ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সঙ্কটে শিক্ষা ও শিক্ষক ॥ ইন্ধন কোথায়?

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১২ নভেম্বর ২০১৯

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সঙ্কটে শিক্ষা ও শিক্ষক ॥ ইন্ধন কোথায়?

উপাচার্য এখন একটি ভয়ঙ্কর নাম। এটা তার নিজের জন্য যেমন, তেমনি ছাত্রছাত্রীর বেলায়ও। হঠাৎ করে বাংলাদেশে উপাচার্যরা দেখছি টার্গেট। যার যত বেদনা, রাগ, মান-অভিমান সবকিছুর কেন্দ্রে এখন উপাচার্য। একের পর এক চলছে এই কা-। আনোয়ার হোসেনের মতো বিদগ্ধ, স্বনামে পরিচিত যেমন, তেমনি বুয়েটের উপাচার্য, কেউ ছাড় পাননি। এখন চলছে জাহাঙ্গীরনগর পর্ব। কি দাবি কি দাওয়া, সেটা যত মুখ্য, তার চেয়ে প্রকট আন্দোলনের নামে উগ্রতা। এটা মানি, দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে ছাত্রছাত্রীরা এমন করত না। তাদের আমরা সন্তানতুল্য জ্ঞান করি। তাদের দিকটা বিবেচনায় রেখেই কথা বলতে হবে। বরাবরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুখ খুলতে হয়েছে। তিনি বেশ রাগত স্বরেই বলেছেন, আনীত অভিযোগগুলো প্রমাণ করা না হলে অভিযোগকারীদের শাস্তি পেতে হবে। আইনের চোখে এবং যুক্তিতে এটা খাঁটি কথা। এক সময় ইংল্যান্ডের আইনে ছিল, আপনাকে আমি চোর বললে আপনি আদালতে নিজেকে চোর কিনা তার প্রমাণ দেবেন। আমেরিকা সেটা পাল্টে দিয়েছে, যে আপনাকে চোর বলবে তার দায় তা প্রমাণ করার। না পারলে তাকেই শাস্তি পেতে হবে। জরিমানা দিতে হবে। আমরা যত আধুনিক হব বা হচ্ছি, তত যেন জংলী হয়ে উঠছি। প্রধানমন্ত্রী আসল জায়গায় হাত দিয়েছেন। একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। বার বার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত কেন? এর কারণ কি এই যে, দেশের আর কোথাও রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কাজকর্ম নেই বলে ঘাপটি মেরে থাকা বিরোধী নামের অপশক্তি এখানে চক্রান্তের জাল বুনছে। ঘোলা পানিতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে মৎস্য শিকার করতে চায় তারা? নাকি আমরা মেনে নেব, দেশের আর সবকিছু যখন অচলায়তনের মতো স্থবির, তখনও নবীনপ্রাণ নতুন রক্তেই আছে কিছু ভাঙ্গার বা বলার চেষ্টায়? খুশি হতাম যদি কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন বা এসব উত্তেজনায় বুড়োদের না দেখতাম। শব্দটা বুড়ো না বললে বড় বলতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করি, শিক্ষকদের সবাই কি অরাজনৈতিক? যারা সবকিছু নষ্ট রাজনীতির কবলে বলে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনকে আওয়ামী বিরোধিতায় নিয়ে যেতে আগ্রহী! তারা কি অরাজনৈতিক মানুষ? অনেকেই তো বহুকাল থেকে দলের সঙ্গে যুক্ত। প্রায় সবাই সব সময় সব কিছুতে না বলার লোক। ভাল হোক, মন্দ হোক- না বলাটা কিছু মানুষের স্বভাব। গ্রামদেশে একটা প্রবাদ আছে- যারা নেগেটিভ মানুষ তারা নাকি ভরপেট দাওয়াত খেয়েও বলে, এত খাওয়ানোর কি দরকার, এখন যে ঢেঁকুর উঠছে? অন্যদিকে উপাচার্য পদটি অতীতেও এমন বিতর্কের মুখে পড়েনি। লাগাতার চলছে পদটির ইজ্জত হনন। ক’দিন পর মানুষ উপাচার্য শুনলে জানালা-দরজা