চাউলিয়া গ্রামের মাসুম জানান, আমি নিজের ও অন্যের কাছ থেকে কিছু জমি বর্গা নিয়ে প্রায় ৪ একর জমিতে আমন ধান চাষ করেছি। হঠাৎ বুলবুলের কারণে আমার ক্ষেতের ধান প্রায় সব নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, এখন ধানে চাল গাঁথা ও পুষ্টি হওয়ার সময়। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ধান গাছ সব মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এবার যে পরিমাণ ধান উৎপাদন আশা করেছিলাম তার অর্ধেকও উৎপাদন হবে না। এরপরও যদি সরকার ধানের দাম বৃদ্ধি করে তাহলে আমাদের ক্ষতিটা কিছুটা পুষিয়ে উঠবে। একই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার ২ বিঘা জমিতে পেঁপের বাগান আছে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে কিছু গাছ মাটিতে পড়ে গেছে আর কিছু গাছ থেকে পেঁপে ঝরে পড়েছে। কলাগাছ ছিল এক একর জমিতে। কিন্তু বুলবুলের প্রভাবে প্রায় সব গাছ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এসব কলাগাছে কয়েকদিনের মধ্যে কলাগাছে কলার ধরন আসত। তিনি আরও জানান, আমি ৩ বিঘা মসুরি চাষ করেছিলাম কিন্তু গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে মসুরির চারা হলেও তাতে ভাল ফলন আশা করা যাচ্ছে না। চারা বের হওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে অধিকাংশ চারা মারা যাবে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ঝালকাঠি ॥ ঝালকাঠিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রচ- বাতাসে ৮১৭টি কাঁচা ঘরবাড়ি ও ৪১৫ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়ছে অসংখ্য গাছপালা। টানা বৃষ্টি এবং সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪/৫ ফুট বেড়ে তলিয়ে গেছে ৬১৫টি মাছের ঘের ও পুকুর। এছাড়াও ১১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির উঠতি আমন ও উফশ উচ্চ ফলনশীল জাতের ৩ হাজার ৩৫০ হেক্টরের ধানের ক্ষেত পানিতে তলিয়েছে, ৫ হাজার ২২০ হেক্টরের অন্য ফসল, ১ হাজার ৪৫০ হেক্টরের শাক সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮১৭টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৫টি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক লাইনের ওপর গাছপালা পড়ে এবং বৈদ্যুতিক খুঁটি উপড়ে যাওয়ায় দুই দিন ধরে বিদ্যুত সরবরাহ ও শহর এলাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। চাঁদপুর ॥ চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার চরাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ৫শতাধিক কাঁচার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি সরাতে গিয়ে কমপক্ষে ২০জন আহত হয়েছেন। বিধ্বস্ত ঘরের মধ্যে সদর উপজেলার রাজরাজেশ^র ইউনিয়নে মেঘনা নদীর পশ্চিমপারে ১১০টি, হানারচর ইউনিয়নে ২০টি, ইব্রাহীমপুর ইউনিয়নে ২২টি ও চান্দ্রা ইউনিয়নে ১১টি এবং হাইমচর উপজেলা প্রায় ১০টি চরে ৩৬০টি ঘর। কলাপাড়া ॥ সাগরপারের জনপদ কলাপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ৩৬২টি কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ১২ হাজার ৭৭৭ একর আমনক্ষেতে ধানের ক্ষতি হয়েছে। শাক-সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়েছে ৩৮৫ একর। শনিবার রাত ১২ টা থেকে বন্ধ হওয়া বিদ্যুত সরবরাহ ৩৭ ঘণ্টা পরে সোমবার দুপুরে সচল হয়েছে। দুটি বিদ্যুতের খুঁটি বিধ্বস্ত হয়েছে। ১৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ৭০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। শত শত গবাদিপশু নিয়ে মানুষ স্বস্তিতে ছিল। প্রবল বর্ষণ ও অস্বাভাবিক জোয়ারে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লালুয়ার চারিপাড়া, চৌধুরীপাড়াসহ ১০টি গ্রামের বিপদাপন্ন ৬০০ পরিবারকে ঘূর্ণিঝড়ের রাত থেকে উপজেলা প্রশাসন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জেলা পরিষদ ও স্থানীয় এমপি অধ্যক্ষ মহিব্বুর রহমান পর্যায়ক্রমে শুকনো ও খিচুড়ি বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। সোমবার দুপুরে তিনি খিচুড়ি বিতরণ ছাড়াও ৬০ টি পরিবারকে কম্বল বিতরণ করেন। কালকিনি ॥ মাদারীপুরের কালকিনিতে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে দুই শতাধিক কাঁচা ঘর-বাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এ সময় গাছপালা, ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুত সংযোগ। এতে করে প্রায় দুই কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে। এলাকা, সরেজমিন ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রবিবার বিকেলে বজ্রসহ মুশলধারে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া শুরু হয়। ক্রমশ বাতাসের গতিবেগ বাড়তে থাকে। উড়িয়ে নিয়ে যায় ঘরের চাল। এতে করে উপজেলার বালিগ্রাম, গোপালপুর, সাহেবরামপুর ও রমজানপুরসহ উপজেলার সকল ইউনিয়নের ওপর বুলবুলের প্রভাব পরে। এতে করে সব মিলিয়ে দুই শতাধিক বসতঘর ও শতবর্ষী গাছপালা ভেঙ্গে পড়ে। ভোলা ॥ নিলুফার বেগম। তার স্বামী শহিদুল একজন ঘাট শ্রমিক। ঝড়ের রাতে তার স্বামী ছেলে, বউসহ ৬ জন ছিল। তাদের ঘরে যা ছিল হাড়ি-পাতিল সব নিয়ে গেছে। খাওয়ার বাটি খোড়া কিছুই নেই। ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে কোন রকমে জীবন বাঁচলেও অনেকেই আহত হয়েছেন। চরফ্যাশন উপজেলার চরকলমী ইউনিয়নের চর মঙ্গল গ্রামে গেলে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তা-বে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করা নিলুফার বেগমের পরিবারের চরম বিপাকের চিত্র বর্ণনা করেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তার ২ ছেলে নদীতে মাছ ধরে। তাদের পক্ষে সরকারী সহায়তা না পেলে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব নয়। শুধু নিলুফাই নয় তার মতো এখনও বহু পরিবার ওই এলাকায় খোলা আকাশের নিচে চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। চরফ্যাশনের চরকলমী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাওসার আহমেদ জানান, এই ইউনিয়নের প্রায় ৩৭ ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রায় ৪০টি পরিবার অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের কাছে দ্রুত ওই ঘর পুনঃ নির্মাণের দাবি জানান। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তা-বে গত শনিবার রাতে উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলার কয়েকটি গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে দেড় শতাধিক পাকা কাঁচা ঘরবাড়ি। ভোলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে লণ্ডভণ্ড গ্রামে বিধ্বস্ত পরিবার এখনও খোলা আকাশের নিচে অসহায় অবস্থায় চরম দুর্ভোগে রয়েছে। শনিবার রাতে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলার কয়েকটি গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
×