ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মৌ চাষে বাড়তি আয়

প্রকাশিত: ১২:০১, ১০ নভেম্বর ২০১৯

মৌ চাষে বাড়তি আয়

কৃষি প্রধান বাংলাদেশে মৌমাছি পালন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মধু উৎপাদন ছাড়াও পরাগায়নের মাধ্যমে কৃষিজ ও ফলজাত দ্রব্যের ফলন বৃদ্ধি, উন্নতমানের বীজ উৎপাদন ও বনজ সম্পদ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখা সম্ভব। যা আমাদের কৃষি প্রধান দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে মৌমাছি পালনের প্রয়োজনে বাধ্যতামূলক বৃক্ষ রোপণ, উদ্ভিদ তথা পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ু সংরক্ষণ এবং সমৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের সবজায়গায় মৌমাছি দেখা যায়। এরা প্রধাণত গাছের ডালে, মাটির গর্তে, পাথরের গায়ে, গুহার মধ্যে, বনজঙ্গলে, ঝোপঝাড়ে, বাড়ির দেয়ালে মৌচাক বানিয়ে সামাজিক প্রাণী হিসেবে বাস করে। মৌমাছি একটি উপকারী এবং পরিশ্রমী পোকা। মৌমাছিকে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ধরে এনে মৌচাকের উপযোগী বাসস্থান সৃষ্টি করে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পালন করাকে মৌমাছি পালন বলে। অবসর সময়ে অল্প খরচে বসত বাড়ির যে কোন জায়গায় মৌমাছি পালন করে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময় মৌচাষ কার্যক্রমের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আয়ের তুলনায় স্বল্প শ্রম ও স্বল্প পুঁজির বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা খরচ করে আলাদাভাবে কাঁচামাল ক্রয় করতে হয় না এর কাঁচামাল প্রাকৃতিকভাবে সহজলভ্যই বলা যায়। বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছাড়া নির্দিষ্ট জমি কিংবা আলাদা ঘরের প্রয়োজন হয় না। এ কাজ বেকার ও যে কোন পেশায় নিয়োজিত মানুষের পক্ষে করা সম্ভব। পুষ্টি ও পরিবেশ উন্নয়নসহ জলবায়ু সংরক্ষণে সহায়কও বটে। এর মাধ্যমে বিশুদ্ধ মধুর অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। ফল ও ফসলের গুণগত মান সমৃদ্ধি ও ফলন বৃদ্ধি ঘটানো যায়। নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণে মধু খেলে দীর্ঘায়ুসহ সুস্বাস্থ্য লাভ ও রক্ষায় সহায়ক শক্তি যোগায়। মৌচাষ এবং মধু শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে গ্রামের সাধারণ শ্রেণীর মানুষ বাড়তি উপার্জন নিশ্চিত করতে পারে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪০০ বছর আগে মৌচাষ শুরু হলেও বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে। সূচনালগ্নে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এবং প্রশিকার মতো বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নিবিড় প্রচেষ্টায় আজকের বাংলাদেশে মৌচাষের বিষয়টি স্বল্প শ্রম ও স্বল্প পুঁজির বিনিয়োগে তুলনামূলক অধিক মুনাফা লাভের সম্ভাবনাময় পেশা ও ব্যবসা হিসেবে জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় মাত্র ২৫-৩০ হাজার মৌচাষি সৃষ্টি হয়েছে। এ সংখ্যা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রতি ৩/৪টি গ্রামে গড়ে ১ জন করে মৌচাষিও সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। অথচ সুষ্ঠু এবং বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার আওতায় লাগসই প্রযুক্তি ও উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৌচাষ ও মধু শিল্পে নিয়োজিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। মধু এখন রফতানি পণ্য তালিকায় নাম লিখিয়েছে। ফসলের মাঠে মৌমাছি বিচরণ করলে সেখানে বাড়তি পরাগায়নের কারণে ফসলের উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। মৌচাষের মাধ্যমে মধু আহরণে সমৃদ্ধি ও শস্য বা মধুভিত্তিক কৃষিজ উৎপাদন বাড়ে। মৌসুমে সরিষা, ধনিয়া, তিল, কালিজিরা, লিচুসহ আবাদ হয় মোট প্রায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে বা বাগানে। এর মাত্র ১০ শতাংশ জায়গায় মৌ বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করা হচ্ছে। প্রায় ২৫ হাজার মৌচাষিসহ মধু শিল্পে জড়িত প্রায় ২ লাখ মানুষ। দেশে মধুর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৬ হাজার টন। ফসলের এই পুরো সেক্টরটিকে মধু আহরণের আওতায় আনতে পারলে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হবে। দেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়। পুরো সরিষার মাঠ মধু সংগ্রহের আওতায় আনা গেলে উৎপাদন যেমন বাড়বে তেমনি ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমবে।
×