বন্ধ করে দিতে পারে ভয়ে। সঙ্গে জুটেছে ছাত্রলীগের নামও। ছাত্রলীগের রাজনীতি এখন এমন, আগে তারা কেউ মারামারি করলে অনুপ্রবেশকারী বা নামধারী বলত। এখন আর তাও বলে না। যার মানে যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। এই বেপরোয়া মনোভাব সরকারে থাকার জন্য হলে এটাও মনে রাখতে হবে, এক মাঘে শীত যায় না। আর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলার ফল এদেশে কোনকালে ভাল কিছু বয়ে আনেনি। সরকারকে এ বিষয়ে মনযোগী হতেই হবে। সাধারণত ছাত্রছাত্রীরাই হয় নিয়ামক। তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, অভিভাবক সবাই এর সঙ্গে জড়িত। এই যে মেয়েদের হল ছাড়তে বলা, বিনা নোটিসে বাড়ি যেতে বলা; এতে লেখাপড়ার বারোটা বাজার পাশাপাশি নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত। তাদের কিছু হলে কে নেবে দায়? দেশে গিয়ে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, কারও কোন দায়বোধ নেই। কেউ মরল কি বাঁচল এটা যেন তাদের নিজস্ব দায়িত্ব। রাষ্ট্র, সমাজ, বাহিনী বা জনগণ কারও কিছু বলার নেই, করার নেই। এই পরিবেশকে আপনি কি যথাযথ উন্নয়ন বলবেন? উন্নয়নের পাশাপাশি শান্তি ও সহিষ্ণুতা আজ খুব দরকার। আবারও বলছি, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমন উত্তেজনা আর অশান্তি অকল্পনীয়। জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীদের নিশ্চয়ই কিছু ন্যায্য চাওয়া আছে। তাদের কাছ থেকে সেগুলো জেনে তারপর সমাধান করা জরুরী। তাহলে নিশ্চয়ই সুবিধাবাদীরা সুযোগ নিতে পারবে না। কারও দোষ ধরার আগে উপাচার্য আর ছাত্রলীগের দিকে তাকানো উচিত। কেন তারা পেটোয়া বাহিনীর মতো কাজ করছে? কেন তারা এত উগ্র? এর কারণ কি ধরাকে সরা জ্ঞান করা? নাকি এর ভেতরেও গডফাদারদের ইন্ধন আছে? উপাচার্যরা আজকাল কথাবার্তায়ও অসংযত। কেউ সরাসরি বলেন যুবলীগের জন্য এই পদ ছেড়ে দেবেন। কেউ রাজনীতির মোসাহেব। কারও কথা বালখিল্য উপাচার্যরা। কেন ঘুরেফিরে আসছেন সংবাদ শিরোনামে? তারা কিভাবে দেশ বা জাতির অভিভাবক হতে পারেন? আজ তাদের নিয়ে যেসব কথা বা যেসব আলাপ, সামাজিক মিডিয়ায় যেসব প্রচার-অপপ্রচার, তাতে যে কোন সভ্য দেশের মানুষ হলে সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করতেন। আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে সে কালচার, সে সংস্কৃতি নেই। যতদিন কেউ না কেউ এমন পরিস্থিতিতে সামনে এসে বুক পেতে বলবেন : অনেক হয়েছে। এবার আমাকে যেতে হবে। তোমরা যা বলছ তার দায় আমার। বা বলবেন, না এ আমি মানতে পারব না, তাই আমি গেলাম। ততদিন এসব সমস্যার আগুন লেখাপড়াকে পেছনে ফেলে জ্বলতে জ্বলতে সবকিছু ছাই করে দেবে। আসলে লেখাপড়ার মান, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যত কিছুই কিছু না এখন। কেবল হৈ হৈ, মারামারি আর উত্তেজনায় এক ধরনের আনন্দ চাইছে সকলে। সঙ্গে জুটেছে ইন্ধন। একদিকে দম্ভ। অহঙ্কার। দাপট। আরেকদিকে না পাওয়ার যন্ত্রণা। মাঝখানে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সাধারণ মানুষের। এমন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে আর? [email protected]
×